সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা [সঙ্গে PDF]

সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে মানুষের মন যতটা বিকশিত হয় ততটা বিকাশ লাভ আর কিছুতে হয় না। সাহিত্য পাঠের দ্বারা মনের আনন্দের সাথে সাথে বিশেষ জ্ঞানার্জন হয়ে থাকে আর এখানেই যেকোনো ভাষার সাহিত্যের সার্থকতা। তাই মানুষের জীবনে সাহিত্য পাঠের মূল্য অপরিসীম। এই নিয়েই আজকের উপস্থাপন সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা।

সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা  বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

সভ্যতার আদিমতম কাল থেকে মানুষের সৃষ্ট যে উপাদানগুলি পৃথিবীতে অনন্য এবং অভূতপূর্ব, তার মধ্যে একটি যদি হয় প্রযুক্তি তবে অবশ্যই অন্যটি হলো সাহিত্য। সাহিত্য হল মানব মনের সবচেয়ে সুস্পষ্ট দর্পণ। এই দর্পণে প্রতিফলিত হয় মানব জীবনের সকল অপূর্ণ ইচ্ছে, পেতে চাওয়ার বাসনা, আর সৃষ্টি করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। প্রযুক্তির মতন সাহিত্যকে কেউ বিজ্ঞানের যুক্তির বেড়াজালে বন্দী করে দেয় না।

সাহিত্য বাস্তব আর কল্পনার অদ্ভুত মিশেলে মনের ডানায় ভর করে পাতাললোক থেকে মহাশূন্য সর্বত্র নির্দ্বিধায় বিচরণ করে বেড়ায়। তাই যে মানুষ সাহিত্য পাঠ করে না সে সাহিত্যের এই অমৃতসুধা আহরণ থেকে বঞ্চিত থাকে। তার মন সাহিত্যের বাধাহীন ডানায় ভর করে  সৃষ্টির অনন্ত স্বাদ আস্বাদনের জন্য প্রস্ফুটিত হতে পারেনা। এই কারণে একজন মানুষের জীবনে সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম এবং এতটাই অধিক যে তাকে অন্য কোন কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না।

সাহিত্যের সংজ্ঞা:

সাহিত্যের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় লিখেছিলেন- ‘বস্তুত বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষা রচিত সেই চিত্র এবং গানই সাহিত্য।’

অর্থাৎ আমাদের চারপাশে বিরাজমান সৃষ্টির রূপ এবং মানুষের মনের ঐক্যবদ্ধ কলতানের বৈষয়িক বহিঃপ্রকাশই হলো সাহিত্য। সাহিত্য শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত উৎস হল ‘সহিত’ থেকে। সহিত বলতে বোঝায় সঙ্গ বা মিলন। অর্থাৎ প্রকৃতির সাথে মনের মিলনের ফলে প্রকাশিত ভাষাময় বৈষয়িক সৃষ্টির দ্বারা বিশ্ব সমাজের সাথে যোগসুত্র স্থাপন এর নামই হলো সাহিত্য।

অর্থাৎ সাহিত্য শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিক থেকেই মিলনের বার্তাবাহক। প্রকৃতির সাথে মনের মিলন এবং ভাবের সাথে সমাজের মিলন- এই দুয়ের পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেই সাহিত্যের প্রকৃত সার্থকতা।

সাহিত্যের বিস্তৃতি:

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যুক্তি কিংবা বিজ্ঞানের বেড়াজালে সাহিত্যকে আটকে রাখা যায় না। সাহিত্য মনের ডানায় ভর করে দিগন্ত থেকে দিগন্তে নিজের দুবাহু প্রসারিত করে আনাগোনা করে। সেজন্যেই সাহিত্যের বিস্তৃতি হলো বহুমুখী। পৃথিবীতে এমন কোন বিষয় নেই জানিয়ে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচিত হয়নি।

সকল বিষয়ের সঙ্গে মনের যে যোগ, মানুষ সেই সংযোগকেই সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। সেজন্য সাহিত্যের আনাগোনা শূন্য থেকে অসীমে। আর এই ব্যাপক বিস্তৃতির কারণেই মানব মনের অন্তস্থলকে সাহিত্য প্রসারিত করতে পারে। শরীরের মাংসপেশিকে যেমন শরীরচর্চার দ্বারা শক্তিশালী করে তোলা যায়, তেমনি সাহিত্যচর্চা দ্বারাও মানসিক শক্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে নেওয়া যায়। 

সাহিত্যে শাশ্বত উপলব্ধি:

সাহিত্য পাঠের ফলে মানুষের মন শাশ্বত অনুভূতিতে পূর্ণ হতে পারে। শাশ্বত হল সৃষ্টির সেই অনন্ত সুন্দর অনুভূতি যাকে বিজ্ঞান দ্বারা প্রমান করা যায়না, যুক্তি দ্বারা খন্ডন করা যায় না, প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না- কিন্তু সাহিত্যের দ্বারা অনুভব করা যায়। মানুষের মন সর্বদা সৃষ্টির দুর্নিবার রহস্যকে উপলব্ধি করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে।

নিজের চারপাশের প্রকৃতির সাথে মনের সেই উন্মুখ কল্পনার মিশেল ঘটিয়ে সৃষ্টি হয় সাহিত্য। সেই কারণে সাহিত্য যে প্রকারেরই হোক না কেন তা সর্বদা সামাজিক। কারণ আমাদের চারপাশের সমাজ সৃষ্টিরই সমষ্টিগত রূপ। মানুষ সাহিত্যের দ্বারা সৃষ্টির সেই রূপকেই ছুঁয়ে দেখতে চায়। সেজন্য সাহিত্য পাঠ করলে মানব মনের সাথে অনন্তের মিলনের যে রূপ, তার শাশ্বত অনুভূতি ঘটে।

আত্মোপলব্ধিতে সাহিত্য:

আমাদের এই প্রবন্ধের সূচনালগ্নেই উল্লেখ করা হয়েছে সাহিত্য হল মানব মনের সবচেয়ে স্পষ্ট দর্পণ। সেই দর্পণে ধরা পড়ে মনের নগ্ন রূপটি। এই নগ্নতা বলতে মনের বাহ্যিক অবকাঠামো ভেঙ্গে অন্তরের অন্তস্থলের রূপকে বোঝানো হয়।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাশ্বত সৃষ্টির সাথে মনের যখন মিলন ঘটে তখন সেই মিলনের ফলে সাহিত্যের পাঠকের কাছে আপন আত্মার প্রকৃত স্বরূপ পরিস্ফুট হয়ে যায়। পরম ব্রহ্মের সাথে আত্মার এইরূপ মিলনের ফলে সাহিত্যের পাঠকের অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত হয় এবং আত্মোপলব্ধি ঘটে। পৃথিবীর অন্য কোন ধরনের চারুকলাতে এই প্রকার বিনোদন এবং আত্মোপলব্ধি একইসঙ্গে ঘটতে পারে না। 

সাহিত্যে সমাজচিত্রের রূপায়ণ:

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে সৃষ্টির সমষ্টিগত রূপ হল সমাজ। মানুষ সাহিত্যের দ্বারা সেই সৃষ্টির সাথেই মনের মিলন ঘটাতে চায়। সেজন্য সবসময়ই সাহিত্যে সমাজের রূপ ধরা পড়ে। বলা হয় যে, কোনো সমাজ যে রকম, সেই সমাজের সৃষ্ট সাহিত্যও ঠিক সে রকমই হয়। সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রকৃত রূপ ফুটে ওঠে সেই সমাজের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্যে।

তাই কোন সমাজ কিংবা কোন যুগের সমাজকে প্রকৃতরূপে চেনার জন্য সেই সমাজের সাহিত্য পাঠ একান্ত প্রয়োজনীয়। সমাজের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, অর্থনৈতিক অবস্থা, দুর্যোগ, দুর্দশা সবকিছু সাহিত্য বিশ্বের দরবারে আপন ভাষার বন্ধনী দ্বারা তুলে ধরে। সাহিত্যের মাধ্যমেই সমাজের সকল অন্ধকার দিকের উপর আচ্ছাদিত আবরণ উন্মোচিত হয়। তাছাড়া এই সাহিত্যের দ্বারাই বহির্জগতের আলো সমাজে প্রবেশ করে। সেই আলোতে চিরাচরিত অচলায়তন ভেঙে নতুন উদ্যমে নতুন সমাজ গঠিত হতে পারে। 

সভ্যতা এবং সাহিত্য:

সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষের জীবনের ভোগমুখী কর্মব্যস্ততা সাহিত্য সৃষ্টি এবং সাহিত্য পাঠের প্রাসঙ্গিকতাকে বারবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। আধুনিক যুগে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে আরো অধিক মাত্রায়। অনেকে মনে করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং সাহিত্য সমাজকে অযথা কল্পনামুখী করে তোলে।

কিন্তু এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে সভ্যতা আপন স্বরূপ সম্পর্কেই বোধহীন এবং উদাসীন; তার অগ্রগামিতা পশ্চাৎ গতির সমার্থক ভিন্ন অন্য কিছুই নয়। সেজন্য সমাজে বিজ্ঞানের যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি সমানভাবে প্রয়োজন আছে সাহিত্যের। তবে সাহিত্য চর্চার জন্য চাই অবকাশ।

বর্তমান যুগের বহুমুখী ভোগমূলক জীবনে সেই অবকাশেরই অভাব ঘটছে। তাই মনে রাখার সময় এসেছে যথাযথ অবকাশ সৃষ্টি করে বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্যের সুষম চর্চার মধ্যেই সভ্যতার প্রকৃত সার্থকতা লুকিয়ে আছে।

মনের স্বাস্থ্যবিধানে সাহিত্যপাঠ:

শরীরকে সুস্থ এবং রোগমুক্ত রাখার জন্য আমরা যেমন নিয়মিত সুষম খাদ্য এবং পানীয় গ্রহণের দ্বারা শরীরকে সতেজ রাখার চেষ্টা করি, তেমনি একটি সুস্থ ও সতেজ মনের প্রয়োজনেও মনেরও সুষম খাদ্য উপাদান দরকার। সাহিত্য আমাদের মনের সেই উৎকৃষ্ট খাদ্য উপাদানের যোগান দেয়। সাহিত্য ছাড়া মন আত্মবিমুখ হয়ে পড়ে।

একটি আত্মবিমুখ মন শরীরের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যও উপযোগী হতে পারে না। সাহিত্য মনের সব দরজা জানালা খুলে দিয়ে বাইরের মুক্ত বাতাস মনের আঙিনায় প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়। ফলে মন সতেজ এবং ফুরফুরে হয়ে ওঠে। এইখানেই একটি সুস্থ মনের বিধানে সাহিত্য পাঠের সার্থকতা।

জ্ঞানার্জন:

সাহিত্য পাঠকে যদি নেহাতই মনের খাদ্য কিংবা ব্যায়াম বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে বিশেষভাবে ভুল করা হবে। সাহিত্যের বিস্তৃতি শূন্য থেকে অসীমে হওয়ার কারণে সাহিত্যের মধ্যে প্রতিফলিত হয় মহাবিশ্বের জ্ঞানের রত্নভান্ডারও। এক্ষেত্রে প্রথমেই মনে রাখা উচিত জ্ঞান হলো সম্পূর্ণরূপে একটি মানসিক সত্তা। প্রকৃতির সাথে মনের সঠিক মনন ঘটলে অন্তরে জ্ঞানের উন্মোচন ঘটে। সাহিত্যের মাধ্যমে সেই মনন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। তাই বলা যায় মনের অন্তঃস্থলে সুপ্ত জ্ঞান সাহিত্য পাঠের দ্বারাই পূর্ণতা পায়।

দূর্গম পৃথিবীর সংবাদ লাভ:

মানুষের স্বভাবগত প্রকৃতি হল অদেখাকে দেখা, অজানাকে জানা এবং অচেনাকে চেনার অদম্য ইচ্ছা।  কিন্তু মানুষ তার এক জীবনে এই বিশাল বিশ্ব প্রকৃতির সবটুকুকে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। কেবলমাত্র সাহিত্যের মাধ্যমেই পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে বসে সমগ্র পৃথিবীর পূর্ণ অনুভূতি লাভ সম্ভব হতে পারে।

যেহেতু সাহিত্য হলো সমাজের সুস্পষ্ট প্রতিফলন তাই কোন সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে সেই সাহিত্য রচনাকালে সমাজের পটচিত্রকে বোঝা যায়। সাহিত্যের মধ্যেই ধরা পড়ে পৃথিবীর দুর্গমতম প্রান্তের দুষ্প্রাপ্য সংবাদ। তাই বিশ্বদর্শনের অদম্য আকাঙ্ক্ষাকে সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়।

সাহিত্য পাঠের মূল্য:

মানুষের জীবনে সাহিত্য পাঠের মূল্য অপরিসীম। বিভিন্ন যুগের সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে অতীতের সাথে বর্তমানের যে যোগসুত্র রচিত হয় তার মধ্যে দিয়ে মানুষ নিজের ঐতিহ্য এবং ইতিহাসকে মনে রাখে। কথায় বলে সবকিছু হারিয়ে গেলেও কাহিনী কোনদিন হারিয়ে যায় না। সেই কাহিনীর মধ্যে দিয়েই ইতিহাস তার গল্প বলে যায়।

সাহিত্য পাঠের দ্বারা ইতিহাসের সাথে বর্তমানের সেতু রচিত হলে সেই সূত্র সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী হয়। একটি সমাজ আপন ইতিহাস ও ঐতিহ্য দ্বারাই ঐক্যবদ্ধ থাকে। সাহিত্য সমাজের ঐক্যের ক্ষেত্রে ইতিহাসের সুতো বাধার কাজ করে। অন্যদিকে সাহিত্যপাঠ মাধ্যমে ব্যক্তি মানুষের চরিত্র গঠন করে তাকে সমাজজীবনে বসবাস এবং সমাজ গঠনে অবদান রেখে যাওয়ার জন্য উপযোগী করে তোলে।

উপসংহার:

বর্তমানকালের ভোগবিলাস মূলক জীবনে সাহিত্য পাঠের প্রাসঙ্গিকতা প্রতি মুহূর্তেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও সেই চ্যালেঞ্জ অতিক্রান্ত হচ্ছে অত্যন্ত সহজেই। মানুষের জীবন থেকে যখন সবকিছু হারিয়ে যায়, যখন মানুষ মানসিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যায় তখন যা মানুষের কাছে পড়ে থাকে তাহলে তার চিন্তা।

এই উৎস থেকেই রচিত হয় সাহিত্য। তাই সাহিত্য হল মানুষের জীবনের পরম সঙ্গী, যে সঙ্গী চরম দুর্দিনেও মানুষকে ছেড়ে যায় না। আর মানুষ নিজের ইচ্ছে মতন মহামূল্যবান রত্নের আকর এই সাহিত্য ভান্ডার থেকে নিজের বাঁচার রসদ সংগ্রহ করে বিশ্বময় ভোগবিলাসের একাধিপত্যে একরাশ প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে।


সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার।এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন