প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক কর্তব্য প্রবন্ধ রচনা [PDF]

কোন মানুষ একা বাঁচতে পারে না। সমাজের প্রয়োজন মানুষের হয়েই থাকে। সে কারণে সমাজের প্রতি মানুষের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকেই যায়। সমাজের ওপর অধিকার প্রতিটি মানুষের রয়েছে। প্রতিবন্ধীরাও সেই অধিকারের বাইরে নন। তাই তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করা প্রতিটি মানুষের সামাজিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমাদের আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক কর্তব্য বিষয়ে আলোকপাত করে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপনার প্রয়াস করতে চলেছি।

প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক কর্তব্য রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

মানুষ হল সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজের শৃঙ্খলে স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্ত হলো পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহাবস্থান। এই পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহাবস্থানের নীতির উপর ভিত্তি করেই সমাজের মধ্যে মানুষে মানুষে বন্ধন গড়ে ওঠে।

তাছাড়া এই পৃথিবীতে কোন মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাকে নিজের কোনো না কোনো প্রয়োজনে সমাজের কারোর না কারোর উপর নির্ভর করতেই হয়। সে কারণে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অপরকে সাহায্য এবং নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সমাজের সাহায্য গ্রহণ এই পারস্পারিক আদান-প্রদানের মাধ্যমেই সমাজের চাকা গতিশীল থাকে। নিজেরে সামর্থ্য অনুযায়ী অপরকে সাহায্যের এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে উঠে আসে মানুষের সামাজিক কর্তব্যের ধারণা। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা সমাজের প্রতিবন্ধী বা বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের প্রতি সামাজিক কর্তব্যের বিষয়ে আলোচনা করব। 

সামাজিক কর্তব্যের স্বরূপ:

সমাজে মানুষের কর্তব্যের স্বরূপ উদঘাটন করতে গেলে সর্বপ্রথম সমাজ কি তা বোঝা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে মানুষ অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে যে জোটবদ্ধ জীবনকে বেছে নিয়েছিল তাইই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সমাজ রূপে বিবর্তিত হয়েছে। বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের সেই জোট বা গোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন যুগোপযোগী নিয়ম কানুন, গড়ে উঠেছে সংস্কৃতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহাবস্থানের মানসিকতা।

ঐক্যবদ্ধ মনন এবং পারস্পরিক সহাবস্থান এই দুয়ের মিশেলে যে মানব গোষ্ঠী বিকাশ লাভ করেছে তাইই হলো সমাজ। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে তথাকথিত সনাতন সমাজের বন্ধন তুলনামূলকভাবে শিথিল হলেও মানুষের জীবনের ওপর সমাজের গুরুত্বকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। এই ব্যাপক গুরুত্বের কারণেই শুধুমাত্র আত্মকেন্দ্রিক জীবনধারণ ছাড়াও মানুষকে সমাজের প্রতি নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। এই সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য গুলি ঐক্যবদ্ধ মনন, সংস্কৃতির সাধন, এবং সর্বোপরি পারস্পারিক সহাবস্থানে সাহায্য করে থাকে। সমাজে এই দায়িত্ব ও কর্তব্যের স্বাভাবিক রূপ হল সুস্থ সংস্কৃতির ধারণ, আর্তের উন্নয়ন এবং আপন সামর্থের যথাযোগ্য প্রতিপাদন। 

প্রতিবন্ধী কারা?

সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সামাজিক কর্তব্য সংক্রান্ত আলোচনায় সর্বপ্রথম প্রতিবন্ধী আসলে কারা তা আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রতিটি সমাজেই বিভিন্ন প্রকার মানুষ বসবাস করে থাকেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী আপন জীবন ধারণে সক্ষম হয়ে থাকেন। তবে সমাজে এমন মানুষও থাকেন যারা কোনো না কোনো কারণবশত নিজের জীবনকে অন্য কারোর সাহায্য ছাড়া চালিয়ে নিয়ে যেতে অক্ষম হন।

এদের মধ্যে কেউ হয়তো দৃষ্টিশক্তিহীন, কেউ বা শ্রবণ কিংবা বাকশক্তিহীন, কেউ কোন একটি বিশেষ অঙ্গহীন কিংবা অন্য কোন শারীরিক অক্ষমতার শিকার, আবার কেউ কেউ মানসিকভাবে অক্ষম। এরাই হলেন সমাজের প্রতিবন্ধী শ্রেণীর মানুষ। এই সকল প্রতিবন্ধকতা জন্মগত কিংবা কোন দুর্ঘটনার কারণবশত হতে পারে। এদের সকলেরই পৃথিবীতে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য অপর মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয়। তবে মানুষ মাত্রই কোন না কোন দিক থেকে অসম্পূর্ণ। তাই সে দিক থেকে দেখতে গেলে আমরা সকলেই কোনো-না-কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। সুতরাং প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিবন্ধকতাকে কখনোই অপমান করা উচিত নয়। 

প্রতিবন্ধীদের প্রতি কর্তব্যসমূহ:

প্রতিবন্ধী মানুষ যেহেতু স্বাভাবিক আত্মনির্ভর জীবনধারণে অক্ষম হয়ে থাকেন, তাই তাদের বেঁচে থাকার জন্য অন্য মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয়। মানুষের এই প্রয়োজন অনুযায়ী সমাজে যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের ধারণা গড়ে ওঠে, তার ওপর ভিত্তি করেই প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সামাজিক কর্তব্যের দিকটি উঠে আসে। এই সামাজিক কর্তব্য শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী মানুষের পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং তার সমগ্র সামাজিক মানসিকতার মধ্যে ব্যাপৃত থাকা উচিত। কারণ মানুষ শুধু পরিবারের মধ্যে বেঁচে থাকে না, মানুষ বাঁচে সমাজের ক্রমবিবর্তনের মধ্যে।

তাই প্রত্যেকটি সক্ষম মানুষের উচিত জীবনে চলার পথে প্রতিবন্ধী মানুষকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী কোন না কোন ভাবে সাহায্য করা। এই সাহায্যের রূপ বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। দৃষ্টিশক্তিহীন মানুষকে চলার পথে সাহায্য করা, শ্রবণশক্তিহীন মানুষকে কোন একটি বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া, বাকশক্তিহীন মানুষকে মনের ভাব প্রকাশে সাহায্য করা, কিংবা অন্য কোন প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য সবি প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক সামাজিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। 

প্রতিবন্ধীদের প্রতি কর্তব্য পালনের গুরুত্ব:

প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে সকল মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। প্রতিবন্ধী মানুষেরাও সেই শৃংখলাবদ্ধ সমাজেরই অঙ্গ। তাই সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সহাবস্থানের নীতি অনুযায়ী গড়ে ওঠা দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিবন্ধী মানুষদের উপরেও বর্তায়। প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে মানুষ প্রকৃতপক্ষে সমাজের বন্ধনকেই সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করতে সাহায্য করে।

মানুষ হলো মান এবং হুঁশের  সম্মিলিত প্রকাশ। এই মান এবং হুঁশ থেকে উঠে আসা মানবিক বোধের প্রকাশ ঘটে সমাজের অক্ষম মানুষগুলির প্রতি সামাজিক কর্তব্য পালনে। এই সামাজিক কর্তব্য দ্বারা মানুষ যেমন সমাজে পারস্পারিক সহাবস্থানের নীতি মেনে চলে তেমনি নিজের মনুষ্যত্বকে আরো সমৃদ্ধ করে। অন্যদিকে মানুষের এই স্বাভাবিক কর্তব্যের পালনে প্রতিবন্ধী মানুষেরাও তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন সুপ্ত সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করার সুযোগ পায়। সমাজের সাহায্যে তারা নিজেদের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আপন প্রতিভা দ্বারা সমাজে কোনো না কোনো অবদান রেখে যেতে সক্ষম হয়।

বৃহত্তর উদ্যোগসমূহ:

প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি মানুষের এই স্বাভাবিক সামাজিক কর্তব্যের ধারণা থেকে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে প্রতিবন্ধী মানুষদের সাহায্যের জন্য বৃহত্তর ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। কমবেশি প্রতিদিনই দেশের সরকার এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য লেখাপড়া, চলাফেরা এবং ভাবের আদান প্রদানে সহায়তার জন্য গৃহীত বিশেষ ব্যবস্থাগুলির কথা উল্লেখ করা যায়। আমাদের দেশেও গণপরিবহনে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য আলাদা সংরক্ষিত বসবার জায়গার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি জায়গায় প্রতিবন্ধী মানুষের চলাফেরা ও ভাবের আদান প্রদানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকার ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি অলাভজনক সংস্থা প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নকল্পে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। এই সকল সংস্থাগুলি লেখাপড়া তথা বিভিন্ন সৃজনমূলক কর্মকাণ্ডের সাহায্যে প্রতিবন্ধী মানুষদের আপন সুপ্ত প্রতিভাকে আবিস্কার করতে সাহায্য ও উৎসাহিত করে থাকে। এইসকল প্রতিভা ধারা প্রতিবন্ধী মানুষেরা একদিকে যেমন কিছুটা হলেও আত্মনির্ভর জীবনযাপনে সক্ষম হয় অন্যদিকে সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রেখে যায়।

উপসংহার:

প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন মনুষ্যত্বের সর্বোত্তম কর্ম রূপে বিবেচিত হয়। সকল যুগে সকল মনীষীরা এই দায়িত্বকে মনুষ্যত্বের পবিত্র কর্তব্য রূপে উল্লেখ করে গিয়েছেন। বাংলার বুকে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কিংবা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সকলেই প্রতিবন্ধী মানুষকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের কথা বলে গিয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”। ভারতবর্ষের এই যুবক ঋষির জীব সেবার মহান বাণীকে পাথেয় করে প্রতিবন্ধী মানুষকে নিজেদের সক্ষম সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করাই আমাদের পরম পবিত্র কর্তব্য হওয়া উচিত।


প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক কর্তব্য বিষয়ে আলোচ্য উপরিউক্ত এই প্রবন্ধে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মোটামুটি সবকটি সম্ভাব্য দিক সম্পর্কে আমরা আলোচনার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া পরীক্ষার প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে উক্ত প্রতিবেদনে নির্দিষ্ট একটি শব্দ সীমা বজায় রাখারও চেষ্টা করা হয়েছে। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।

উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন