বই পড়ার আনন্দ রচনা [সঙ্গে PDF]

বই পড়াগুলো মানুষের কাছে আদিম জ্ঞানার্জনগত বিনোদন স্বরূপ। এই বিনোদনের মধ্যে একদিকে যেমন লুকিয়ে থাকে অনাবিল আনন্দ, তেমনি জড়িয়ে থাকে জ্ঞানের দোত্যনা। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা মানুষের এই আদিম আনন্দময় অভ্যাসের স্বরূপ উদঘাটনের প্রতিই আলোকপাত করার চেষ্টা করতে চলেছি।

বই পড়ার আনন্দ রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

মানুষের জন্ম হয় এই মহাসৃষ্টিকে জীবনে যতটুকু সম্ভব জানার জন্য। এই জানারই অপর নাম জ্ঞান অর্জন, আর জ্ঞানেই জীবনের সার্থকতা। মানুষের জীবনের বাঁধাধরা সংক্ষিপ্ত পরিসরে জ্ঞান লাভ হয় অভিজ্ঞতা এবং তথ্য দ্বারা। সেই তথ্য ও অভিজ্ঞতাকে মানুষ যে সংগ্রহশালায় সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখে তা হল গ্রন্থ বা বই। এই গ্রন্থ বা বইয়ের মাধ্যমেই মানুষ জ্ঞানলাভের দিকে এগিয়ে যায়।

যেহেতু জ্ঞানলাভের জীবনের সার্থকতা, তাই স্বাভাবিকভাবেই বই পড়ার মধ্যে এক সার্থক আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। বই পড়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক অদ্ভুত অনুভূতি, যা মানুষের কল্পনাকে নিমেষের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারে যেকোনো কাঙ্খিত পর্যায়ে। সশরীরে না হলেও, কল্পনার মেঘে ভর করে কাঙ্খিত পৃথিবীতে মুহূর্তের বিচরণ মানুষকে অসীম আনন্দ এনে দেয়। আর এখানেই বই পড়ার সার্থকতা।

বই পড়া কি?

বই পড়ার আনন্দ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে বই পড়া বলতে আসলে ঠিক কি বুঝানো হয়, সে সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বিশেষ করে বর্তমান যুগে বই পড়া জ্ঞান অর্জনের তুলনায় অনেক বেশি যান্ত্রিক এবং লক্ষ্য কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। তবে বই পড়ার প্রকৃত রূপ এমন নয়। শুধুমাত্র জ্ঞানার্জন ব্যতীত অন্য কোন নির্দিষ্ট কাঙ্খিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে বই পড়লে মানুষের মধ্যে তথ্যের সমাহার ঘটে মাত্র, তবে প্রকৃত জ্ঞানের বিকাশ হয় না।

এমন বই পড়ায় আনন্দ নেইই, বরং যা আছে তা হলো একঘেয়েমি। বই বলতে এখানে সব রকম বইয়ের কথা বলা হচ্ছে। সকল প্রকারের বইই লেখকের কোন না কোন ধরণের চিন্তার অভিক্ষেপ। তবে সেই অভিক্ষেপকে অনুভব করতে হবে জ্ঞানের অনুভূতির উদ্দেশ্য নিয়ে, কোন বাহ্যিক লক্ষ্যপূরণের অভিপ্রায় নিয়ে নয়। তবেই তা একটি সার্থক বই পড়া হয়ে উঠবে, আর এই প্রকারের বই পড়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনাবিল আনন্দের সমুদ্র।

মানুষের বই পড়ার ইতিহাস:

পৃথিবীতে অন্যান্য প্রতিটি জিনিসের মতন বই পড়ারও ইতিহাস রয়েছে। মানুষের বই পড়ার ইতিহাসের সূচনা ঠিক কবে তা জানা যায় না। তবে অনুধাবন করা হয় সুপ্রাচীনকালে মানুষ যখন লিখতে ও পড়তে শেখে তার কিছু পর থেকেই মানুষের পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। সেই যুগে পড়ার রূপ আজকের বইয়ের মতন সুসংগত ছিলনা। মানুষ পড়তো গাছের পাতা, বড় পাথর, গাছের ছাল ইত্যাদির গায়ে লেখা লিপি।

বিভিন্ন বস্তুর উপর লিখিত এই প্রকারের লিপির পরবর্তী সুসংগত রূপ ছিল পুঁথি। এইখান থেকেই সংগঠিতভাবে মানুষের বই পড়ার অভ্যাসের সূচনা। তারপর থেকে সময়ের বিবর্তনে বই পড়ার অভ্যাসে নানা পরিবর্তন এসেছে। সর্বোপরি পঞ্চদশ শতকে জার্মানিতে গুটেনবার্গের মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর থেকে বই পড়ার ইতিহাসে এবং অভ্যাসে যুগান্তকারী বদল ঘটে যায়। বই এই সময় থেকে সর্বসাধারণের জন্য সহজলভ্য হয়ে ওঠে। বই পড়ার অসীম আনন্দ সকলে উপভোগ করার সুযোগ পায়।

বই পড়ার উপকারিতা:

বই পড়ার উপকারিতা বলে শেষ করার মতন নয়। এটি পৃথিবীর সম্ভবত একমাত্র অভ্যাস যার কোন ক্ষতিকর দিক খুঁজে পাওয়া যায় না। বই পড়লে একদিকে যেমন মানুষের চিন্তা শক্তির বিকাশ ঘটে, অন্যদিকে তেমনি উন্নততর হয় মানুষের ভাষা জ্ঞান। বই পড়ার অভ্যাসের মাধ্যমে মানুষ সঠিক শব্দের সঠিক প্রয়োগ শিখতে পারে।

অন্যদিকে বই পড়লে মানুষের মন বাহ্যিকভাবে স্থির হয়, তবে আত্মা হয়ে ওঠে চঞ্চল দুর্নিবার। বই পড়ে জ্ঞানের খোঁজে আত্মা পাড়ি দেয় দিক থেকে দিগন্তে, প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। এছাড়া বই পড়লে মানুষের লেখনী শক্তির শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। তাছাড়া বই পড়লে মানুষের অন্তরে অসংখ্য বিশেষ চারিত্রিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। সর্বোপরি বই পড়ে যে অনাবিল আনন্দ মানুষ লাভ করে, পৃথিবীর যেকোনো বিনোদনের আনন্দ তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়।

বর্তমান যুগে বই পড়া:

মানব সভ্যতার ইতিহাসে বই পড়ার সূচনা একদিকে যেমন জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে, অন্যদিকে তেমনি বিনোদন বা আনন্দলাভের উদ্দেশ্যে নিয়ে। বর্তমানকালের ভোগবাদী সভ্যতার যুগে মানুষের হাতের কাছে অসংখ্য সহজ বিকল্প উপস্থিত থাকায় সাধারণ জনমানুষের বই পড়ার প্রতি কিছুটা অনীহার মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণিত হয় গত 100 বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা যে হারে বেড়েছে, মানুষের মধ্যে বই পড়ার চাহিদা সেই হারে মোটেই বাড়েনি। সেই তুলনায় বহুগুণ এ বেড়েছে নানা সহজলভ্য বিনোদনের চাহিদা।

বই পড়ার জন্য যে ন্যূনতম ধৈর্যের প্রয়োজন হয় বিনোদনের সহজলভ্যতার ফলে সেই ধৈর্য মানুষের মধ্যে গড়েই উঠতে পারে না। এছাড়াও বই পড়ার প্রতি মানুষের অনীহার অন্যতম কারণ হলো বর্তমান যুগের শিক্ষাব্যবস্থার যান্ত্রিকতা। আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা জ্ঞান অর্জনের তুলনায় কাঙ্খিত লক্ষ্যভিত্তিক পড়াশোনায় অধিক গুরুত্ব দেয়। ফলে বই পড়ার মধ্যে মানুষের আত্মার একনিষ্ঠতা থাকেনা। ফলে এই ধরনের বই পড়া আনন্দ লাভের উপায় না হয়ে, বাধ্যতামূলক একঘেয়েমির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

আমি ও বই পড়া:

আমি ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান যুগের গতানুগতিক বই পড়ার মানসিকতা সম্পন্ন মানুষদের থেকে কিছুটা আলাদা। তার কারণ ছোটবেলা থেকেই সহজলভ্য বিনোদনের তুলনায় আমি বইয়ের মধ্যে আশ্চর্য আনন্দের সমুদ্র খুঁজে পেয়েছি। পড়ার বই কিংবা গল্পের বই এর মধ্যে তফাৎ না করে শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের আনন্দলাভের নিমিত্ত বই পড়তেই আমি বেশি ভালোবাসি। আমি প্রধানত বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন লেখকদের বই পড়ে থাকি।

প্রতিটি বই বিষয় ও চরিত্রগত দিক থেকে পৃথক হলেও আমার মধ্যে তারা একই প্রকার আনন্দ বয়ে আনে। আমি ইতিহাস, সাহিত্য, পদার্থবিজ্ঞান এবং মহাকাশ বিজ্ঞানের বই পড়তে বেশি ভালোবাসি। বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার; ইংরেজিতে রাস্কিন বন্ড, আলবার্ট আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং প্রমূখ প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বদের লেখা বইগুলি আমার অতি প্রিয়। 

বই পড়ার নেশা:

যে মানুষ বই পড়ে, সময়ের বিবর্তনে বই পড়ার অভ্যাস তার কাছে এক নেশায় পরিণত হয়। বই পড়ার প্রাথমিক গুনই হল কোন বই পড়ার সময় সেই বইটি পাঠককে অন্য আরেকটি বই পড়তে প্ররোচিত করে। প্ররোচনার এই গোলকধাঁধায় আটকে গিয়ে পাঠক একটি বই শেষ করে অন্য আরেকটি শুরু করার চক্র থেকে বের হতে পারে না। যে ব্যক্তি নিয়মিত বই পড়ে, বই ছাড়া তার জীবন এক প্রকার অচল হয়ে যায়। জীবনে যতই ব্যস্ততা আসুক, বই হয়ে থাকে তার সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী।

বই পড়া সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র একটি নেশা যার কোনরূপ অপকারিতা তো নেইই বরং এই নেশা উপকারিতার সম্ভাবনায় ভরপুর। পৃথিবীতে যে সকল ব্যক্তিই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন তথা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, তারা প্রায় সকলেই এই নেশায় আক্রান্ত। উদাহরণস্বরূপ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিল গেটস, শাহরুখ খান প্রমুখের কথা উল্লেখ করা যায়। 

উপসংহার:

বই পড়ার মধ্যে নিছক জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য নয় বরং লুকিয়ে থাকে নতুন কিছুকে জানার এক অদ্ভুত আনন্দ। এই আনন্দের টানে পাঠকরা বইপাগল হয়ে থাকেন। বর্তমান যুগে আধুনিক প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা বেশ কিছুটা কমে গেলেও আশার কথা এই যে আজকের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বইপত্রের ডিজিটালাইজেশনের ফলে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পুনরায় বই পড়ার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এই প্রবণতা পুনরায় নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাসে সার্থকতা লাভ করলে, তা আদপে এক সুন্দর আনন্দময় পৃথিবী গড়ে তুলতেই সাহায্য করবে। 


আলোচ্য উপরিউক্ত ‘বই পড়ার আনন্দ’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয় সংক্রান্ত প্রায় সবকটি দিক নিয়ে যথাযথ আলোচনার চেষ্টা করেছি। তবে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে এই উপস্থাপনায় নির্দিষ্ট শব্দ সীমা বজায় রাখারও চেষ্টা করা হয়েছে। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।

উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন