লকডাউনে কমলো দূষণ রচনা [সঙ্গে PDF]

২০২০ সালে করোনা মহামারীকে প্রাথমিক পর্যায়ে রোধ করার জন্য বিশ্বব্যাপী সকল দেশজুড়ে জারি হয়েছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন। এই লকডাউন বিশ্ব অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি করলেও বেশকিছু সুপ্রভাব গিয়েছিলো পৃথিবীর পরিবেশের উপর। বিশ্বজুড়ে নিরন্তর বেড়ে চলা বিভিন্ন প্রকার দূষণের মাত্রা এই লকডাউন এর ফলে অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল। লকডাউনে কিভাবে কোন আশ্চর্য উপায়ে পরিবেশ দূষণ এভাবে কমে গেল, সেই রহস্য উদঘাটনের নিমিত্তই আমাদের এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

লকডাউনে কমলো দূষণ রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

২০২০ সালটি বিশ্বের সবার কাছে একটি অভিশপ্ত বছর হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই বছরে অন্যান্য সকল দুঃসংবাদকে অতিক্রম করে বছরটির শীর্ষক রূপে জায়গা করে নিয়েছিল করোনা মহামারী। কোন এক অজানা অচেনা ভাইরাস এসে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিল সমগ্র বিশ্বের জীবনযাত্রা। তবে সকল খারাপ জিনিসেরই কোন না কোন একটি ভালো দিক থাকে।

এই করোনা মহামারী এবং তার অনিবার্য ফলবশত লকডাউনও এই চিরসত্যের ব্যতিক্রম নয়। লকডাউনের ফলে আমরা দেখেছি বিশ্বজুড়ে প্রকৃতির সেই নির্মল পরিবেশ আবার ফিরে আসতে, শহরের আনাচে-কানাচে শোনা গেছে পাখিদের কুজন। এক অজানা ভাইরাসের বিষ-বাষ্প বিশ্বজুড়ে বিরাজমান থাকলেও মানব সমাজ ক্ষণিকের জন্য হলেও মুক্তি পেয়েছে দূষণের বিষবাষ্প থেকে। 

বিশ্বব্যাপী মহামারী এবং লকডাউন:

করোনাভাইরাস পৃথিবীর বিজ্ঞানীমহলে একেবারে নতুন না হলেও এর আবির্ভাব লগ্নে ভাইরাসের এই নির্দিষ্ট প্রকারটি বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত ছিল না। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ভাইরাসঘটিত ব্যাধি কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করার উপায় নির্ণয়ও মোটেই সহজ ছিল না। বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসের ছোঁয়াচে প্রকৃতির কথা মাথায় রেখে বিজ্ঞানীদের কাছে সেই সময় এই ভাইরাসের প্রভাবকে রোধ করার একমাত্র উপায় ছিল লকডাউন।

বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই কারণে সমগ্র বিশ্বজুড়ে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য জারি করেছিল দেশব্যাপী ব্যাপক লকডাউন। বারবার বলা হয়েছিল লকডাউন দ্বারা মানুষের মানুষের শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা। সদা কর্মব্যস্ত মানুষের জীবনে হঠাৎ এই লকডাউন মুহুর্তের মধ্যে এক ব্যাপক পরিবর্তন এনে দেয়।

মানবজীবনে লকডাউনের প্রভাব:

কর্মব্যস্ত মানুষের জীবনে হঠাৎ করে ভাইরাসের আগমনের ফলে এই লকডাউন এক ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। একদিকে যেমন বহু মানুষ উপার্জন হারিয়ে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে যায়, অন্যদিকে তেমন অনেক মানুষ প্রাথমিকভাবে ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুদিনের মুক্তির আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে।

এই লকডাউন আমাদের দেখিয়েছে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক তাদের কাজ হারিয়ে খালি পায়ে ফিরে আসছে নিজের ঘরের দিকে। শহরের ব্যস্ত রাস্তাঘাটগুলি হয়ে গিয়েছে খালি। ব্যস্ততম রাস্তাটিতে চলছে না কোনো গাড়ি-ঘোড়া। চারিদিকের দোকানপাট বন্ধ, নিস্পন্দ নিস্তব্ধ পরিবেশ।

পরিবেশ এবং লকডাউন:

এই লকডাউনের সবচেয়ে বড় প্রভাব মানব জীবনের ওপর পড়ে নি, বরং তার থেকেও বেশি পড়েছে পরিবেশের উপর।  পড়েছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর। হঠাৎ করেই মুহুর্তের মধ্যে তথাকথিত সাধারণ মানব জীবনযাত্রা স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন প্রকৃতি এক ব্যাপক পরিবর্তনের সাক্ষী থাকে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই দৈনন্দিন মানব জীবনচর্যার যে প্রভাব প্রকৃতির উপর এতদিন ধরে পড়তো তা দূরীভূত হয়ে যায়।

প্রকৃতি আবার ধীরে ধীরে অধিকার করতে শুরু করে মানুষ দ্বারা দখলীকৃত তার পুরাতন স্থান। এই লকডাউনে বারবার ফিরে ফিরে এসেছিল কংক্রিটের শহরের বুকে নীলগাই কিংবা কৃষ্ণসার মৃগ চরে বেড়ানোর অপূর্ব দৃশ্য। অরন্যের এইসব প্রাণীগুলি খোলা প্রকৃতিকে লকডাউনের মধ্যে বিপদমুক্ত বলে মনে করে বেরিয়ে এসেছিল। এছাড়া আরও দেখা গেছে বেশ কিছুদিনের অব্যবহারের ফলেই কোথাও কোথাও কংক্রিটের গা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে আগাছা। প্রকৃতি ও পরিবেশের সাময়িকভাবে হলেও মুক্তি পেয়েছে বিভিন্ন প্রকার দূষণের বিষবাষ্প থেকে।

বায়ুদূষণের মাত্রা হ্রাস:

লকডাউনের ফলে সর্বপ্রথম যা ঘটেছিল তা হলো সর্বপ্রকার যানবাহনের সম্পূর্ণ স্তব্ধতা এবং বিভিন্ন কল কারখানা এবং অফিস কাছারি বন্ধ হয়ে যাওয়া। প্রকৃতিতে দৈনন্দিন মানব জীবনের এই উপাদানগুলি ছিল পরিবেশের বায়ু দূষণের প্রধান কারণ। মানবসৃষ্ট এই উপাদানগুলি থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে মিশে বায়ুকে দূষিত করত।

লকডাউনের ফলে হঠাৎ করে এই সকল উপাদানগুলি স্তব্ধ হয়ে গেলে প্রকৃতিতে বিষাক্ত গ্যাসের আনাগোনাও কমে যায়। ফলে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে কিছুদিনের মধ্যেই প্রকৃতি বায়ুতে জমে থাকা বিভিন্ন বিষাক্ত অনুগুলিকে দূর করে হয়ে ওঠে নির্মল এবং বিশুদ্ধ। পৃথিবীর প্রকৃতি সচেতন সুধীজনেরা এতদিন শত চেষ্টাতেও যা করতে পারেনি, একটি লকডাউন কয়েকদিনের মধ্যে কোন এক ইন্দ্রজালিক মহিমায় তা সম্ভব করে দেখালো।

লকডাউন ও শব্দদূষণ:

গাড়িঘোড়া এবং কল-কারখানা গুলি স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে প্রকৃতিতে আর যে দূষণটির মাত্রা বহুলাংশে কমে এসেছিল সেটি হল শব্দ দূষণ। প্রকৃতিতে শব্দ দূষণের মূল উৎস হল কলকারখানার বীভৎস আওয়াজ, ছোট-বড় অসংখ্য গাড়ির নিরন্তর বেজে চলা হর্নের শব্দ, এবং ব্যস্ততার নিমিত্ত ভিড় করা মানুষের নিরন্তর চিল চিৎকার।

করোনাভাইরাসের ফলে জারি হওয়া লকডাউন এই সব কটি উপাদানকেই স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কলকারখানা হয়ে গিয়েছিল বন্ধ, গাড়ি-ঘোড়া রাস্তায় বেরোতে পারছিল অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ভাবে, এবং সর্বোপরি মানুষ হয়ে গিয়েছিল বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ। ফলে লকডাউনের ক’টি দিন রাস্তাঘাট হয়ে গিয়েছিল শুনশান, গাড়িঘোড়ার আওয়াজ নেই, মানুষের চেঁচামেচি নেই, নেই কারখানার বিষম সব শব্দ। সমগ্র পরিবেশ জুড়ে যে নিস্তব্ধ শান্তি সেসময় বিরাজ করছিল তাকে শব্দ বিশুদ্ধিই বলা চলে।

বিষমুক্ত জলভাগ:

বায়ু এবং শব্দের মতন প্রকৃতির জলভাগের দূষণেরও প্রধানতম উৎস হল মানুষের সচেতনতাহীন অপব্যবহার এবং সর্বোপরি কল কারখানা ও চাষের জমি থেকে নির্গত বিষাক্ত রাসায়নিক কিংবা বর্জ্য পদার্থ। লকডাউনের ফলে কল-কারখানা গুলি বন্ধ থাকায় সেই সব রাসায়নিক পদার্থ কারখানার বর্জ্য হিসেবে খাল বিল পুকুর কিংবা নদীতে মিশতে পারছিল না। ফলে মানুষের প্রতিদিনের ব্যবহার্য জল একটু একটু করে হয়ে উঠেছিল অনেকখানি বিশুদ্ধ। চাষবাসের জমি থেকে বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ পুকুর কিংবা নদীর জলে মিশলেও কলকারখানা তুলনায় তার পরিমাণ ছিল অনেকটাই নগণ্য।

লকডাউন ও মানবমনের বিশুদ্ধি:

আমরা বেশিরভাগ সময় ভুলে যাই যে মানুষও এই পরিবেশেরই অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। তাই পরিবেশ যেমন দূষিত হয়, তেমনি বিভিন্ন কারণে দূষিত হয় মানুষের মনও। দূষিত মন নিয়ে একটি দূষণমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলা সোনার পাথরবাটির মতোই অলীক কল্পনা।

মানুষের এই মনের দূষণের প্রধান কারণ হলো আধুনিক জীবনের চূড়ান্ত ভোগবিলাস মূলক দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিক মূল্যবোধের অভাব এবং সর্বোপরি নিজের ও নিজের পরিবারের সাথে অবসর যাপনের মতন সময়ের অভাব। এই লকডাউন সমগ্র পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য মানুষের কাছে অভিশাপ বয়ে এনেছে এ কথা স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয় পৃথিবীর বহু মানুষ এই লকডাউনের দিনগুলিতে বেশ কিছুটা সময় নিজের এবং নিজের পরিবারের সঙ্গে অবসর যাপনের জন্য পেয়েছিল।

লকডাউনের একপর্যায়ে ধারণা করা হয়েছিল এর ফলে হয়তো পারিবারিক হিংসার মাত্রা বেড়ে যাবে। তবে বাস্তবে এমন নজির খুব একটা দেখা যায়নি। বরং নিজের পরিবারের সাথে এবং সর্বোপরি নিজের সাথে সময় কাটাতে পেরে মানুষের মন কিছুটা হলেও অবসাদহীন এবং বিশুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।

উপসংহার:

দূষণমুক্ত বিশ্ব হল আমাদের সকলের স্বপ্নের আদর্শ পৃথিবীর রূপ। কিন্তু সেই রূপের বাস্তবায়ন এই আধুনিক জীবনযাত্রার মধ্যে দিয়ে সার্থক হয়ে ওঠে না। মহামারীর ফলে জারি হওয়া বিশ্বব্যাপী লকডাউন তেমনি একটি পৃথিবীর রূপকে কিছুদিনের জন্য হলেও আমাদের চোখের সামনে উপস্থাপন করেছিল। সেই পৃথিবী ছিল নির্মল, শাশ্বত ও সুন্দর। এই লকডাউন মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিল প্রকৃতি যদি চায় তাহলে মানুষের মতন অতি নগণ্য জীবের কৃত্রিম আধুনিকতার বাধা পরিবেশের আত্মশুদ্ধির কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়।


‘লকডাউনে কমলো দূষণ’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি নিয়ে এই ছিল সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা। উপরিউক্ত প্রবন্ধটিতে সংশ্লিষ্ট বিষয় সংক্রান্ত সবকটি দিককে আলোচনা করবার চেষ্টা করা হয়েছে। তাছাড়া পরীক্ষার প্রয়োজন অনুযায়ী উক্ত প্রবন্ধটিতে আমরা একটি সাধারণ শব্দসীমা বজায় রাখারও যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি।

আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে। উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন