ভাবসম্প্রসারণ: আত্মশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য

মানুষ ভাষা ব্যবহার করে মনের ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে। তবে কথা বলা, সাধারণ লেখালেখি, কবিতা কিংবা সাহিত্য রচনার সময় ভাষা ব্যাকরণের নানা অলংকার দ্বারা অলংকৃত শব্দের বন্ধনে যখন কোন বাক্যাংশ, বাক্য কিংবা বাক্যদ্বয় গঠিত হয়, তখন বিভিন্ন প্রেক্ষিতে তা এটি জটিল ব্যাপক অর্থকে প্রকাশ করতে পারে। কিংবা কখনো কথক, লেখক, কবি কিংবা সাহিত্যিকরা বাক্য রচনা ক্ষেত্রে এমন অসংখ্য শব্দ ব্যবহার করে থাকেন যা বৃহত্তর প্রেক্ষিতে কোন ভাবকে বোঝানোর জন্য একটি উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তখন সেই বাক্য, বাক্যাংশ কিংবা বাক্যদ্বয়ের মধ্যে মধ্যে লুকিয়ে থাকে একটি ব্যাপক জটিলরূপ অর্থ।

সেই সময়ে ওই অংশটির অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা ভাবটিকে উদঘাটন করতে প্রয়োজন পড়ে ভাব সম্প্রসারণের। ভাব সম্প্রসারণ কোন একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বাক্য কিংবা বাক্যদ্বয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বৃহত্তর তথা ব্যাপক ভাবটিকে সহজ ভাষায় তুলে ধরতে সাহায্য করে। 

বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং অলংকার বহুল। তাই বাংলা ভাষায় পূর্বোল্লিখিত ধরনের অলংকার সূচক ভাব কিংবা উপমা সূচক বাক্যের প্রয়োগও যথেষ্ট বেশি। সেকারণে স্বাভাবিকভাবেই  ভাব সম্প্রসারণ বাংলা ভাষা বিজ্ঞানের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশের মর্যাদা লাভ করে। ভাব-সম্প্রসারণ নিয়ে সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আশাব্যঞ্জক উৎসাহের অভাব লক্ষ্য করা যায়। এই বিশেষ অনীহা দূরীকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে আজ আমাদের এই প্রতিবেদনে আমরা “আত্মশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য”- এই বাক্যটির ভাবকেই দুটি পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করব।

আত্মশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য ভাবসম্প্রসারণ বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভাবসম্প্রসারণ-১

আমাদের চোখে যে পৃথিবী ধরা পড়ে তারমধ্যে একক বা অদ্বিতীয় বলে আসলে কিছুই হয় না। সে কারণেই বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানে সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে। তবে সৃষ্টির এই অমোঘ সত্যের কথা আজ থেকে কয়েক সহস্র বছর পূর্বেই ধরা পড়েছিল সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যে। ভারতীয় ঐতিহ্য কোন কিছুকেই নিজের থেকে পৃথক বলে দেখা হতো না। মনে করা হতো এই সমগ্র সৃষ্টিরই মিলিত রূপ হল আত্মা।

সৃষ্টি যে অনন্ত শক্তির ভান্ডার, সেই ভান্ডার থেকেই কণামাত্র শক্তির উপাদান নিয়ে গঠিত হয়েছে এই আত্মা। তবে সৃষ্টির সকল গুণ নিয়ে অদ্ভুত হলেও জন্মলগ্নে এই আত্মা থাকে নির্গুণ। জন্মের পর কালের বিবর্তনে সময়ের সাথে সাথে এই পৃথিবী থেকে বেঁচে থাকবার রসদ সংগ্রহ করে আত্মা গুণবান হয়ে ওঠে। বিশ্ব থেকে আপন ক্ষমতায় নিজ আত্মা দ্বারা অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির নামই হলো শিক্ষা। অন্যদিকে মানব জীবনের উদ্দেশ্যই হলো আত্মার মাধ্যমে পরমাত্মার উপলব্ধির চেষ্টা করা। এখন মানুষের আত্মাই যদি শক্তিহীন হয়, তাহলে সেই চেষ্টা যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, তা বলাই বাহুল্য।

আরো বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, মানুষকে জীবনে এমন কার্যই করা উচিত যা জীবনের শাশ্বত উদ্দেশ্যর দিকে তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই সকল কার্যকর আর জন্য প্রয়োজন হয় বিশ্ব থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির। এই দুইয়ের মিলিত রূপের নামই হলো শিক্ষা। মানবাত্মার সঙ্গে এই অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সমাহার না ঘটলে সেই শক্তিহীন মানবাত্মা কার্য সম্পাদনে অক্ষম থেকে যায়। ফলতই কর্মহীন মানুষের জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সেকারণে জীবনকে যাতে ব্যর্থতার গ্লানি গ্রাস না করতে পারে তার জন্য প্রয়োজন আত্মশক্তির। আর তাইই বলা হয়ে থাকে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যই হলো আত্মশক্তি অর্জন।


ভাবসম্প্রসারণ-২

মানুষ নিজেকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব বলে অভিহিত করে থাকে। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকৃতপক্ষে আসে মানুষের উন্নত বুদ্ধিমত্তা দ্বারা। এই বুদ্ধিমত্তা মানুষের অন্তরে জন্ম দেয় ব্যাপক উদ্ভাবনী শক্তির। সেই উদ্ভাবনী শক্তি দ্বারাই উন্নত কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে মানুষ জীবজগতে অর্জন করে শ্রেষ্ঠত্ব। একরকম এই শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায়  অংশগ্রহণের নিমিত্তই মানুষ ছোটবেলা থেকে শিক্ষা গ্রহণে ব্রতী হয়। কবে শিক্ষার প্রকৃত রূপ যে আসলে কি, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। তবে বিতর্ক যাই হোক না কেন, বর্তমান যুগে শিক্ষাকে জীবনধারণের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবেই মনে করা হয়ে থাকে। তবে শুধুমাত্র বাহ্যিক ভোগমূলক জীবনধারণ এবং নিজের বৈষয়িক উন্নতি দ্বারাই একটি সুষ্ঠু জীবন এবং একটি সুষ্ঠু সমাজ গড়ে উঠতে পারে না।

একটি আদর্শ সমাজ গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন হয় সেই সমাজের মানুষের সামগ্রিক চিন্তাশক্তির, শিষ্টাচারের তথা মূল্যবোধের। একটি সমাজের মধ্যে সামগ্রিকভাবে এই গুনগুলির সমাহার ঘটলে তবেই সেই সমাজে কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি সুখ ও শান্তি নেমে আসতে পারে। এবং সর্বোপরি এই গুণাবলী সমন্বিত সমাজ সমগ্র বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে কারণে সমাজ গঠনের উপাদান হিসেবে শিক্ষার উদ্দেশ্য কখনোই নিছক জীবনধারণ হতে পারে না। সমাজের ব্যাপকতার প্রেক্ষিতে শিক্ষার এই উদ্দেশ্যকে সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট বলেই মনে হয়।

তাই বর্তমানকালে শিক্ষার দ্বারা ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। এই প্রয়াস শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্বন্ধিত বিতর্ককে আরো একবার উস্কে দিয়ে সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে শিক্ষার উদ্দেশ্যকেই ধারণাকেই মান্যতা দেয়। এই ধারণা অনুযায়ী শিক্ষার উদ্দেশ্য হল ব্যক্তির সামগ্রিক চরিত্রের গঠন। অর্থাৎ সেই শিক্ষাই হলো প্রকৃত শিক্ষা যা ব্যক্তিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে জীবনের তুল্যমূল্য বিচারের ক্ষমতা দান করে। তাই নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে- “আত্মশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য”। 


“আত্মশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য”– বাক্যটির ভাব-সম্প্রসারণ বিষয়ে এই ছিল আমাদের উপস্থাপিত প্রতিবেদন। আজকের এই উপস্থাপনাটিতে আমরা দুটি সম্পূর্ণ অভিনব দৃষ্টিকোণ থেকে বাক্যটির ভাবকে যথাযথরূপে সম্প্রসারিত করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আলোচ্য এই বাক্যটির ভাব সম্পর্কে যদি আপনার কোনো রকম প্রশ্ন থেকেও থাকে, আশা করি এই প্রতিবেদনটি পাঠের পর তা দূর হয়ে গিয়েছে।

আমাদের এই প্রতিবেদনটি আপনাদের কেমন লাগলো, তা নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের অতি অবশ্যই জানান। আপনাদের মতামত আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন ভাব-সম্প্রসারণ পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই ভাব-সম্প্রসারণটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ। 

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন