মেঘনাদ সাহা রচনা [সঙ্গে PDF]

ভারতবর্ষের প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা একাধারে ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, চিন্তাবিদ তথা সক্রিয় রাজনীতিক। তার জীবন বিবিধ উল্লেখযোগ্য কর্ম দ্বারা মন্ডিত হয়ে আছে। একটি অত্যন্ত সামান্য পরিবার থেকে উঠে এসেও কিভাবে শুধুমাত্র নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জীবনে মহৎ কার্য সম্পাদন করা যায় মেঘনাদ সাহা ছিলেন তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তার মহান জীবনের ওপর একটি প্রবন্ধ দাঁড়া সামান্য আলোকপাতের দুঃসাহস নিয়েই এই প্রতিবেদনটির উপস্থাপনা।

মেঘনাদ সাহা রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

আমাদের দেশ ভারতবর্ষ সবসময়ই হলো জ্ঞান চর্চা এবং বিশ্ববরেণ্য নানা প্রতিভার বিকাশ ভূমি। সেই সুদূর অতীতকাল থেকেই ভারতবর্ষ একের পর এক নানা যুগান্তকারী প্রতিভার জন্ম দিয়ে এসেছে। একটা সময় পর্যন্ত ভারতবর্ষে জ্ঞানচর্চার হৃদয় ছিল বাংলা। বাঙালির শিরায় শিরায় তখন স্পন্দিত হত ভারতীয় ঐতিহ্য ও জ্ঞানচর্চার দ্যোতনা।

আমাদের মাতৃভূমি এই বাংলার বুকে যুগে যুগে এমন অসংখ্য তারকা’র আবির্ভাব হয়েছে যাদের হাত ধরে বাংলার গৌরব সমগ্র দেশ তথা বিশ্বে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলার এমনই অসংখ্য তারকাদের মধ্যে একজন ছিলেন মেঘনাদ সাহা। তিনি একাধারে ছিলেন ভারতীয় বাঙালি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, তথা জনপ্রতিনিধি। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন:

এফআরএস মেঘনাদ সাহার জন্ম ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই অক্টোবর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গে ঢাকা জেলার অন্তর্গত শেওড়াতলী গ্রামে। এই স্থানটি অধুনা বাংলাদেশের গাজীপুর জেলায় অবস্থিত। মেঘনাদ সাহা একটি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শ্রী জগন্নাথ সাহা পেশায় ছিলেন মুদি এবং অন্যদিকে মাতা ভুবনেশ্বরী সাহা একান্তই ছিলেন গৃহবধূ। মেঘনাদ সাহা ও আরো ৪ সন্তান নিয়ে ছিল তাদের পরিবার। ছেলেবেলায় অত্যন্ত কম বয়সে সমাজে জাতপাত গত শোষণের শিকার হওয়ায় তার মনে ব্রাহ্মণদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় মতাদর্শের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছিল।

শিক্ষাজীবন:

মেঘনাদ সাহার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল গ্রামের টোলে। এরপর তিনি নিজের গ্রাম থেকে ৭ মাইল দূরে শিমুলিয়ার মিডল স্কুলে ভর্তি হয়ে শেষ পরীক্ষায় ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সেখান থেকে তিনি ১৯০৫ সালে ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট বিদ্যালয়ে। তবে সেই সময় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ার কারণে তিনি বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হন। তখন পার্শ্ববর্তী কিশোরীলাল যুবিলী হাই স্কুলের একজন শিক্ষক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিনা বেতনে তাকে স্কুলে ভর্তি করে নেন।

এইখান থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে মেঘনাদ সাহা ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন এবং আইএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। স্কুলজীবন শেষ করে ১৯১১ সালে তিনি গণিতে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং দু’বছর পর সম্মানসহ স্নাতক ও ১৯১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিত ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি তার সমস্ত গবেষণা একত্র করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর কাছে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য আবেদন করলে দীর্ঘ পর্যালোচনায় পর তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে মেঘনাদ সাহা ডক্টর অফ সাইন্স ডিগ্রী লাভ করেন।

কর্মজীবন:

মেঘনাদ সাহার মতন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের জীবন স্বভাবতই কর্মময় হয়ে থাকে। নিজেদের কর্মের দ্বারাই তারা সমগ্র বিশ্বের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকেন। এই পংক্তিতে তাঁর কর্মজীবন বলতে বিশেষভাবে শিক্ষক জীবনের কথা বোঝানো হয়েছে। মেঘনাদ সাহার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে। তবে পরে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন।

এরপর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসে বিশেষ কারণবশত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এইখানে তিনি বিশেষ গবেষণার উদ্দেশ্যে একান্তই নিজের প্রচেষ্টায় একটি গবেষণার দল তৈরি করেন। তবে ১৯৩৮ সাল নাগাদ মেঘনাদ সাহা পুনরায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ফিরে আসেন। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করা আয়োনোস্ফিয়ার সংক্রান্ত গবেষণা কলকাতা ফিরেও তিনি বজায় রেখেছিলেন।

গবেষণা জীবন:

বিজ্ঞান পূজারী মেঘনাদ সাহা তার সমগ্র জীবন জুড়ে গবেষণা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড চালিয়ে গিয়েছিলেন। কর্মজীবনের শুরুর দিকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর গবেষণার মধ্যে দিয়ে তার গবেষক জীবন শুরু হয়। এরপর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অন হার্ভাড ক্লাসিফিকেশন অফ স্টেলার স্পেকট্রাম গবেষণার জন্য প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করে মেঘনাদ সাহা বিদেশে গবেষণার সুযোগ পান। ওই বছরই প্রথম পাঁচ মাস তিনি লন্ডনে এবং পরবর্তীতে বার্লিনে গবেষণা করেছিলেন।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাপীয় আয়নায়ন তত্ত্ব বিষয়ে তার গবেষণা পত্রটি সমগ্র বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করে। এরপর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গবেষণার বিষয় ছিল স্ট্যাটিসটিকাল মেকানিক্স, পরমাণু ও অনুর বর্ণালী, অনুর উষ্ণতা জনিত বিভাজন, উচ্চতর আবহমণ্ডল ইত্যাদি। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তনের পরে তিনি নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এবং পরবর্তীতে বায়োফিজিক্স নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন।

রাজনৈতিক জীবন:

মেঘনাদ সাহা শুধুমাত্র একজন অধ্যাপক কিংবা বিজ্ঞানীই ছিলেন না, একই সাথে তিনি ছিলেন একজন চিন্তাশীল সক্রিয় রাজনীতিবিদও। তার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে গান্ধীজীর মতাদর্শের বৈপরীত্য ছিল। তিনি ছোট শিল্পের তুলনায় বৃহৎ শিল্পকে অধিক গুরুত্বের সাথে বিচার করতেন।

সক্রিয় রাজনীতির পথে না এসেও যে দেশের জন্য কাজ করা যায়, তা তিনি রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশের পূর্বে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বড়দা শরৎ বসুর স্ত্রী বিভাবতী বসুর অনুরোধে ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্র থেকে বামপন্থী দলের সমর্থনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মেঘনাদ সাহা জয়লাভ করেন।

নানারঙে মেঘনাদ সাহা:

উল্লিখিত পরিচিতিগুলি ছাড়াও মেঘনাদ সাহার আরো বেশ কয়েকটি পরিচিতি ছিল। প্রথমত তিনি ভারতীয় পঞ্জিকার সংস্কারক হিসেবে অসামান্য অবদান রেখে গিয়েছেন। তার প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতে শকাব্দ অনুসারে বর্ষপঞ্জি চালু হয়। তাকেই পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত করে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ মেঘনাদ সাহা স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের একজন অন্যতম উল্লেখযোগ্য অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন।

তিনি এবং তাঁর সহপাঠী সত্যেন বোস যুব ভাবে সর্বপ্রথম অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সহ বিভিন্ন নিবন্ধ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। আইনস্টাইনের অসংখ্য প্রবন্ধ একটি সংস্করনের মধ্যে ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রিন্সিপালস অফ রিলেটিভিটি নামে প্রকাশিত হয়। এই অনূদিত গ্রন্থটিই হল বিশ্বে আইনস্টাইনের কোন রচনা প্রথম অনুবাদ।

সম্মাননা এবং পুরস্কার সমূহ:

সমগ্র কর্মজীবনে মেঘনাদ সাহা অসংখ্য পুরস্কার তথা সম্মাননা লাভ করেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তার পাওয়া লন্ডনের রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ। ১৯৩৪ সালে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাছাড়া ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তার প্রকাশিত গবেষণা পত্রটির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গ্রিফিথ প্রাইজে ভূষিত হন। তবে মোট ছয় বার তার নাম নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত হলেও তিনি নোবেল প্রাইজ পান নি। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয় নোবেল কমিটি মনে করেছিল মেঘনাদ সাহার কাজ পদার্থ বিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ হতে পারে, তবে নতুন কোনো আবিষ্কার নয়।

উপসংহার:

১৯৫৫ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে নিজের তৎকালীন কর্মস্থল রাষ্ট্রপতি ভবনের পরিকল্পনা কমিশনের দিকে যাওয়ার পথে হঠাৎ করে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভারতের এই প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে। পরের দিন কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। বাঙালি, ভারতবাসী তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে ঋণী চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন জীবনব্যাপী তার কর্মের দ্বারা। বিজ্ঞানের ইতিহাস যদি কোনদিন অক্ষর দ্বারা লিখিত হয় তাহলে সেই ইতিহাসে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।


আলোচ্য প্রতিবেদনটিতে মেঘনাদ সাহার জীবনের মোটামুটি সব ক’টি দিককে যথাযথ ও সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা নির্দিষ্ট শব্দসীমা বজায় রাখারও যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং তা প্রয়োজন অনুযায়ী আপনাকে সহায়তা করবে।

আমাদের এই দুঃসাহসিক প্রয়াসে কোন প্রকার ভুল ত্রুটি হলে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা আপনাদের সকলের কাছে নীচে কমেন্ট করবার আবেদন জানাচ্ছি। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।। 

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন