শীতের সকাল রচনা (Siter Sokal Rachana in Bengali) [সঙ্গে PDF]

প্রতিটা সকাল জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। রাত্রির নিস্তব্ধতাকে কাটিয়ে শুরু হয় ব্যাস্ত জীবনের আরও একটি নতুন দিন। ঋতু বিশেষে সকালের পরিবেশটা হয় ভিন্ন। শীতের সকাল বললেই প্রকৃতির রূপের এক অন্য চিত্র ভেসে উঠে আমাদের কল্পনায়।গ্রামের শীতের সকাল ও শহরের শীতের সকালের পরিবেশটা একবারেই ভিন্ন। ধনী মানুষদের কাছে এই সকালটা এক রকম ও দরিদ্র অসহায় মানুষদের জন্য অন্য রকম।এই সব কিছুকে তুলে ধরে আজকের বিষয় শীতের সকাল রচনা।

শীতের সকাল রচনা বৈশিষ্ট্য ছবি

ভূমিকা:

ছয়টি ঋতুর ভিন্ন ভিন্ন রঙে রঙিন আমাদের প্রিয় দেশ। কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময়ই গরমে আমাদের জীবন কাটে। মাত্র দু তিন মাসের জন্য আমাদের বাংলার বুকে নেমে আসে এক আশ্চর্য শীতলতা।

হেমন্তের অন্তে শীতের কোমল ছোয়া লাগে সর্বত্র। পৌষ, মাঘ মাসে কয়েকদিনের জন্য শীতের প্রবল প্রকোপ পড়ে, আর সেটার টের পায় আমরা শীতের সকালে। শীতের সকাল থাকে শীত এবং কুয়াশার চাদরে ঢাকা।

সবকিছু খুব ঘোলা দেখায়। ঘাস ভেজা থাকে শিশিরে। সূর্য উঠলে শিশির ফোঁটা মুক্তোর মতো ঝরঝরে হয়। দরিদ্র লোকেরা প্রচণ্ড গরমে খড় জড়ো করে এবং আগুন জ্বালায়। প্রাণীগুলিও অসহায় হয়ে পড়ে। তারা নিজেকে ঘরের কোণে লুকিয়ে রাখে এবং বাইরের ঠাণ্ডা থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে।

শীতের সকাল মানুষের মনের মধ্যে এক বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি করে। কুয়াশায় ঢাকা চারপাশে তাকালে মন কেমন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। শীতকালে আমরা একটু কাবু হয়ে পড়লেও এই শীতের সকালের রয়েছে এক অপরূপ রূপ। রাত্রির কালো পর্দা সরিয়ে এক রৌদ্র দীপ্ত সোনালী দিন উপহার করে শীতের সকাল।

শীতকালের বৈশিষ্ট্য:

ছয়টি ঋতুর পঞ্চম ঋতু হলো শীতকাল। বসন্তের পূর্বে চারিদিকে কুয়াশার চাদরে মুড়ি দিয়ে আসে শীত। বাংলা বর্ষপুঞ্জি অনুযায়ী পৌষ ও মাঘ হলো শীতকাল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত শীতকালের প্রকপ থাকে সব থেকে বেশি। তবে বাস্তবে নভেম্বর থেকেই শীতকাল অনুভূত হতে থাকে।

শহর অঞ্চলের আগে দেশের গ্রামীন অঞ্চলে আগে শীত নামে। শীতকাল সাধারণত শুষ্ক থাকে, তবে কখনো কখনো হালকা ধরণের বৃষ্টিপাত হয় কিছু কিছু জায়গায়। এছাড়াও শীতকালে রাত্রি থাকে দীর্ঘ।

এসময়ের গড় তাপমাত্রা থাকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। দেশের উত্তরাঞ্চলে কোনো কোনো বছর প্রবল শৈত প্রবাহ দেখা যায়, এতে অনেক সময় প্রাণহানীও ঘটে।

শীতের সকাল:

শীতকালে চারদিক ছেয়ে যায় ঘন কুয়াশায়। কখনো কখনো কুয়াশার চাদর এতো ঘন হয়ে যায় যে যে সূর্যের আলো পর্যন্ত পৃথিবীর মাটিতে এসে পৌছাতে পারেনা। ফলস্বরূপ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। এবং এটি মানুষের অনেক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কখনো কখনো সারা দেশে শৈত প্রবাহ বয়ে যায়। বাচ্চারা ঠান্ডা থেকে মুক্তি পেতে রোদের মধ্যে খেলা করতে বের হয়। শিশির ফোঁটা ঘাসের উপর পড়ে এবং পাতাগুলি সকালের রোদের রশ্মিতে মুক্তোর মতো দেখায়।

এই দৃশ্য পৃথিবীকে দেয় নতুন প্রান। খেজুর রস বিক্রেতারা ঘরে ঘরে খেজুর রস বিক্রি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যান্য ঋতুর তুলনায় শীতের দিন সময়ের বিচারে বেশ ছোটো। শীতকালে রাত ফুরিয়ে সকাল হয় একটু দেরিতে আবার সন্ধ্যাও নামে খুব তাড়াতাড়ি।

দুপুরের রোদ বিকেলে কমে যাওয়ায় সাথে সাথেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসে আর সেই সাথে বাড়তে থাকে ঠান্ডা। এজন্য কবি বলেছেন,

“হিম হিম শীত শীত।শীত বুড়ি এলো রে,
কনকনে ঠান্ডায় দম বুঝি গেলো রে।”

বইএর টেবিলে বসে পড়ার ইচ্ছে করেনা, চাদরের বাইরের হাত বের করে অঙ্ক কষার চেয়ে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ার মধ্যেই সুখ খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে লেপের তলায় ঘুম, আর একটি নতুন সকালের আসন্ন প্রত্যাশায় মনে হয় রাতটা দীর্ঘতর হোক।

শুধু তাই নয় পশুপাখিরাও অলস দিন কাটায়। তারা শীত থেকে বাঁচতে সারাদিন লুকিয়ে থাকে তাদের ঘরে, কুকুর, বিড়াল ছানারা মানুষের বাড়িতে গিয়ে গরম স্থান খুঁজে সেখানে নিজেদের লুকিয়ে রাখে। শীতকালে সারাদিন কিঞ্চিৎ আলস্যতায় কাটে। প্রকৃতির চেয়েও শীতের সকালে মানুষের কাছে শীতের অনুভূতিটাই বড়ো হয়ে দেখা যায়।

শীতের সকালের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য:

অন্য আর পাঁচটি ঋতুর সকালের চেয়ে শীতের সকালের বিশেষত্ব একটু ভিন্ন প্রকৃতির।শীতের সকালে মাঠ ঘাট দিগন্ত সাদা কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে।খুব সকালে সূর্য ওঠার পরও রোদ্দুর কুয়াশার চাদর ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে পারেনা।

কবি সুকান্ত বলেছেন,

“হে সূর্য! শীতের সূর্য,
তুমি আমাদের স্যাত স্যাতে ভিজে ঘরে।উত্তাপ আর আলো দিও,
আর উত্তাপ দিও,রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটাকে।”

শিশিরে ভেজা মাঠের ঘাস গুলো, গাছ পাতা সব হিহি করে কাঁপতে থাকে উত্তুরে হিমেল বাতাসের হাড় কাঁপানো শীতে। কুয়াশার চাদর সরিয়ে অফুরন্ত রোদ্দুর যখন উকি মারে তখন প্রকৃতি ধারণ করে ভিন্ন রূপ।

কুয়াশায় খুব কাছের বস্তুও দেখা যায়না, সব কিছু ঢেকে যায়। টিনের চাল, গাছের ডাল কিংবা পাতাতে টপ টপ করে শিশির ঝরতে থাকে। পাখিদের কিচিরমিচিরও তেমন শোনা যায়না। খেজুরের রশের মিষ্টি গন্ধে সকলের ইচ্ছা হয় সকাল সকাল ভাপা পিঠা কিংবা চিতই পিঠা দিয়ে নাস্তা করতে।

গাছের পাতারা বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে শীতকালে। বাতাসের শুষ্কতার সাথে সাথে মানুষের মনও বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে সকাল হলেই দেখা যায় খেজুরের রস আহরণের সুন্দর দৃশ্য। সেই রস বাসায় আনার পর বাড়ির মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে পিঠা বানাতে। শীতের সকালে চাষিরা মাঠে যায় পান্তা ভাত খেয়ে। এজন্য কবি বলেছেন,

“হে সূর্য! শীতের সূর্য,
তুমি আমাদের স্যাত স্যাতে ভিজে ঘরে।উত্তাপ আর আলো দিও,
আর উত্তাপ দিও,রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটাকে।”

শীতের সকালের এই পরিবেশকে আরও রঙিন করে সাজিয়ে তোলে গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্র মল্লিকা ফুলের ঝকঝকে হাসি।

গ্রামীণ জীবনে শীতের সকালের প্রভাব:

শহর ও গ্রামে শীতকালের ভিন্ন রূপ দেখা যায়। শীতের সকালের তাৎপর্য সত্যিকারের গ্রামীন জীবনেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। গ্রামে গ্রামে শীতের সকালের আর এক আকর্ষণীয় উপকরণ হল খেজুর রস।

সারারাত ধরে খেজুর রস জমা হয় হাঁড়িতে। যেমন তার স্বাদ তেমনই শীতলতা। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখা যায় বাড়ির ছেলেমেয়েরা খড়-গাদা পুড়িয়ে নিজেদের শরীরকে গরম করছে, বাড়ির মায়েরা চালের গুড়ি আর খেজুরের রসের পাতালি গুড় দিয়ে নাস্তা বানাচ্ছে।

শীতের সময়ে কৃষকের কুটিরের দরজায় দাঁড়ালে দেখা যায়, ভোর হতে হতেই গরম বিছানার সুখ ছেড়ে তারা কাজে হাত লাগিয়েছে। সকাল হতেই কৃষক চলে মাঠে,আর গৃহস্থালির কাজে হাত লাগায় গৃহবধূ। আর ছোট ছোট বাচ্চারা আঙিনায় বসে আছে রোদের অপেক্ষায়।

দরিদ্র পরিবারগুলোতে গরম কাপড়ের অভাবে শিশুরা হাত পা কাচুমুচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আগুনের কাছে। ঠান্ডার প্রকোপ শহর থেকে গ্রামে বেশি থাকায় এখানের জনমানবের জীবনে নানারকম দূর্ভোগ নেমে আসে শীতকালে।

কোথাও আবার চলে বৈষ্ণবের আখরা , খোল করতাল বাজিয়ে প্রভাতী নাম সংকীর্তন।গঞ্জের ঘাটে তখনও নৌকার পাটাতনে অকেজো হয়ে পড়ে থাকে দাঁড় ও পাল শিশির কুয়াশায় সিক্ত হয়ে।

শহুরে জীবনে শীতের সকালের প্রভাব:

গ্রামের থেকে শহরে ঠান্ডার প্রকোপ একটু কম। সকাল হতেই দেখা যায় ব্যালকনিতে খবরের কাগজ আর চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে বাড়ির কর্তারা। শিশুদের তাড়া থাকে না সকালে উঠে স্কুলে যাওয়ার।

শহরের ইটের দালানগুলো শীতের সকালকে উপভোগ্য করে তোলে না। এখানে গ্রামের মত খেজুরের রস, পিঠার গন্ধ নাকে এসে পৌঁছাতে দেয়না ডিজেল, পেট্রোলের গন্ধ। সকাল হলে অনেকেই হাঁটতে চলে যায় কাছের কোনো পার্কে। সেখানে বেঞ্চে বসে শহরের কুয়াশাকে উপভোগ করে অনেকেই।

বাজারে সবজি ব্যাবসায়ীরা শাক সবজি সাজিয়ে বসে পড়ে সকাল সকাল। ভোরেই উনুনে আগুন দেওয়া হয় চায়ের দোকানে।তেলেভাজার দোকানের পাশে চপ,বেগুনি,কচুরির গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

রাস্তার ধারে আগুন জ্বালিয়ে হাত পা গরম করে গরম পোশাক না থাকা ফুটপাত বাসীরা। মধ্য বিত্তেরা থলি হাতে নিয়ে সকাল সকাল রওনা হয় বাজারে।স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের রাস্তায় মাঠে হাঁটতে ও ব্যয়াম করতে দেখা যায়। ধনী অভিজাত বাড়িতে শীতের সকালের এক অন্য রূপ।

শীতের খাবার:

শীত মানেই খেজুরের রস দিয়ে বানানো নানা জাতের পিঠা। পিঠাপুলির দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। গাঁয়ের প্রতিটি ঘরে ঘরেই সকাল হওয়ার সাথে সাথে নানা জাতের পিঠা বানানো শুরু হয়।

মেয়েরা তাদের কুশলতার পরিচয় দেয় রস পিঠা, তেলের পিঠা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপতা, ঝাল পিঠাসহ আরো নানা জাতের পিঠা বানানোর মাধ্যমে। এসময় অনেক জাতের শাকসবজি চাষ করে গ্রামের কৃষকেরা। বরই, কমলালেবু, মাল্টা এগুলো শীতকালের ফল।

উপসংহার:

সময় বহমান। সে কারো জন্যে থেমে থাকে না। খুব জলদি সকাল ফুরিয়ে আসে দুপুর। শীতের ছোটো বেলায় দুপুর শেষ হতে না হতেই নেমে আসে অন্ধকার। তখন আবার এক রোদ ঝলমলে সোনালী সকালের প্রতীক্ষা।

প্রত্যেক ঋতুর সকালের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। শীতের সকাল অন্য সব ঋতুর চেয়ে সেরা বলা না গেলেও,কিন্তু শীতের সকালের আবেদন যে অন্যান্য ঋতুর তুলনায় স্বতন্ত্র তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।


শীতের সকাল প্রবন্ধ রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান। আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান। দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো। সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

“শীতের সকাল রচনা (Siter Sokal Rachana in Bengali) [সঙ্গে PDF]”-এ 5-টি মন্তব্য

Rik Mishra শীর্ষক প্রকাশনায় মন্তব্য করুন জবাব বাতিল