বন্যা ও তার প্রতিকার রচনা [সঙ্গে PDF]

পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা অসংখ্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় গুলির মধ্যে অন্যতম হলো বন্যা। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিবছর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন কারণে বিধ্বংসী বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই বন্যার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, জীবনহানী ইত্যাদি ঘটে থাকে। জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিকারের উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা বন্যা পরিস্থিতি এবং তার নিয়ন্ত্রণ তথা প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।

বন্যা ও তার প্রতিকার রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

পৃথিবীতে সৃষ্টি তথা স্থিতির পাশাপাশি প্রলয়ও একইভাবে বিরাজমান। পৃথিবীর উপর সভ্যতার বোঝা যখন স্থানুর মতন চেপে বসে, হয়তো তখনই বিশ্বের মাথার উপর নেমে আসে বিপর্যয়ের খাঁড়া। আর তেমনই এক একটি বিপর্যয় আপন বিধ্বংসী মহিমায় একটি সভ্যতাকে করে দিতে পারে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। এই পৃথিবীতে বিপর্যয়কে মোটামুটি দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়, আর অন্যটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। প্রকৃতির রোষানলের কাছে মানুষ যে কত অসহায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলে মানুষ তা অনুধাবন করতে পারে। সভ্যতার আস্ফালন যতই তীব্র হোক না কেন প্রকৃতির অনন্ত শক্তির কাছে তা অতি তুচ্ছ। আমাদের পরিবেশে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা যায়। সেগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হলো বন্যা। 

বন্যা কি:

বন্যা ও তার প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে বন্যা প্রকৃতপক্ষে কি তা বোঝা প্রয়োজন। এক কথায় বলতে গেলে পৃথিবীর স্থলভাগ অস্বাভাবিক মাত্রায় জল দ্বারা প্লাবিত হলে সেই পরিস্থিতিকে বন্যা বলা হয়। বর্ষাকালে কিংবা নদী ভাঙ্গনের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এই প্রকার জল প্লাবন ঘটে থাকে।

সাধারণতঃ নদী বা সাগর সংলগ্ন নিচু অঞ্চলগুলিতে বন্যা দেখা গেলেও বিভিন্ন কারণে উচ্চভূমি, এমনকি পাহাড়ি অঞ্চলেও বন্যা দেখা যায়। এই বন্যার উৎস বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। কখনো অতিবৃষ্টির ফলে বড় বড় জনপদ জলে ভেসে যেতে পারে, কখনো বা কোন কারনে দুর্বল নদী বাঁধ ভেঙে গিয়ে প্লাবিত হতে পারে সংলগ্ন অঞ্চল, কখনো আবার সুনামির ফলে বিস্তৃত অঞ্চল জল দ্বারা প্লাবিত হতে পারে, কিংবা হঠাৎ করে মেঘ ভেঙে গিয়ে নদীর উচ্চ প্রবাহকে প্লাবিত করলে সংলগ্ন অঞ্চলে বন্যা দেখা দিতে পারে। 

বন্যার কারণসমূহ:

পূর্বোল্লিখিত বন্যার উৎসগুলিকে কোনভাবেই বন্যা পরিস্থিতির প্রকৃত কারণ বলে অভিহিত করা যায় না। সাধারণভাবে দেখতে গেলে বন্যা এক প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় যা নিতান্তই প্রকৃতির খেয়াল খুশির উপর নির্ভর করে। অতিবৃষ্টি কিংবা নদী প্লাবনের ফলে বন্যা সাধারণভাবেই পৃথিবীতে দেখা যায়। তবে বর্তমান যুগে সভ্যতার অগ্রগতির নিমিত্ত মানুষের বিভিন্ন প্রকৃতি বিরোধী কাজের ফলেও পৃথিবীকে বন্যার সম্মুখীন হতে হয়। তারমধ্যে সম্ভবত সর্ব প্রধান হলো নদীকে বিভিন্ন প্রয়োজনে যেখানে সেখানে বাঁধ দিয়ে তার জলপ্রবাহকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা। এই চেষ্টার ফলে একদিকে যেমন খরা নেমে আসতে পারে, অন্যদিকে আবার বন্যার করালগ্রাসে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে সবকিছু।

তাছাড়া বাঁধ ভেঙে যাওয়ার মতন পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একবারে প্রচুর পরিমাণে জল ছেড়ে দিলে বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। তবে নদী সংলগ্ন বিভিন্ন বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে যথাযথভাবে বাঁধ না দেওয়া, অরন্যের ওপর যথেচ্ছাচার ইত্যাদিও বন্যার কারণ। 

ইতিহাসে বন্যা:

সেই অতি প্রাচীন যুগ থেকেই ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বন্যার নিদর্শন পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম উল্লেখ করতে হয় পৃথিবীর প্রায় সব লোককথায় প্রচলিত বিশ্বব্যাপী বন্যার কাহিনীর কথা। তাছাড়া সুপ্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতা, হরপ্পা সংস্কৃতি, এমনকি মিশরীয় সভ্যতাতেও বন্যার নিদর্শন পাওয়া যায়।

হরপ্পা সংস্কৃতিতে সিন্ধু নদের বন্যা, মিশরীয় সভ্যতায় নীলনদের বন্যা, মেসোপটেমীয় সভ্যতাতে টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস নদীর বন্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এমনকি তারও পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনপদ-মহাজনপদের শাসকেরা বন্যা নিয়ন্ত্রণের নিমিত্ত বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।  ভারতীয় উপমহাদেশের একটি শক্তিশালী জনপদ মগধের শাসকদের দ্বারা বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বন্যার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি:

অন্যান্য যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতই বন্যাকেও সেই আদিম যুগ থেকে মানুষ ভয় পেয়ে এসেছে। প্রাচীন যুগে বন্যা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ আশ্রয় নিয়েছে অলৌকিক কল্পনার কাছে আত্মসমর্পণের। তবে কালের বিবর্তনে বন্যা সম্পর্কে মানুষের কুসংস্কার বহুলাংশে কেটে গেলেও বন্যার প্রতি মানুষের ভয় এখনো যায়নি। পৃথিবীর যেসব অঞ্চল বন্যাপ্রবণ, সেই সকল অঞ্চলের মানুষের কাছে বন্যা এক দুর্বিষহ বিভীষিকা স্বরূপ। বন্যা এসে তাদের ঘরবাড়ি জমি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাই বন্যার প্রতি তাদের ক্ষোভ সার্বজনীন তথা চিরকালের।

বন্যার ফলে ক্ষয়ক্ষতি: 

বন্যার ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষ তথা সকল প্রাণীকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি তথা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়। গ্রামীণ অঞ্চল বা মফস্বল এলাকায় বন্যার জল কাঁচা বাড়ি গুলিকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। অন্যদিকে সকল এলাকায় পাকা বাড়িও বন্যার জল দ্বারা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া চাষের জমিতে বন্যার জল ন্যূনতম সময়ের বেশি রয়ে গেলে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

অন্যদিকে বন্যার ফলে পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সংযোগ, টেলিযোগাযোগ তথা যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে। ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনও সমূহ সংকটের সম্মুখীন হয়। এছাড়া বন্যা কুকুর বিড়াল কিংবা গবাদি পশুদের জন্য অভিশাপ বয়ে আনে। বন্যার ফলে বিপুল সংখ্যায় এই সকল প্রাণীর মৃত্যু হয়। তাছাড়া বন্যা সাথে করে নিয়ে আসে আমাশয়, কলেরা ইত্যাদির মত রোগের আতঙ্ককে। 

বন্যার দান:

প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতিমূলক বেশ কিছু দিক থাকলেও, বন্যার কয়েকটি উপকারী ভূমিকাও লক্ষ্য করা যায়। আমরা আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহার্য জলের সিংহভাগ মাটির তলা থেকে সংগ্রহ করে থাকি। মাটির তলায় সীমিত এই ভৌম জলের ভাণ্ডার বন্যার ফলে পুনরায় ভরে যায়। ফলে মানুষের দৈনিক ব্যবহার্য ভৌম জলের যোগান অব্যাহত থাকে। অন্যদিকে কৃষি জমিতে অধিক ফলনের আশায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি অতিমাত্রায় প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। বন্যা নিজের সাথে করে নিয়ে আসা নদীবাহিত পলির প্রলেপ দ্বারা সেই সকল জমির উর্বরতা ফিরিয়ে দেয়। তাই সীমিত আকারে বন্যা পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।

বন্যার প্রতিকার:

বিধ্বংসী বন্যার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে পরিবেশ বিশারদরা বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। তাদের মতামতের উপর ভিত্তি করে বন্যা প্রতিকারকে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হলো: উৎস প্রতিরোধ, এবং দ্বিতীয়টি মূলগত প্রতিকার। উৎস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা বারবার বন্যা প্রবণ এলাকায় পোক্ত বাঁধ নির্মাণ করা, সংলগ্ন নদীর জলস্তরের উপর প্রতিনিয়তঃ নজর রাখা ইত্যাদি উপায়ের কথা বলেছেন। তারা মনে করেন, বন্যা প্রবণ এলাকাগুলিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য বছরে বন্যার সময়ের পূর্বে সে অঞ্চলের মানুষদের নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরিত করা প্রয়োজন।

অন্যদিকে বন্যার প্রতিকার মূলক উপায় হিসেবে বিজ্ঞানীরা পরিবেশ সংরক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এক্ষেত্রে তাদের মতে গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলির উচ্চ ও মধ্য প্রবাহে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে অবৈজ্ঞানিক কাজগুলির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। তাছাড়া ব্যারেজ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় জল ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। 

বিশ্বব্যাপী উদ্যোগসমূহ:

বন্যার ভয়াল রূপের দিকটি উপলব্ধি করে বন্যা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন তথা সংস্থা গঠিত হয়েছে। এ সকল সংস্থাগুলি দেশীয়, মহাদেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্যা প্রতিরোধ, পরিবেশ সংরক্ষণ, বন্যায় উদ্ধারকার্য, বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ করে থাকে। বিভিন্ন দেশীয় সরকারের তরফেও বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং বন্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উদ্দেশ্যে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দল গঠন করে থাকে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের তরফেও বিপর্যয় মোকাবিলা দল বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সমগ্র বিশ্বব্যাপী কাজ করে থাকে।

উপসংহার:

মানুষ তার সভ্যতার অগ্রগতির পথে যতই উন্নতিসাধন করুক না কেন, এই সৃষ্টির ব্যাপকতায় তার সবটুকুই অতি তুচ্ছ হয়ে যায়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্নস্থানে বছরের বিভিন্ন সময়ে সৃষ্টি হওয়া বিধ্বংসী বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির এই বিপুল ক্ষমতারই সাক্ষ্য বহন করে। মানুষ তার নিজের ক্ষমতা নিয়ে যতই অহংকার করুক, বিধ্বংসী বন্যায় জলের তোড়ে এক লহমায় ভেসে যায় তার সবটুকু। তাই বন্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের পাশাপাশি আমাদের সকল অহংকার ত্যাগ করে পরিবেশ সচেতন হয়ে প্রকৃতির রক্ষায়ও ব্রতী হতে হবে। 


আলোচ্য উপরিউক্ত প্রতিবেদনে বন্যা ও তার প্রতিকার সম্পর্কে সবকটি দিকের ওপর আমরা যথাসম্ভব সুষ্ঠুভাবে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। তবে পরীক্ষার প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে আমাদের নির্দিষ্ট শব্দের সীমানায় সীমিত থাকতে হয়েছে। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।

উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন