একটি বট গাছের আত্মকথা [PDF]

বট গাছ তো আমরা সবাই দেখেছি।কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছি একটি প্রাচীন বট গাছ কত অতীতের অভিজ্ঞতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটো একটি চারা গাছ থেকে কত সংগ্রামের পর তার আজ এই বিশাল অস্তিত্ব। সে গাছটি তার আশপাশে ঘটে যাওয়া ও ঘটে চলা কত ঘটনার সাক্ষী।কত কত পথিককে নিজের ছায়াতে আশ্রয় দিয়েছে ,কত পাখি বাসা বুনেছে,কত ঝড়ের রাত একাকী কাটিয়েছে। একটি প্রাচীন বট গাছের নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে আজকের বিষয় একটি বট গাছের আত্মকথা

একটি বট গাছের আত্মকথা

ভূমিকা:

কথায় বলে, বটগাছের বয়স মনে রাখতে নেই। নিজের বয়স আমিও মনে রাখিনি। জন্ম হওয়া থেকে পৃথিবীর নানা রূপের হিসেব রাখতে রাখতে নিজের বয়সের হিসেব গুলিয়ে ফেলেছি আজ বহুকাল।

কতশত গ্রীষ্মে কত শ্রান্ত পথিক কে আশ্রয় দিয়েছি, কত বর্ষায় স্নান করেছি, কত শরৎ এর কাশ আমার চারপাশে মাথা দুলিয়েছে কতবার, কত শীত কত বসন্তের বাতাস আমার শরীর ঘিরে বয়ে গেছে, তা সত্যিই মনে রাখতে পারিনি। হ্যাঁ, আমি বয়সের ভারে জীর্ণ এক দীর্ঘাঙ্গী বট আমার স্মৃতিচারণায় আজ বলে যাব এই দীর্ঘ জীবনের গল্প।

অভিজ্ঞতায় অতীত রূপ:

আমার যখন জন্ম, চারপাশ তখন ছিল ঘন জঙ্গল। আগেই বলেছি সময়ের জ্ঞান আমার নেই, যা আমি জানি তা হল জন্ম থেকে দেখা চারপাশের পৃথিবীর বদলাতে থাকা রূপ। যেদিন প্রথম ঘুম ভাঙলো আমার, সেদিন বৃষ্টি হচ্ছে মুষলধারে।

খেয়াল করলাম অন্য আরেকটা গাছ আমার মাথার উপর ছাতা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরে জেনেছিলাম ওটা কদম। ও সেদিন আমায় একটুও ভিজতে দেয়নি। তাই জীবনের স্মৃতিচারণায় আমার প্রথম অর্ঘ্য কদমের প্রতি। 

আমার থেকে কিছু দূরে ছিল একটা বড় দীঘি। তখন তাতে ফুটত শালুক আর পদ্ম। দূরের প্রান্তর থেকে স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে আসত; চারপাশ থেকে ভেসে আসত মিষ্টি ফুলের সুগন্ধ, মৌমাছি প্রজাপতি ফড়িং খেলা করে বেড়াতো আমার চারধারে; এমন মনোরম পরিবেশে ধরিত্রীর বুকে নিজের শিরা-উপশিরা বিছিয়ে দিয়ে আমি বড় হতে লাগলাম।

তখন একটু বড় হয়েছি; একদিন দেখলাম আমার থেকে কিছু দূরে, জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করছে একদল মানুষ। সেদিন খানিক ভয় হয়েছিল: যদি ওই ধারালো অস্ত্রের কোপ পড়ে আমার গায়েও! কিন্তু আমি রয়ে গেলাম। তারপর প্রায়ই দেখতাম, পরিষ্কার করা ওই রাস্তা দিয়ে সার বেঁধে যাচ্ছে পালকি, গরুর গাড়ি।

এই সময় আমি খানিক শক্ত সমর্থ হয়েছি; তখন আর জোর বাতাসও আমায় টলাতে পারে না। মাথার ওপর দিকে বড় ডাল থেকে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করেছি অল্প অল্প করে, তাতে ছোট ছোট পাতা গজিয়েছে।

আমার পাশের গাছগুলোর মতন, আমার ডালেও রংবেরঙের পাখি এসে ভিড় করতে শুরু করেছে। চারপাশে লোকের আনাগোনা বাড়ছে দিন দিন। যাওয়া-আসার পথে কেউ কেউ মাঝেমধ্যে আমার ছায়ায় বসে বিশ্রাম করে নিত। ব্যস্ত-সন্ত্রস্ত জীবনে এই ছায়াতে এরা শান্তি খুঁজে পেত। 

এদিকে আমার ডালপালা জুড়ে পাখিদের কলকাকলি তো লেগেই রয়েছে। তারা আমার শরীর থেকে ঝরে যাওয়া ছোট ছোট ডালপালা নিয়ে আমারই শাখা-প্রশাখায় বাসা বাঁধতে শুরু করেছে একটু একটু করে। 

পাখিগুলো যখন ডিম দিত, আমি আমার পাতা দিয়ে সযত্নে আগলে রাখতাম সেই ডিম। তারপর সেই ডিম ফুটে যেদিন ছোট্ট ছোট্ট ছানা বের হতো, মনটা আনন্দে ভরে যেত। 

এই যখনকার কথা বলছি, তখন আমার চারপাশ আর আগের মত নেই। কদমকে কেটে ফেলা হয়েছে আজ বেশ কিছুদিন; চারিদিক জঙ্গল থেকে ধীরে ধীরে একটা ছোট গ্রামের চেহারা নিচ্ছে। 

এরপর বহুকাল যাবৎ নিজের চারপাশকে ধীরে ধীরে আরো ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখেছি। অনতিদূরে দেখেছি ছোট-বড়ো বাড়ি গড়ে উঠতে। আর দেখেছি নতুন নতুন মানুষকে। পালকি আজকাল আর তেমন দেখা যায় না। 

ঝড়ের অভিজ্ঞতা:

এই কাহিনী কোন এক গ্রীষ্মকালের বৈশাখ মাসের পড়ন্ত বিকেলের। গুমোট গরম পড়েছিল সেই দিন। সাধারণত বিকেলে আমার চারপাশে অনেক লোকজন বেড়াতে আসে। কিন্তু সেই দিনের পথঘাট ছিল জনমানব শূন্য। সারাদিনের গরমে একটি পাতা নাড়ানোর সামর্থ্যও আর আমার নেই।

এমন সময় হঠাৎ কালো আকাশে মেঘ গর্জন করে এল তুমুল ঝড়। সেই ঝড়ের মধ্যে মাথা তুলে নিজের শিরা-উপশিরা দিয়ে ধরিত্রীর বুক সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে নিজের আব্রু বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এমন সময় দেখতে পেলাম সামনের জাম গাছটা হুড়মুড় করে ওপরে পরলো।

দিঘির ধারে শিমুল গাছটা গোড়া থেকে ভেঙে পরল দীঘির জলে। কোথা থেকে একটা ছাতা ঝড়ের দমকা হাওয়ায় উড়ে এসে আটকে গেল আমার একটা ডালে। সেই দিন শত চেষ্টা করেও আমার শাখা-প্রশাখায় থাকা পাখির বাসার ছোট ছোট ডিমগুলোকে বাঁচাতে পারিনি।

বাঁচাতে পারিনি পাখির ছোট ছোট ছানাগুলোকেও। চোখের সামনে উপড়ে পড়তে দেখেছি নিজের ভাই বন্ধুর শরীরকে। এরই মধ্যে বৃষ্টি নামল মুষলধারায়। যে গাছগুলো ভেঙে পড়েছিল সেইখানকার পাখিগুলো এসে কোনরকমে আশ্রয় নিল আমার কোটরে।

ঝড় যখন থামলো, তখন দেখলাম চারিদিকে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে আছে উপড়ে পড়া গাছ, রংবেরঙের নাম-না-জানা পাখির মৃতদেহ, আর আমার একটা শাখা থেকে ঝুলে রয়েছে দাবিদারহীন কালো রঙের একটা ছাতা।

বর্তমান কালের কথা:

আজকাল তুলনামূলকভাবে গরম পড়ে বড় বেশি। আমার চারপাশের বন্ধুবান্ধব আগের তুলনায় আরো কমে এসেছে। কিন্তু আমি দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছি। আমার নিচে দাঁড়ালে আজকাল আর আকাশ দেখতে পাওয়া যায় না।

বিভিন্ন কান্ড থেকে নেমেছে বড় বড় ঝুড়ি। বিকেলবেলা বেড়াতে আসা শিশুদের দল আমায় ঘিরে লুকোচুরি খেলে, আমার ঝুরি ধরে দোল খায়, দুপুরে শ্রান্ত ক্লান্ত পথিক আজও আমার ছায়ায় দু’দণ্ড বিশ্রাম নিয়ে যায়।

আর যখন কোন গ্রাম্য বধূ তার সুপ্ত কোন মনোবাঞ্ছা পূরণের আশায় পরম বিশ্বাসে আমায় পুজো করে আমার শরীরে লাল সুতো বেঁধে দিয়ে যায়, তখন আমিও প্রার্থনা করি যেন তাদের সকল আশা পূরণ হয়।

উপসংহার:

মোটামুটি এই হল আমার দীর্ঘ জীবনের সংক্ষিপ্তসার। অনেকের হয়তো এই জীবনকে একঘেয়ে মনে হতে পারে। আমার নিজের কখনো তা হয় না। জন্ম থেকে এই একই জায়গায় একাকী স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে, আমি সময়ের ওঠাপড়া দেখেছি আমার চারপাশের সবার থেকে বেশি।

যে মানুষ তার জীবনের চাহিদা অর্জনে প্রতিনিয়ত দৌড়ায়, আমি তাকে রোজ ছায়া দিয়েছি, নিরীহ পাখিকুলকে দিয়েছি খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয়। এভাবেই চারপাশের পৃথিবীটুকুকে আমি আমার জীবন দিয়ে রক্ষা করে যেতে চাই সবসময়। এতেই আমার জীবনের সার্থকতা।


একটি বটগাছের আত্মকথা প্রবন্ধ রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার।

এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

“একটি বট গাছের আত্মকথা [PDF]”-এ 3-টি মন্তব্য

Kumar Kanti Ganguly শীর্ষক প্রকাশনায় মন্তব্য করুন জবাব বাতিল