অলিম্পিক প্রবন্ধ রচনা [সঙ্গে PDF]

অলিম্পিক হল পৃথিবীর প্রাচীনতম বহুমুখী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা যা এখনো পর্যন্ত প্রতি চার বছর অন্তর বিশ্বজুড়ে আয়োজিত হয়ে থাকে। ক্রীড়াবিশ্বে অলিম্পিক গেমস হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় তথা সর্বোচ্চ সম্মানের আসন। তাইঅলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারা পৃথিবীর যে কোন ক্রীড়াবিদের কাছেই অত্যন্ত গৌরবের। আজ আমাদের এই প্রবন্ধে আমরা অলিম্পিক গেমসের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে চলেছি। 

অলিম্পিক প্রবন্ধ রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

খেলাধুলা হল মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য তথা অপরিহার্য অঙ্গস্বরূপ। শরীর তথা মনের বিনোদন এবং সার্বিক বিকাশের জন্য খেলাধুলার বিকল্প আর কোন কিছুই নেই। সে কারণেই বিশ্বজুড়ে খেলাধুলাকে বিশেষ গুরুত্ব দান করে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে ও মহাদেশে বিভিন্ন প্রকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তবে পৃথিবীতে সবচেয়ে বিখ্যাত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বলতে যে নামটি সর্বপ্রথম মাথায় আসে তা নিঃসন্দেহে অলিম্পিক।

অলিম্পিক গেমস বিশ্বে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন দা আর্থ’ নামেও পরিচিত। প্রতি চার বছর অন্তর পৃথিবীর আলাদা আলাদা দেশে আয়োজিত এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সমগ্র পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে মোট সহস্রাধিক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে থাকে। পৃথিবীর সম্পূর্ণ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উপভোগ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। 

অলিম্পিকের সূচনা:

অলিম্পিক গেমস আধুনিক যুগে কোন রাজনৈতিক উদ্যোগে কিংবা বিশেষ ব্যক্তির হাত ধরে উঠে আসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নয়। অলিম্পিকের সূচনাপর্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় তিন হাজার বছর আগে খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে। প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স শহরে অলিম্পিয়া নামক স্থানে প্রতি চার বছর অন্তর একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন খেলাধুলার সাথে ধর্মীয় রীতি পালনেরও প্রচলন ছিল।

এই প্রাচীন ক্রীড়া অনুষ্ঠানে প্রধানত দৌড় প্রতিযোগিতা, মল্লযুদ্ধ, মুষ্টিযুদ্ধ, বর্শা নিক্ষেপ, ডিসকাস ছোড়া, এবং ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা আয়োজিত হওয়ার কথা জানা যায়। গ্রিসের বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহাসিক দস্তাবেজ থেকে জানা যায় সেখানকার নগররাষ্ট্র গুলির মধ্যে প্রায় সারা বছর ধরে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলেও অলিম্পিক প্রতিযোগিতার সময় যুদ্ধ স্থগিত থাকতো।

অলিম্পিক ও কিংবদন্তিসমূহ:

নানা প্রাচীন দস্তাবেজের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকেরা ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দকে অলিম্পিকের সূচনা কাল বলে চিহ্নিত করলেও প্রাচীন গ্রিক পুরাণ অনুসারে অলিম্পিকের সূচনা আরো বহু পূর্বে। অলিম্পিকের সূচনা সম্পর্কে বেশ কিছু গ্রিক কিংবদন্তি কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তারই মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনটি হলো হেরাক্লিয়াসের কাহিনী, পেলপ এবং হাউজ অফ আয়ট্রিউসের কাহিনী, এবং জিউস ও ক্রোনাসের কাহিনী। প্রথম কাহিনী অনুসারে দেবরাজ জিউসের পত্র হেরাক্লিয়াস বা হারকিউলিস তার বারোটি মহাকাব্যিক অভিযান শেষ করে পিতা জিউসের সম্মানে একটি অলিম্পিক স্টেডিয়াম নির্মাণ করেন।

প্রাচীন গ্রিক ইতিহাস মতে এই স্টেডিয়ামেই প্রথম অলিম্পিক প্রতিযোগিতার আসর বসে। অন্যদিকে দ্বিতীয় কাহিনী অনুসারে গ্রিক রাজা ট্যান্টেলাসের পুত্র পেলপ যুদ্ধদেব এরিসের পুত্র অনোম্যানাসের বিরুদ্ধে নিজের জয়কে স্মরণীয় করে রাখা এবং দেবতাদেরকে ধন্যবাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে অলিম্পিক প্রতিযোগিতার প্রচলন করেন। তৃতীয় কিংবদন্তি অনুসারে দেবরাজ জিউস টাইটানদের নেতা ক্রোনাসের বিরুদ্ধে নিজের জয়কে উদযাপন করতে আরম্ভ করেন অলিম্পিক গেমস। 

অলিম্পিকের পুনর্জন্ম:

প্রাচীন গ্রিসে রোমানদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করলে ধীরে ধীরে অলিম্পিকের জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। মনে করা হয় ৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াস সমস্ত কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করলে অলিম্পিক প্রতিযোগিতা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। এরপর ১৮২১ সালে গ্রীস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের হাত থেকে মুক্ত হলে অলিম্পিক প্রতিযোগিতাকে পুনরুজ্জীবিত করার ধারণা জন্ম নেয়।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সমসাময়িককালে রচিত বিভিন্ন কবিতা এবং প্রবন্ধসমূহে অলিম্পিকের পুনরুজ্জীবনের দাবি জোরদার হতে থাকে। এরপর ১৮৫৯ সাল নাগাদ এক গ্রিক ধনকুবের ইভ্যাঞ্জেলোস জেপ্পাসের পৃষ্ঠপোষকতায় এথেন্স শহরের সিটি স্কোয়ারে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৭০ এবং ৭৫ খ্রিস্টাব্দে তার সংস্কারকৃত স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হয় আধুনিক অলিম্পিক গেমস। মনে করা হয় ১৮৯০ সালে অলিম্পিক সোসাইটি আয়োজিত অলিম্পিক গেমস দেখেই ব্যারন পিয়ের দ্য কুবেরত্যা আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা পান। 

আধুনিক অলিম্পিকের শ্রেণীবিভাগ:

সূচনা লগ্ন থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত যাত্রাপথে অলিম্পিকের সার্বিক চরিত্র বহুলাংশে বদলেছে। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক অলিম্পিক আয়োজিত হয়েছিল একেবারে সাবেকি ঘরানায়। তবে ১৯০০ সালে প্যারিস অলিম্পিকে মেয়েরা প্রথম অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মহিলা প্রতিযোগীদের এই অংশগ্রহণকে বৈপ্লবিক বললে অতিশয়োক্তি হয় না। এর কয়েক বছর পর বিভিন্ন শীতকালীন খেলা যেমন আইস হকি, স্কেটিং, স্কি ইত্যাদিকে অলিম্পিকের আওতাভুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রথম শুরু হয় শীতকালীন অলিম্পিক প্রতিযোগিতা বা উইন্টার অলিম্পিকস।

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের চ্যামনিক্সে প্রথম উইন্টার অলিম্পিকস আয়োজিত হয়। এর পরবর্তী কাল থেকে গ্রীষ্মকালীন বা সামার অলিম্পিকের মতন প্রতি চার বছর অন্তর উইন্টার অলিম্পিকসও আয়োজিত হয়ে থাকে। এগুলি ছাড়াও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ক্রীড়া প্রতিযোগীদের জন্য ১৯৬০ সালে ইতালির রোম শহরে প্রথম প্যারা অলিম্পিকের আয়োজন করা হয়। এগুলো ছাড়া অলিম্পিকের শ্রেণীতালিকায় নবতম সংযোজন হল যুব অলিম্পিক। মূলত ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী ক্রীড়াবিদদের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ২০১০ সালে মূল অলিম্পিক গেমসের সাথে যুব অলিম্পিকের সংযোজন করা হয়েছিল। 

বর্তমান অলিম্পিকের রীতিনীতি:

১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি বর্তমানে প্রতি চার বছর অন্তর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অলিম্পিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী সব ধরনের অলিম্পিক গেমসে অলিম্পিকের মূলনীতির প্রতিফলনকারী প্রতীক ব্যবহার করা হয়। এই প্রতীকটি বাংলায় অলিম্পিক বলয় বা অলিম্পিক নিশান নামে পরিচিত। এই প্রতীকে পাঁচটি বলয় একে অপরকে জড়িয়ে থাকে। বিভিন্ন বর্ণের এই পাঁচটি বলয় পৃথিবীর পাঁচটি অংশগ্রহণকারী মহাদেশকে নির্দেশ করে।

সর্বপ্রথম ১৯২০ সালে বেলজিয়ামের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পতাকা ওড়ানো হয়। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির উদ্যোগে অলিম্পিকের মূলনীতিকে স্বচ্ছভাবে তুলে ধরার জন্য গৃহীত হয়েছে একটি নীতিবাক্য: সিটিয়াস, অলটিয়াস, ফর্টিয়াস; যার অর্থ হলো দ্রুততর, উচ্চতর এবং শক্তিশালী। তাছাড়া প্রতিবছর অলিম্পিক শুরুর পূর্বে বেশ কয়েক মাস আগে প্রাচীন গ্রিক রীতি অনুসারে একটি অনুষ্ঠানে অলিম্পিয়াতে অলিম্পিক শিখা প্রজ্জলন করা হয়।

একজন মহিলা কলাকুশলী পূজারিনির বেশে এটি অধিবৃত্তাকার আয়নার সাহায্যে সূর্যরশ্মি সংহত করে প্রথম রিলে বাহকের জন্য এই অলিম্পিক মশাল প্রজ্জ্বলন করেন। এইভাবে শুরু হয় অলিম্পিক মশাল দৌড় আয়োজক শহরের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। এগুলো ছাড়াও ১৯৬৮ মেক্সিকো অলিম্পিক থেকে অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় মাস্কেট ব্যবহারেরও প্রচলন ঘটেছে।

অলিম্পিক ও ভারত:

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ভারতও প্রতিবছর অলিম্পিকে অংশ নিয়ে থাকে। প্রথম ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ঐতিহাসিক প্যারিস অলিম্পিকে ভারত অংশ নিয়েছিল। ভারতের পক্ষ থেকে অলিম্পিকে প্রথম পদকটি জয় করেন নরম্যান প্রিচার্ড। এরপর ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ভারত প্রথমবার নিজেদের দল পাঠায়। অলিম্পিকে এখনও অব্দি ভারতের অর্জিত পদক সংখ্যা মোট ৩৫। এগুলির মধ্যে দশটি স্বর্ণ, নয়টি রুপো, এবং ষোলটি ব্রোঞ্জ।

সম্প্রতি ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত টোকিও অলিম্পিকে ভারতের পক্ষ থেকে নীরাজ চোপরা জ্যাভলিন নিক্ষেপ প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জয় করেছেন। টোকিও অলিম্পিকে ভারত ইতিহাসের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পদক জয় করেছে। অলিম্পিকে ভারত পৃথিবীর প্রথম সারির দেশ গুলির মতন সাফল্য লাভ করতে না পারার অন্যতম কারণ হলো ভারতবর্ষের দারিদ্র্য এবং তুলনামূলকভাবে অবহেলিত ক্রীড়াক্ষেত্র। তবে ২০২১ সালে টোকিও অলিম্পিকে এই সাফল্যের পর আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে ভারত অন্যান্য অলিম্পিকে আরো বড় সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। 

উপসংহার:

আধুনিক বিশ্বে ক্রীড়া প্রতিযোগী তো বটেই এমনকি সাধারণ মানুষের কাছেও অলিম্পিক গেমস একটি আবেগের নাম। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক ক্রীড়ার এই মহাযজ্ঞ দুটি বিশ্বযুদ্ধের কারণে বন্ধ থেকেছে তিনবার, তবে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে শান্তির বার্তা নিয়ে আবার নতুন রুপে ফিরে এসেছে।

অলিম্পিক গেমস পৃথিবীর বেশিরভাগ অ্যাথলেটদের জন্যই সর্বোচ্চ সম্মানের আসন। নিজেদের সেরাটা নিয়ে তারা হাজির হন অলিম্পিকের মঞ্চে। আপন ক্রীড়াকৌশল প্রদর্শনের পাশাপাশি একজন অ্যাথলেটের কাছে অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারা নিজের দেশের জন্যও অত্যন্ত গৌরবের।


অলিম্পিক সম্পর্কে এই ছিল আমাদের উপস্থাপিত আজকের এই প্রবন্ধ। উপরিউক্ত প্রবন্ধটিতে অলিম্পিকের সম্ভাব্য সব ক’টি দিকের ওপর সীমিত শব্দের পরিসরে আমরা যথাসম্ভব বিস্তারিত রূপে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। আশা করি এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে। এই উপস্থাপনা সম্পর্কে যদি আপনাদের কোন প্রশ্ন কিংবা বক্তব্য থাকে তা নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।

ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন