স্কুল জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা রচনা [সঙ্গে PDF]

স্কুল জীবন আমাদের জীবনের এক বিশেষ স্মরনীয় অধ্যায়। বিদ্যালয়ে কাটানো প্রতিটি দিনই আমাদের কাছে স্মরণীয় কিন্তু স্কুলজীবনে কাটানো এমন কিছু কিছু দিন থাকে যা কখনো ভোলার নয়। তেমনই একটি দিনের স্মৃতি নিয়ে আমাদের আজকের উপস্থাপন স্কুল জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা রচনা।

স্কুল জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা রচনা

ভূমিকা:

বিদ্যালয় হল আমাদের ছাত্র জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। জীবনের এই মানমন্দিরে আমরা বড় হয়ে উঠতে শিখি, পড়াশোনা শিখি, জীবনে লব্ধ অভিজ্ঞতাকে জীবনচর্যায় কেমন করে কাজে লাগাতে হয়, শিখি সেটাও। বিদ্যালয়ে সারা জীবনের মতন বিভিন্ন বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের পরম সখ্যতা গড়ে ওঠে, শিক্ষকদের সঙ্গে গড়ে ওঠে শাসন ও স্নেহের বন্ধন।

আর এই বিদ্যালয়েই তৈরি হয় জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান নানা স্মৃতি। বিদ্যালয় জীবনে হয়তো এই সব স্মৃতির মাহাত্ম্য সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করা যায় না; কিন্তু জীবনের মধ্যগগনে দাঁড়িয়ে যখন এই দিনগুলির দিকে মানুষ পিছন ফিরে তাকায় তখন সেই সব স্মৃতির কথা মনকে দোলা দিয়ে যায়।

সাধারণভাবে আমাদের সমগ্র বিদ্যালয় জীবন প্রায় ১২ বৎসরের। এই দীর্ঘ সময় জুড়ে আমরা অসংখ্য ছোট-বড় অভিজ্ঞতার সাক্ষী হই। আমার বিদ্যালয় জীবনের তেমনই একটি স্মরণীয় ঘটনার কথা বলার উদ্দেশ্যে আজকের এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা। 

আমার বিদ্যালয়:

আমি সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর এক ছাত্র। আমার বিদ্যালয়ে একটি স্মরণীয় ঘটনার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে আলোচনার পূর্বে এই বিদ্যালয়ের পরিচিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া প্রয়োজন। আশেপাশের অনেকগুলি গ্রামের মধ্যে আমাদের বিদ্যালয় বিশেষভাবে বিখ্যাত। আমাদের গ্রামের প্রান্তে একটি বড় মাঠের মাঝখানে বিদ্যালয়টি অবস্থিত। আমাদের স্কুলে মোটামুটি ৯০০ জন ছাত্র পড়াশোনা করে।

বিভিন্ন গ্রামের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করায়, ছেলেবেলা থেকেই আমরা প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পাই। আমাদের পড়ানোর জন্য স্কুলে মোট ৪৩ জন শিক্ষক ও শিক্ষিকা রয়েছেন। এছাড়া আমাদের স্কুলের গ্রন্থাগারটি এই জেলার মধ্যে অন্যতম বৃহৎ একটি গ্রন্থাগার। এমন একটি বিদ্যালয় সকল বন্ধুবান্ধব এবং শিক্ষকদের সাথে প্রতিদিনই আমাদের কোনো না কোনো স্মরণীয় মুহূর্ত তৈরি হয়।

বিদ্যালয়ের রোজনামচা:

আমি রোজ সকালে উঠে স্নান খাওয়া সেরে টিফিন নিয়ে দশটার মধ্যে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হই। তারপর সাড়ে দশটা নাগাদ সকলে মিলে বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে একসাথে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে প্রার্থনা সেরে যে যার শ্রেণিকক্ষে চলে যাই। তারপর দুইটি ক্লাসের শেষে আমাদের একটি কুড়ি মিনিটের ছোট্ট বিরতি হয়। সেই বিরতির সময় আমরা বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করি কিম্বা কখনো গ্রন্থাগারে গিয়ে সময় কাটাই।

এরপর আরো দুইটি ক্লাসের শেষে ৪০ মিনিটের বড় বিরতি। এই সময় আমরা বন্ধুদের সাথে খেলা করি, টিফিন খাই। আমাদের বিদ্যালয়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডের আগের ক্লাসটি শরীরচর্চা ও হাতের কাজ এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়।

ওই ক্লাসে কোন কোন দিন আমরা প্যারেড শিখি, ড্রিল মার্চ শিখি; কখনো বা আমরা শিখি কিভাবে বাগান পরিচর্যা করতে হয়, কখনো আমাদের শেখানো হয় কিভাবে মাটির পাত্র বানাতে হয় ইত্যাদি। বড় টিফিনের শেষে আরো চারটি ক্লাসের পর বিদ্যালয় থেকে আমাদের ছুটি হয়ে যায়। 

একটি স্মরণীয় শিক্ষা সফরের পরিকল্পনা:

এমন ভাবেই আমাদের বিদ্যালয়ের দিনগুলি ভালো-মন্দ নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছিল। আমরা যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন একদিন জানতে পারলাম বিদ্যালয় থেকে অষ্টম ও দশম শ্রেণির ছাত্রদের শিক্ষা সফর উপলক্ষে শান্তিনিকেতন নিয়ে যাওয়া হবে। আমাদের সকলের মন তো আনন্দে নেচে উঠলো। ইতিপূর্বে কখনো আমরা বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সফরে যাইনি।

তাছাড়া শান্তিনিকেতনের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে এর আগেই আমাদের ইতিহাসের শিক্ষক নির্মল স্যার  বিস্তারিতভাবে ক্লাসে বলেছিলেন। এছাড়া বিদ্যালয়ের স্পোর্টস ডে এবং ছোটখাটো বনভোজন ভিন্ন স্কুল থেকে বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে একসাথে কখনো আমরা বাইরে কাটাইনি। সেখানে আমাদের এই শিক্ষা সফর ছিল তিন দিনের। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে এই সফর সম্পর্কে দারুন উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছিল। 

সফরের প্রস্তুতি:

শিক্ষা সফরের ঘোষণার অব্যবহিত পরে যেসব ছাত্ররা এই সফরে যেতে ইচ্ছুক তাদের নাম সংশ্লিষ্ট শ্রেণি শিক্ষকদের কাছে নথিভূক্ত করতে হলো। তারপর একদিন শ্রেণি শিক্ষকরা সকল ইচ্ছুক ছাত্রের অভিভাবকদের নিয়ে একটি মিটিং-এ বসলেন। সেই মিটিং-এ আমাদের সম্পূর্ণ ভ্রমণ পরিকল্পনা সহ থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে শিক্ষকরা অভিভাবকদের অবহিত করলেন।

অভিভাবকদেরও কোন ছাত্রের কোন বিশেষ শারীরিক সমস্যা থাকলে জানাতে বলা হলো। দু সপ্তাহ পর এর একটি তারিখে আমাদের শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া স্থির হল। এরপরে রওনা হওয়ার আগে অবধি দিনগুলি শান্তিনিকেতনে বন্ধুদের সাথে কিভাবে কাটাবো সেই পরিকল্পনা করতে করতেই চোখের পলকে কেটে গেল। অবশেষে আমরা সেই সংশ্লিষ্ট দিনে ব্যাগপত্র গুছিয়ে সকাল সাতটার মধ্যে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে হাজির হলাম। 

দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়া:

শান্তিনিকেতন যাওয়ার জন্য দুইটি শ্রেণি মিলিয়ে মোট ১১২ জন ছাত্র নিজেদের নাম নথিভুক্ত করেছিল। আমাদের সাথে ১৫ জন শিক্ষকের যাওয়ার জন্য মোট তিনটি বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট দিনে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে বাসে চেপে আমরা গন্তব্য শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

বাসের মধ্যে সকল বন্ধুরা মিলে গল্প আনন্দ করতে করতে যাওয়ার মধ্যে যে কি অদ্ভুত অনুভূতি ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। হাইওয়ে দিয়ে দুপাশে ঘন জঙ্গলকে পাশ কাটিয়ে আমাদের বাস ছুটে চলল শান্তিনিকেতনের দিকে। অবশেষে বিকেল চারটে নাগাদ আমরা শান্তিনিকেতনে পৌঁছলাম।

সেইখানে হোটেলে গিয়ে সেই দিনটা বিশ্রাম নেওয়া স্থির হল। সেই দিন বিকেলে হোটেলে মালপত্র রেখে সকল বন্ধুরা মিলে শিক্ষকদের সাথে কাছেই নাম-না-জানা একটি নদীর পাড়ে খানিকক্ষণ বেরিয়ে আসা হলো। তারপর রাত নটার মধ্যে হোটেলে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

বন্ধু শিক্ষকদের সাথে কাটানো সময়:

পৌঁছানোর পরের দুই দিন আমি বন্ধু ও শিক্ষকদের সাথে অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছিলাম। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় গাছের তলায় মুক্ত শিক্ষাঙ্গন, রবীন্দ্র মিউজিয়াম, রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ইত্যাদি নানা জায়গা আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। সেইদিনই দুপুরের দিকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রমণ সেরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে আমরা কোপাই নদীর তীরে হাট দেখতে উপস্থিত হলাম।

সেখানে দেখলাম কত রকমের জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে, আরেক পাশে বাউল গান হচ্ছে; আর খানিকক্ষণ পরে পশ্চিমাকাশে দেখতে পেলাম ঘন লাল সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সে যে কি অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য বলে বোঝানো যায়না। এর পরদিন আমাদেরই বাসে করে আমরা দেখতে গেলাম কঙ্কালীতলা মন্দির ও দশ মাইলের জঙ্গল।

সেখানে দেখলাম মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে অজয় নদ। যদিও তার ধারা অত্যন্ত সরু হয়ে এসেছে, কিন্তু অস্তিত্ব এখনো বর্তমান। শিক্ষকদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম এই কঙ্কালীতলা হলো ভারতের ৫১টি সতীপীঠের একটি। সেই দিন বিকেল বেলা ভ্রমণ শেষে বাসে করে আমরা সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

ফেরার পথে বিপত্তি:

স্মরণীয় এমন একটি ভ্রমণ ছেড়ে ফেরার পথটিও আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিকেলবেলা আমরা যখন ফেরার উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম তার ঘন্টা খানেক পর মাঝরাস্তায় হাইওয়ের ওপর তিনটির একটি বাস হঠাৎ করে বিকল হয়ে গেল। আমরা সবাই বাসের ভিতরেই বসে রইলাম।

শিক্ষকরা বাস থেকে নেমে পরিস্থিতি দেখতে লাগলেন। নিকটবতী থানায় খবর দেওয়া হল। খানিকক্ষণ পর সেখান থেকে একজন পুলিশকর্মী এসে পরিস্থিতি নিরীক্ষণ করে মোটর মেকানিকদের খবর দিলেন। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমে আসায় আমরা সবাই শিক্ষকদের সাথে বাস থেকে নেমে পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে হাজির হলাম।

শিক্ষকদের থেকেই জানতে পারলাম এই গ্রামে সাঁওতাল জনজাতির মানুষের বাস। দেখলাম এই সকল মানুষের জীবন যাপনের ধারা আমাদের তুলনায় একেবারেই আলাদা। সেই ছোট্ট গ্রামে আমাদের সেখানকার মানুষ পরম আতিথিয়তার সঙ্গে আপ্যায়ন করল। সেইখানে প্রায় রাত হয়ে গেল।

ওই গ্রামেই গ্রামবাসীদের অনুগ্রহে আমরা রাতের খাবার খেলাম। ইতিমধ্যে খবর এলো আমাদের বিকল হয়ে যাওয়া সেই বাসটি ঠিক হয়ে গেছে। অবশেষে আমরা সবাই সেই ছোট্ট গ্রামটিকে বিদায় জানিয়ে বাসে এসে উঠলাম। প্রায় রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের বাস ছেড়ে দিল। এরইমধ্যে আমাদের ফিরতে দেরি হওয়ার কথা সকল অভিভাবককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরের দিন ভোর সাড়ে ছটায় আমরা পুনরায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ফিরে এলাম। 

উপসংহার:

এটি হলো এখনো অবধি আমার বিদ্যালয় জীবনে ঘটা সবচেয়ে স্মরণীয় একটি ঘটনা। সেই শিক্ষা সফরের অভিজ্ঞতা আমার মনে যে উপলব্ধি সৃষ্টি করেছিল এক কথায় তা অনবদ্য। জীবনে কখনো আমি এত সুন্দর ও পরিপূর্ণ একটি অভিজ্ঞতার সাক্ষী হইনি। হয়তো বিদ্যালয় জীবনের বাকি অংশে আমি আরো বিভিন্ন স্মরণীয় অভিজ্ঞতা লাভ করব। কিন্তু মনের স্মৃতিপটে বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সফরের এই অভিজ্ঞতাটির চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।


স্কুল জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান। আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম আমাদের কমেন্ট করে জানান। দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো। সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন