একটি নদীর আত্মকথা রচনা (Akti Nodir Atmokotha Rachana) [With PDF]

নদীর স্রোতের কুলুকুলু শব্দের ভাষা যদি আমরা বুঝতে পারতাম তাহলে হয়তো জানতে পারতাম বহুবছর ধরে বুকে চেপে রাখা তার কত কত স্মৃতির কথা।প্রতিনিয়ত বয়ে চলা নদীর জন্ম,ইচ্ছে,ব্যাথা,বেদনার কথা জানতে পারতাম। কুলুকূলু শব্দে নদী কি বলতে চাই আমাদের সকলকে তা নিয়েই আজকের উপস্থাপন একটি নদীর আত্মকথা রচনা

একটি নদীর আত্মকথা

ভূমিকা: 

প্রতিদিনকার কোলাহলের মধ্যে আমরা নিয়তই হারিয়ে ফেলি অন্তরে লুকিয়ে থাকা আমাদের সদাউন্মুখ সত্ত্বাটিকে। একইভাবে আমাদের মতই একটি নদীও তার প্রতিদিনের বয়ে চলার মধ্যে লুকিয়ে রাখে তার জীবনের হাজার হাজার অজানা ইতিহাস।

‘একটি নদীর আত্মকথা’ শুনতে অপ্রাসঙ্গিক লাগলেও, বাস্তবিক অর্থে তা এক পরিপূর্ণ জীবনেরই রূপ। লুকিয়ে রাখা অনেক না বলা কথা নিয়ে একটি নদীর বয়ে চলা।এক মুহুর্ত তার থেমে থাকার অবকাশ নেই। তেমনই একটি নদী আজ তার আত্মকথা জগতকে শোনাতে চায়। 

একদিন অতীতে বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু এক নদীকে জিজ্ঞাসা করেন — “কোথা হইতে আসিয়াছ নদী?” সেই নদীটি উত্তর দেয়— “মহাদেবের জটা হইতে”। আমি সেই মহাদেবের জটা থেকে ধরিত্রীর বুকে নেমে বয়ে চলা সবার চিরপরিচিত গঙ্গা।

আত্মকথা বলার কারণ:

 আজ আমার কথা বলব। দিনের-পর-দিন বয়ে নিয়ে আসা আমার আদিম ইতিহাসের কথা বলব। বলব কোথায় আমার জন্ম; কোথা থেকে আসছি আমি। আমার এই ভাষা সাধারণের ভাষা নয়।

আমার কাছে ভাষা শুধু মুখে বলার নয়, শরীর ও মনের নানা অভিব্যক্তিও ভাষা হয়ে ওঠে। ঠিক যেমন নাম না জানা গ্রামের পাশ দিয়ে, মাঠের পাশ দিয়ে কুলুকুলু শব্দে আমি কথা বলে চলেছি, তা শুনতে পেলেও সবাই বুঝতে পারে না।

কিন্তু যারা আমার কাছে আসে, আমার সাথে সময় কাটায় তাদের জন্য আমার এই আত্মকথা। যদি কোনদিন কান পেতে শোনা যায় তাহলে দেখা যাবে আমার জল প্রবাহের মধ্যে এই বিশ্বপ্রকৃতির অন্তরের অন্তঃস্থ ধ্বনি ক্রমাগত কল্লোলিত হয়ে উঠেছে।

মানুষের মত বর্ণ, অক্ষর বা শব্দের জ্ঞান নেই কিন্তু আমার কাছে আছে ছল ছল ,কল কল , কুলু কুলু এবং আরো অনাহত ধ্বনি। আমি আজ আমার প্রানের সেই আদিম ভাষায় আমার জীবনের গল্প বলে যাব। 

আমার জন্মকথা ও পরিচয়: 

 প্রত্যেকের যেমন বংশ পরিচয় ,জন্ম পরিচয়, পিতৃনিবাস সমস্ত কিছু রয়েছে, আমারও ঠিক তেমনি বংশ পরিচয়, জন্ম পরিচয় রয়েছে। আমার পিতৃ নিবাস হিমালয়ের বরফ ঘেরা গোমুখ। ধরিত্রী মায়ের সন্তান আমি। ভারত আমার মাতৃভূমি।

পুরাণে আমার আবির্ভাবের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে লিখেছেন আজকের মানুষের পূর্বপুরুষরা। বিষ্ণুর পদ বিগলিত ধারা আমি। আমার প্রথম আধার চতুর্মুখ ব্রহ্মার জ্ঞান কমন্ডুলু।তারপর ঘটনাচক্রে পঞ্চানন মহাদেবের শিরোদেশে জটাজালে বন্দিনী হলাম আমি।

সেখানে যে কতকাল মহাদেবের তপস্যা সঙ্গী হয়েছিল সেসব কথা আজ আর সব মনেও নেই। যেখানে বসে আমি মুক্তির সাধনা করছিলাম।বদ্ধ জীবন আর ভালো লাগছিলো না। ভগিরথের তপস্যা আমাকে দিল মুক্তির স্বাদ। আমি স্বর্গের নন্দন ভূমি ছেড়ে সুখ-দুঃখ কান্নাহাসির-দোল-দোলানো মর্ত্যে নেমে এলাম।

অমরায় যা পাইনি, মরুভূমিতে এসে সেই ভালোবাসা পেলাম। মানুষ যে এত ভালবাসতে পারে তা আগে জানা ছিল না। মানুষের ভালোবাসায় পৃথিবীকে ভালবেসে সেই যে সমুদ্র পানে বয়ে চললাম , আমার সেই বয়ে চলা  আজও শেষ হয়নি। আমার শত নাম। সেসব নাম তোমাদেরই দেওয়া।  গঙ্গা, অলকানন্দা, মন্দাকিনী, জাহ্নবী, ভাগীরথী, পদ্মা কত নাম আমার! 

আমার স্বরূপ: 

আমি কে? আমার স্বরূপ কেমন? কে বলতে পারে সে কথা? আমি হয়তো নিজেও পুরোটা জানিনা। তবু আমি দেখেছি মানুষ জীবনের নানান মুহূর্তে আমাকে স্মরণ করে। আমার জলসিঞ্চনে অপবিত্রকে করে পবিত্র। আমার জলে পিতৃ-পুরুষের তর্পণ করে। আমার জলেই করে দেবতার আহ্বান। 

গতিপথে সভ্যতার উত্থান পতন: 

মানুষ আমায় ভালোবেসে দেশজুড়ে আমার দুই তীরে গড়ে তুলেছে তাদের সভ্যতা। কত গ্রাম ,গঞ্জ ,নগর ও তীর্থস্থান। গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গাসাগর— এই দীর্ঘ পরিক্রমা পথে প্রত্যহ আমি ছুঁয়ে চলি হরিদ্বার, কানপুর, আগ্রা, এলাহাবাদ, কাশী, পাটনা ত্রিবেণী ,নবদ্দীপ ও কলকাতার মত কত না শহর, নগর তীর্থভূমি।

আমি মহান ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী। আমি দেখেছি আর্যরা এসে আমার তীরে বসতি স্থাপন করেছে। দেখছি মহান যোদ্ধারা কিভাবে কুরুক্ষেত্রে সমবেত হতে। দেখেছি শক -হুন -পাঠান -মোগলদের ভারতের বুকে কালবৈশাখীর মত ঝাপিয়ে পড়তে।

আবার তাদের অবসানে ইংরেজরা এসেছে আমারই সাগর মোহনার পথে। তারাও চলে গেল একদিন। আমিই শুধু একভাবে প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছি এই বিপুল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। 

বয়ে নিয়ে চলা বাণিজ্যতরী:

ভারতবর্ষের বৃহত্তম নদী আমি। মূলত আমাকে কেন্দ্র করেই এদেশে কৃষি শিল্প বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। আমার প্রবাহে এদেশের মানুষ ভাসিয়েছে বাণিজ্য তরণী। আমার জল ভারত তথা বাংলাদেশের শস্যক্ষেত্রকে উর্বর করে তুলে মানুষের দুবেলা অন্ন প্রস্তুত করেছে।

আমার তীরে গড়ে উঠেছে কতশত শিল্প কারখানা। সেখানে শত সহস্র মানুষ জীবিকা অর্জনের সুযোগ পেয়েছে। তাই নিজেকে বারংবার খুব আশীর্বাদধন্য বলে মনে হয়।  

আমার দুঃখ ও বেদনা:

 সকলেরই জীবন যত সফলই হোক না কেন, দুঃখ-বেদনাও জীবনের অংশ। আমারও তেমনি কিছু মন খারাপের গল্প রয়ে গেছে প্রবাহিত জলধারার মধ্যে। মানুষ আমাকে ভালবাসে তথা সম্মান করে, তা আমার অত্যন্ত সুখ ও গৌরবের বিষয়।

কিন্তু সেই মানুষই প্রতিমুহূর্তে যেভাবে নর্দমা ও কারখানার বর্জ্য পদার্থ ও নোংরা দূষিত জল ফেলে আমাকে অপবিত্র করে চলেছে তাতে আর কতদিন আমি আমার এই স্রোতস্বিনী রূপ ধরে রাখতে পারব তা সন্দেহের বিষয়।

ওই দুর্গন্ধময় বিষাক্ত জলের তোড়ে আমার জীবন সংকটের বিষবাষ্পে ভেসে যায়। সেই প্রবাহে সভ্যতার বুকে ছড়িয়ে পড়ে দূষণ। এতে আমি দুঃখিত, বিমর্ষ; কিন্তু অসহায়। বিগলিত করুণা জাহ্নবী ধারা আজ দূষণ ছাড়া কিছুই দিতে পারে না মানবসভ্যতাকে।

উপসংহার: 

সভ্যতার ধাত্রী হলো নদী। আর আমি গঙ্গা— ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক সভ্যতার ধাত্রী। আমার তীরের স্নিগ্ধ পবনে একদিন বেদ মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিলো। দ্রষ্টা এর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল বিশ্বমানবতার মন্ত্র। আজও সেই মন্ত্র আমি বহন করে নিয়ে চলেছি আমার জলপ্রবাহের অন্তরে।

আজও এদেশের মানুষ আমাকে তাদের পরম পরিত্রাতা বলে মনে করে। এজন্য এই সভ্যতার রক্ষার হেতু আমার বেঁচে থাকা একান্ত আবশ্যক। আমার অপমৃত্যু ঘটলে এই মহান সভ্যতারও অপমৃত্যু ঘটবে। তাই মানুষের কাছে আমার কাতর আবেদন; আমরা যেন মূল্যবোধহীন না হই। বদলে আমরা গতিময় হই, হই মুক্ত প্রাণচঞ্চল।


একটি নদীর আত্মকথা প্রবন্ধ রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার।

এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান। দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো। সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন:

একটি বটগাছের আত্মকথা
Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন