একটি বিদ্যালয়ের আত্মকথা প্রবন্ধ রচনা [সঙ্গে PDF]

শিক্ষার আলোকে দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম হল বিদ্যালয়। স্থাপিত হওয়ার পর থেকে শিক্ষা বিলিয়ে যাওয়ার কর্মে নিরলস বিদ্যালয় কত শত সফল মানুষের শিক্ষাজীবনের সাক্ষী , তার হিসেব বিদ্যালয় নিজেও রাখতে পারেনি। কিন্তু ইট পাথরের তৈরি প্রতিটি বিদ্যালয়ের বুকেও চাপা রয়েছে তার দীর্ঘজীবনের হাজারও স্মৃতি। এই নিয়েই আমাদের আজকের উপস্থাপন একটি বিদ্যালয়ের আত্মকথা রচনা বা একটি স্কুলের আত্মকথা রচনা।

একটি বিদ্যালয়ের আত্মকথা রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

মানুষের জীবনের সবচেয়ে কাছের স্থান কোনটা? এই প্রসঙ্গে নানা মুনির নানা মত থাকলেও অধিকাংশ মানুষের কাছেই তার জীবনের সবচেয়ে কাছের জায়গা হল বিদ্যালয়। বিদ্যালয় এমন এক স্থান যেখানে মানুষ নিজের শৈশব এবং কৈশোর জীবনের অধিকাংশ দিনগুলি কাটায়। এই স্থানেই একজন মানুষের অমূল্য সব স্মৃতি তৈরি হয়। এই স্থানে মানুষ শেখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে, জীবনকে প্রকৃতরূপে যাপন করতে।

শিশু অবস্থায় গুটি গুটি পায়ে একদিন মানুষ বিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে পা রাখে। তারপর বেশ কিছু বছর কাটিয়ে বড় হয়ে একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে বিদ্যালয় থেকে চলে যায়। বিদ্যালয় থেকে যায় তার নিজের মতই। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অসংখ্য অগণিত প্রাণোচ্ছল জীবনের সাক্ষী হতে হতে ইট কাঠ পাথর দিয়ে তৈরি বিদ্যালয়ের বুকেও প্রাণের সঞ্চার হয়। তখন বিদ্যালয় আর যেন ছাত্র তৈরি করবার যন্ত্র থাকে না; অবোধ্য ভাষায় সে তার প্রাণের মর্মবাণী ব্যক্ত করতে চায়।

হৃদয় দিয়ে কান পাতলে তার সেই ভাষা শোনা যায়। কিন্তু নিয়তির পরিহাস এই যে, ইট-কাঠ-পাথরের তৈরি বিদ্যালয়ের ভাষা শোনবার ইচ্ছে বা অবকাশ কারোর নেই। আমি তেমনি এক হতভাগ্য বিদ্যালয়, আজ আমার দীর্ঘ জীবনের প্রৌঢ়াবস্থায় দাঁড়িয়ে আপন আত্মকথা ব্যক্ত করবার ইচ্ছা স্বরূপ এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা করছি।

জন্মের কথা:

ইতিহাসের যে সন্ধিক্ষণে আমার জন্ম সে সময় এই মহান ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনের পরাধীনতার অন্ধকারে ডুবে ছিল। ঐতিহাসিক মহাবিদ্রোহ তখনও প্রথমবারের জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে উঠতে পারেনি। সেটা ১৮৫৩ সাল। গোটা বাংলা জুড়ে তখনো নবজাগরণ আর শিক্ষা বিস্তারের হাওয়া একেবারে মিলিয়ে যায়নি। বাংলার বুকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার অনতিদূরে সোদপুর নামক একটি জায়গায়

কিছু সুধীজনের উদ্যোগে বালকদের জন্য একটি বিদ্যালয় শুরু করবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৮৫৩ সালের জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখে ভারতবর্ষের মহান সন্তান শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত দিয়ে আমার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তার কিছুদিনের মধ্যেই ছোট্ট আটচালা একটি ঘরের বিদ্যালয় হিসেবে আমার জন্ম। আনুষ্ঠানিকভাবে আমার নামকরন কোনদিনই হয়নি। লোকমুখে ‘সোদপুর স্কুল’ নামে প্রচার পেতে পেতে সেটি কবে যে আমার ‘ভালো নাম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতে পারিনি কখনো।

ইতিহাসে আমি:

আমি বয়সে অতি প্রাচীন হওয়ার কারণে আমার স্মৃতিপটে ইতিহাসের লিপিও অত্যন্ত দীর্ঘ। আমার স্থাপনার মাত্র চার বছরের মধ্যে আমি দেখেছি আমার অনতিদূরে ব্যারাকপুরে সিপাহী মঙ্গল পান্ডের হাত দিয়ে মহাবিদ্রোহের প্রথম আগুন জ্বলে উঠতে। আমি দেখেছি সামান্য দেশীয় সিপাহিদের ভয়ে একদা রক্তচক্ষু ব্রিটিশ শাসককে থর থর করে কাঁপতে।

এরপর আমার আঙিনায় এমন বহু ছাত্রকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছি যারা ভবিষ্যতে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছে বিদ্রোহ; আবার এমনও বহু ছাত্র আমার শ্রেণিকক্ষগুলিতে বড় হয়ে উঠেছে যারা ইংরেজ আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্তম্ভ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে ভবিষ্যতে। তার আরো পরে আমি আমার গুপ্ত কক্ষে স্থান দিয়েছি ব্রিটিশবিরোধী নানা বিপ্লবীদের, তাদের বৈপ্লবিক কর্মসূচির শলাপরামর্শ কান পেতে শুনেছি।

আমি সাক্ষী বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন ঘোষণার। আমি সাক্ষী ১৯১৯ সালে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণার। আমি আমার নিরীহ স্বদেশপ্রেমী ছাত্রদের ওপর ব্রিটিশদের অত্যাচার দেখেছি, আমি স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর দেশের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে ছাত্রদের আস্ফালন দেখেছি। আমার শ্রেণিকক্ষগুলি এমন বহু ছাত্রের জন্ম দিয়েছে যারা তাদের পেশাদারী ভবিষ্যতে বিশ্বের কাছে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। 

আমার বর্তমান:

১৬০ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে; আমি আমার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনাভূমিতে নিশ্চল নিশ্চুপ রূপে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছি। সময়ের সাথে সাথে আমার আয়তন বহরে বেড়েছে বৈ কমেনি। যে আটচালা ঘর নিয়ে আমার জন্ম হয়েছিল তা আজ তিনটি ভবনের ত্রিবেণী সঙ্গম। নির্লজ্জ আত্মপ্রচারের মতো শোনালেও, আমার খ্যাতিও আমার আয়তনের মতন সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে।

আজ তা এতদূর প্রসারিত হয়েছে যে অন্য জেলা থেকেও ছাত্ররা এসে আমার আঙিনায় শিক্ষা গ্রহণ করে। বিদ্যালয় শিক্ষা শেষের পর তারা যখন নিজে নিজে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাকে স্মরণ করে তখন আমি মনে মনে গর্বিত হই। প্রাথমিকভাবে অল্প কয়েকটি শ্রেণী নিয়ে শুরু হলেও, আজ আমি দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রসারিত একটি উচ্চ বিদ্যালয়। স্থাপনা কালে আমার চারপাশে বিস্তীর্ণ প্রান্তর থাকলেও আজ তা জনবহুল বসতি।

আমার এক পাশে এখন রেললাইন, একপাশে উঁচু ফ্লাইওভার, আর বাকি দুই পাশে বাজার। সব মিলিয়ে আমার চারিদিকে সারাদিন কোলাহল লেগেই থাকে। বলাই বাহুল্য এ পরিবেশ শিক্ষা গ্রহণের পক্ষে আদর্শ নয়। কিন্তু তবুও আমি এখনো আমার শিক্ষাগত গৌরব অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছি।

উপসংহার:

অতি সংক্ষেপে এই হল আমার দীর্ঘ জীবনের এক নাতিদীর্ঘ কাহিনী। আমার এই দীর্ঘ ঐতিহাসিক জীবনকে এই নাতিদীর্ঘ শব্দের বন্ধনীতে বাঁধতে গিয়ে কতবার যে হোচট খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। তবুও এই দীর্ঘ ব্যস্ত জীবনের মধ্যে একান্ত অবসরে আমি নিজের এই কাহিনী ব্যক্ত করবার সুযোগ পেয়েছি এই আমার পরম সৌভাগ্য।

পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই যে যতদিন আমি ইট-কাঠ-পাথরের দালানকোঠা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ততদিন চেষ্টা করব ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় ছাত্রদের যথাসম্ভব সুরক্ষিতভাবে ধারণ করতে। সেই যে আমার পরম ধর্ম; আমার একান্ত কর্তব্য। স্থবিরতা তো জীবনের পরিচায়ক নয়, বরং স্বধর্মই একটি সার্থক জীবনের ইঙ্গিতবাহী।


একটি বিদ্যালয়ের আত্মকথা রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার।এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন:

একটি বটগাছের আত্মকথা
একটি নদীর আত্মকথা
একটি রাজপথের আত্মকথা
একটি কলমের আত্মকথা রচনা
Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন