হযরত মুহাম্মদ রচনা [সঙ্গে PDF]

হযরত মুহাম্মদ ছিলেন ইসলাম জীবন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং ইসলাম ধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। ইসলামিক বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি আল্লাহ প্রেরিত শেষ নবী। অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের মতে তিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ তথা সামাজিক এবং ধর্মীয় নেতা। তারই মহান জীবনের ওপর বিন্দুসম আলোকপাতের অভিপ্রায় নিয়ে আমাদের আজকের প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

হযরত মুহাম্মদ রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

পৃথিবীতে যুগের বিবর্তন পথে কদাচিৎ এমন কিছু ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে যারা সমগ্র মানব সভ্যতার উপর অনন্তকালের জন্য সবিশেষ প্রভাব রেখে যান। মানুষ তাদের গ্রহণ করে নিজেদের জীবনের প্রধানতম পথপ্রদর্শক রূপে। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বা ইসলামিক বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের এমনই এক বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব।

প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত এই মানুষটি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রধান প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, এবং সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা। তার এই বহুমুখী বিশেষত্বের প্রধান কারণ হলো পার্থিব ও এবং আধ্যাত্মিক উভয় জগতেই লব্ধ চূড়ান্ত সফলতা। একজন অত্যন্ত সফল রাজনীতিক হিসেবে তিনি নিয়ত বিবাদমান আরব জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হন এবং সর্বোপরি সমকালীন বিশ্বে মানব জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তিনি অগ্রগণ্য।

জন্ম ও শৈশব:

প্রচলিত ইসলামিক ধারণা মতে মুহাম্মদ জন্মগ্রহণ করেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে আগস্ট। বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বনু হাশিম গোত্রে তার জন্ম হয়। তার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব মুহাম্মদের জন্মের ছয় মাস পূর্বে মারা যান এবং মা আমিনা তার ছয় বছর বয়সে আরওয়া নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন। জন্মের পর নবীর সম্পূর্ণ নাম ছিল মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম।

ছেলেবেলা থেকেই তার জীবনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অলৌকিক ও আধ্যাত্মিক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি প্রথমে তার পালিকা হালিমার কাছে, এবং পরে তার মা আমিনা, দাদা আব্দুল মুত্তালিব এবং সর্বশেষে দাদার পুত্র আবু তালিবের কাছে বড় হয়ে ওঠেন। শৈশবে তার উত্তম চরিত্র এবং সদাচরণের কারণে পরিচিত মহলের কাছে তিনি ‘আল-আমিন’ অর্থাৎ আস্থাভাজন এবং ‘আল-সিদ্দিক’ অর্থাৎ সত্যবাদী বলে সম্বোধিত হতেন।

নবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে:

ইসলামিক তথ্য অনুসারে মুহাম্মদের জীবনকে নবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে- এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রাথমিক জীবনে তরুণ বয়সে তিনি দক্ষ ভাবে ব্যবসা করে জীবনে সফলতা অর্জন করেন। এছাড়া আরবদের মধ্যে বিদ্যমান হিংস্রতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমনের জন্য প্রতিষ্ঠিত সংগঠন হিলফুল ফুজুলে যোগদান করে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।

নবুওয়াত লাভের পূর্বে জীবনের এই পর্বেই খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ-এর সাথে তার বিবাহ হয়েছিল। এরপর ৪০ বছর বয়সে আল্লাহর কাছ থেকে লব্ধ বাণী দ্বারা ওহি লাভের মাধ্যমে মুহাম্মদের নবুওয়াত প্রাপ্তি ঘটে। এই সময় তিনি প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকেই ধীরে ধীরে মুহাম্মদ ইসলামের প্রচারে গোপনে আত্মনিয়োগ করেন।

ধর্ম প্রচার:

নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকেই ধীরে ধীরে গোপন ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে মুহাম্মদ ইসলামকে আরবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাকে সমগ্র আরব সমাজে প্রচলিত বিশ্বাসের বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে। সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী মানুষ হলেন মহানবীর সহধর্মিণী খাদিজা।

নবুওয়াত লাভের বছর তিনেক পর থেকে মুহাম্মদ গোপনীয়তা ত্যাগ করে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াতে মানুষকে আহবান করেন। এতে বহু মানুষ যেমন রুষ্ট হন, তেমনি অনেকে আবার মুহাম্মদের অনুগামীও হন। ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে তা হল মুহাম্মদের চাচা হামজা এবং কুরাইশ নেতা ওমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ। আরবি সমাজে এরা প্রতিপত্তিশালী হওয়ায় ইসলামের প্রচার তুলনামূলকভাবে খানিকটা সহজ হয়। 

সংস্কারক হিসেবে মুহাম্মদ:

মুহাম্মদ একজন ধর্ম প্রচারক হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন একজন দক্ষ সমাজ সংস্কারক। আরবি সমাজে প্রচলিত নানা প্রকার যুগ বিরোধী নীতি তিনি ইসলাম দ্বারা বাতিল করে দেন। যেমন সমকালীন আরবে নিজের গোত্র ছেড়ে অন্য গোত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন বা যোগদান অসম্ভব হিসেবে পরিগণিত হতো। মুহাম্মদ এই নিয়ম বাতিল করে ইসলামের দৃষ্টিতে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্কার তৎকালীন সমাজে একটি বৈপ্লবিক চিন্তার জন্ম দেয়। অন্যদিকে মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তিনি একটি সনদের মাধ্যমে সকল মুসলিমদের মধ্যে রক্তারক্তি নিষিদ্ধ করেন। 

দক্ষ রাজনীতিক:

জীবনে ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি যে ভূমিকাটি মুহাম্মদ সবচেয়ে দক্ষভাবে পালন করেছিলেন সেটি সম্ভবত একজন সফল রাজনীতিবিদের। বিবদমান দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মদিনায় গমনের পর তিনি মদিনার সকল গোষ্ঠী কে নিয়ে ঐতিহাসিক মদিনা সনদ স্বাক্ষর করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই সনদ দ্বারা মুহাম্মদের নেতৃত্বে স্বাধীন মদিনা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

তবে মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মক্কার সাথে মুহাম্মদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। তবে এর পরবর্তী বেশ কিছু যুদ্ধের দ্বারা মক্কাতেও মুসলিমদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। মক্কা বিজয়ের পর পৃথিবীর বিভিন্ন সাম্রাজ্যের কাছে মুহাম্মদ ইসলামের বার্তা প্রেরণ করেন। সর্বোপরি মক্কাতে তিনি একটি সুসংহত রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেন।

ব্যক্তিগত জীবন:

নবুয়ত পূর্ব জীবনে যখন মুহাম্মদের খ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন মাত্র ২৫ বছর বয়সি মুহাম্মদের প্রতি মুগ্ধ হয়ে খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ তাকে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পরিবারের সম্মতি নিয়ে ৪০ বছর বয়সি খাদিজার সাথে ২৫ বছরের মুহাম্মদের বিবাহ হয়। খাদিজার গর্ভে এই দম্পতির ৬ সন্তান জন্মগ্রহণ করে যার মধ্যে চারজন কন্যা এবং দুই পুত্র।

মুহাম্মদের দুই পুত্রই শৈশবের মারা যান। তার কন্যাদের মধ্যে সবাই পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। খাদিজা নিজের আমৃত্যু ছিলেন মুহাম্মদের সহধর্মিনী। তার জীবদ্দশায় মহানবী নতুন কোনো বিবাহ করেননি। তবে মদিনা গমনের পূর্বে খাদিজার মৃত্যুর পর মুহাম্মদ বেশ কয়েকটি বিবাহ করেছিলেন। এদের মধ্যে আয়েশা ছিলেন মহানবীর সর্ব প্রিয়। 

অমুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিতর্ক:

অমুসলিমদের কাছে হযরত মুহাম্মদ বিভিন্ন রূপে পরিচিত। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মুহাম্মদকে একজন আদর্শ আইন নির্মাতা এবং মহামানব আখ্যা দিয়ে মুহাম্মদ এবং ইসলামের ভূয়শী প্রশংসা করেছিলেন। আবার অন্যদিকে বিভিন্ন অমুসলিমদের মধ্যে মুহাম্মদকে নিয়ে বিভিন্ন বিতর্কের আভাসও পাওয়া যায়। কেউ মনে করেন তিনি সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার বদলে পিছিয়ে দিয়েছিলেন।

আবার কেউ মনে করেন মুহাম্মদ প্রচলিত কুসংস্কার দূর করতে গিয়ে আরো অনেক কুসংস্কারের বীজ বপন করেছিলেন। তবে দৃষ্টিভঙ্গি ও বিতর্ক যাই হোক না কেন সমগ্র পৃথিবীর মানুষ এক বাক্যে একথা স্বীকার করে নেবে যে সমকালীন বিশ্বে মুহাম্মদ ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি আধ্যাত্মিক তথা রাজনৈতিক সমাজে নিজের ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। 

উপসংহার:

ইসলাম ধর্মে বিখ্যাত বিদায় হজ থেকে ফেরার পর হিজরী এগারো সালের সফর মাসে মুহাম্মদ ব্যাপক জ্বরে আক্রান্ত হন। এই সময় স্ত্রী আয়েশার গৃহে অবস্থানকালে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই জুন রবিবারে তার মৃত্যু হয়। যে স্থানে তিনি মারা যান জানাজার পর সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। এখনো মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে তার কবর রয়েছে। হযরত মুহাম্মদ ছিলেন ইসলাম তথা বিশ্বের ইতিহাসে একজন অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। যতদিন পৃথিবীতে সভ্যতার অস্তিত্ব থাকবে ততদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে তার নাম বিশ্বে উচ্চারিত হবে।


সংক্ষেপে এই ছিল হজরত মহম্মদের জীবনের ওপর সামান্য আলোকপাতের দুঃসাহসিক প্রয়াস। এই প্রবন্ধে মহানবীর জীবনের সবকটি দিকের ওপর সাধ্যমত আলোকপাতের চেষ্টা আমরা করেছি। আশাকরি, পরীক্ষার প্রয়োজনে নির্দিষ্ট শব্দসীমার বন্ধনীতে আবদ্ধ আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।

উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন