একটি গ্রামের আত্মকথা রচনা [সঙ্গে PDF]

ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে অসংখ্য গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী এক সময় বলেছিলেন ভারতের আত্মা বসবাস করে ভারতের গ্রামে। তার সেই কথাটি সত্য বলে ধরে নিলে বলতে হয় ভারতের প্রত্যেকটি গ্রামেরই কোনো-না-কোনো আত্মকথা রয়েছে। তেমনি ভারতের প্রান্তিক অঞ্চলের একটি গ্রামের আত্মকথা ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

একটি গ্রামের আত্মকথা রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

আমি হলাম ভারত ও বাংলাদেশের সীমানায় পশ্চিম বাংলার বুকে অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম। সেই সুদূর অতীতকাল থেকে আমার বুকে বসবাস করা সরল সাদা মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে চির বহমান আমার জীবন। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী একদা বলেছিলেন, “ভারতবর্ষের আত্মা বসবাস করে ভারতের গ্রামগুলিতে”।

আমি নিজের জীবন দিয়ে মহাত্মার এই কথার সার্থকতা পরতে পরতে অনুভব করতে পারি। আমার এই দীর্ঘ জীবনে কখনো যেন আমি এই দেশ তথা এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে কোন পৃথক সত্তাকে অনুভব করতে পারিনি।  বরাবরই উপলব্ধি হয়েছে আমি এই সুবিশাল ও সুমহান সভ্যতার যে পরমাত্মা তারই অংশবিশেষ।

এরকমই সাত সহস্রাংশ একত্রে মিলিত হয়ে আমরা ভারতবর্ষের পরমাত্মা গঠন করি। আমার এই দীর্ঘ জীবনের তথাকথিত তুচ্ছ কাহিনী ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

আমার জন্ম বৃত্তান্ত:

আমার জন্মের ইতিহাস অতি প্রাচীন। তাই আমাকে মধ্যযুগের ভারতবর্ষে গড়ে ওঠা ভুঁইফোড় গ্রামগুলির মধ্যে গণনা করলে ভুল করা হবে। যে সময় আমার জন্ম, সে সময় এ বাংলায় জনসমাগম ছিল খুব কম। আমি গ্রাম হিসেবে তৈরী হবার পূর্বে এখানে ছিল ঘন জঙ্গল। না জানি কোথা থেকে হঠাৎ একদিন কিছু তান্ত্রিক সাধু এসে বন জঙ্গল সাফ করে এই অঞ্চলে তন্ত্র সাধনা শুরু করলেন।

বলাবাহুল্য আমার বুকে তখন কোন কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। তাই বিভিন্ন দিক থেকে সেই সমস্ত তান্ত্রিক সাধুদের অসংখ্য ভক্ত এসে ঘাঁটি গাড়তে থাকলো এই অঞ্চলে। জন্মকালে আমার কোন নাম না থাকলেও সেই ভক্তদের মুখে আমার নাম ছড়িয়ে পড়ল যাদুগ্রাম। সময়ের নিয়মে সেই সাধুরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও রয়ে গেলেন তাদের ভক্তগণ। তারাই বংশপরম্পরায় আমার বুকে বসতি স্থাপন করে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রাম রূপে আমায় গড়ে তুললেন।

ইতিহাসে আমি:

বয়সে এত প্রাচীন হবার কারণে ইতিহাসের অভিজ্ঞতাও আমার সুদীর্ঘকালের। এই বাংলার বুকে আমার ওপর দিয়ে কতকিছু ঘটে যেতে দেখেছি আমি। দেখেছি কামার আর কুমোরদের নানারকম ধাতু কিংবা মাটির মূর্তি বানিয়ে উপাসনা করতে। আবার দেখেছি গৌড়ের অধিপতি শশাঙ্কের দাপটে আমার বুকে আশ্রয় নেওয়া  বৌদ্ধভিক্ষুদের সভয় পলায়ন।

আবার তারও বহুকাল পরে দেখেছি এ বাংলার বুকে যবনদের আগমন। বিদেশী শক্তির হাতে রেখেছি আমার অধিবাসীদের বিধ্বস্ত হতে। কখনো বর্গীরা বাংলা আক্রমণের সময় আমার উপর দিয়ে দাপিয়ে ঘোড়া চালিয়ে চলে গিয়েছে, কখনো আবার আমার চারপাশে গড়ে ওঠা সবুজ শস্য ক্ষেতে নীল চাষের জন্য অত্যাচারী ইউরোপীয় নীলকর সাহেবরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে আমার কতশত নিরীহ গ্রামবাসীকে।

এত ঘটনা দেখেও আমি মুখ দিয়ে এতোটুকু আওয়াজ করতে পারিনি। কারণ আমি তো নির্বাক; সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অভিশাপে সেই ক্ষমতা আমার নেই।

আমার সেকাল-একাল:

সময়ের সাথে পৃথিবী বদলে যায়; পৃথিবীর সেই নিয়ম মেনে তাই বদলেছি আমিও। দীর্ঘ পরাধীনতার নাগপাশ অতিক্রম করে আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে মানুষও। তাদের দৈনন্দিন জীবনচর্যার ক্ষেত্রেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার খাতিরে মানুষ পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগিয়েছে আমার শরীরেও।

তাই আমার চারপাশে এক সময় ছিল ঘন জঙ্গল, সেখানে আজ দূর দূরে তাকালেও জঙ্গলের নামমাত্র চোখে পড়ে না। বরং চোখে পড়ে দিগন্তবিস্তৃত শস্য ক্ষেত, মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ, আর মানুষের ব্যাস্ত চলাফেরা। অতীতে যেখানে আমার বুকে বসবাস করত মাত্র কয়েক ঘর মানুষ, সেখানে আজ সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজারেরও ওপরে।

এখন আর মানুষকে অন্ধকারে লণ্ঠনের আলোয় কাজ করতে দেখিনা, তার জায়গা নিয়েছে ইলেকট্রিকের উজ্জ্বল বাতি। এখন আর আগের মতন পোস্টমাস্টার চিঠি বলে হাঁক দেয় না;  তার জায়গায় মানুষ মুহূর্তে মুঠোফোনের মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ করে দেয়। সময়ের সাথে এই বিবর্তন ঠিক নাকি ভুল, উত্থান নাকি অবক্ষায়, তা বিচারের সামর্থ্য আমার নেই। এই দীর্ঘ জীবনে আমি শুধু শিখেছি পরিবর্তনই পৃথিবীর নিয়ম, এবং অমোঘ নিয়তি।

আমার বর্তমান জীবনকথা:

বর্তমান যুগে আমার চারিদিকে দেখি বড় বড় ইলেকট্রিকের খুঁটি বসানো। গ্রামের বাইরে থেকে মানুষজনের আনাগোনা ক্রমেই বাড়ছে। তবে আমার একটি পাশ এখন কাঁটাতারের বেড়া দ্বারা জীর্ণ। সেই বেড়া ধরে চলে নিয়মিত নিরাপত্তার সারণি। সেই বেড়ার নিরাপত্তাবেষ্টনী অতিক্রম করে ওপার থেকে এপাড়ে আসে কার সাধ্যি।

তবে অতি সম্প্রতি শুনছি নাকি এ অঞ্চলে কারখানা গড়ে উঠবে। সে কারখানায় কাজ পাবে আমার বুকেই বসবাস করা শত শত মানুষ। জানিনা কখন আমি বিস্তীর্ণ শ্যামল শস্যক্ষেত দেখতে পাবো কিনা। তবে তা নিয়ে আফসোস হয়না। মানুষের ভালো হোক, এটুকুই কাম্য।

উপসংহার:

অতি সংক্ষেপে এই ছিল আমার নগণ্য জীবনের অসংখ্য পাতা থেকে তুলে আনা সামান্য কয়েকটি অংশ। আমার জন্ম মানুষের বাসস্থান রূপে; নিজের জীবনের সেই অভিষ্ঠ যথাযথভাবে পূরণের  মধ্যেই আমার জীবনের প্রকৃত সার্থকতা। কিছুক্ষণ আগে নিজেকে স্থবির বলে আক্ষেপ করলেও, স্থবিরতাই আমার সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আমার পরম প্রাপ্তি।


আশাকরি আমাদের এই প্রতিবেদনটি আপনাদের ভালো লেগেছে এবং তা বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে আপনাদের সহায়তা করবে। একটি গ্রামের আত্মকথা শীর্ষক এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনাদের মতামত মন্তব্যের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের প্রতিবেদনকে ভবিষ্যতে আরো উপযোগী করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন