পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণ রচনা [সঙ্গে PDF]

পৃথিবীতে পানীয় জল হল সভ্যতার জন্য অমৃতসুধা স্বরূপ। কিন্তু বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কারণে পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলার ফলে তা বিজ্ঞানীদের কাছে বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। সমগ্র বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে সভ্যতার সংকট ন্যায় এই মূর্ত সমস্যা নিয়ে। বিশ্বব্যাপী এই সমস্যার বিশেষ কয়েকটি দিকের ওপর আলোকপাত করার উদ্দেশ্য নেই আমাদের আজকের প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণ রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

জল হল এ বিশ্বপ্রকৃতির সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ উপাদান। পৃথিবীতে জল ছাড়া কোন কিছুই গঠিত হতে পারে না। সে কারণেই হয়তো এ পৃথিবীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য হলো জল। তেমনি মানব সভ্যতার আপন অস্তিত্ব রক্ষার জন্যও সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো পানীয় জল। পানীয় জল ছাড়া মানুষের পক্ষে জীবনধারণ অসম্ভব।

সুতরাং বিশ্বে পানীয় জল হওয়া দরকার নির্মল, বিশুদ্ধ এবং সহজলভ্য। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক সভ্যতার সর্বব্যাপী ঢক্কানিনাদের যুগে মানুষের জীবনধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় পানীয় জলের ক্ষেত্রেও নানা প্রকার সংকট দেখা দিচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য জলের উৎস মতন পানীয় জলেও বাড়ছে দূষণের মাত্রা।

পানীয় জলে বেড়ে চলা এই দূষণের মাত্রার মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো আর্সেনিক দূষণ। এই দূষণ মানুষকে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে জীবনধারণের মজ্জায় আঘাত করে আদপে সমগ্র সভ্যতাকে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে দিচ্ছে।

পৃথিবীতে পানীয় জল:

পানীয় জলের দূষণ সংক্রান্ত আলোচনায় সর্বপ্রথম প্রশ্ন আসে জল যদি এ পৃথিবীর সাধারণ উপাদান হয় তাহলে পানীয় জল বলতে ঠিক কোনটা বোঝায়। আসলে এ পৃথিবীতে জল রয়েছে বিভিন্ন রূপে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিমাণ জল আছে বিশ্বের মহাসাগর গুলিতে।

তাছাড়া প্রচুর পরিমাণে জল রয়েছে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খাল-বিল, পুকুর, নদী-নালায়। প্রাণিজগতের অন্যান্য সদস্যদের পক্ষে এই ধরনের জল পানীয় রূপে গ্রহণ করা গেলেও মানুষের পক্ষে তা অসম্ভব। কারণ এই ধরনের জল গুলিতে মিশ্রিত দ্রব্য হিসেবে থাকে বিভিন্ন ধাতু এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ,যা মানুষের শরীরের জন্য বিশেষভাবে হানিকারক।

তাই মানুষের প্রয়োজন নির্দিষ্ট মাত্রায় সুষম বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জল, যা মানুষের জীবনধারণ তথা শরীর বিকাশে সহায়তা করবে। এই প্রকারের জলকেই আমরা পানীয় জল বলে থাকি। পৃথিবীতে পানীয় জলের উৎস বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যেকোনো জলের মধ্যে পানের উপযোগী গুণসমূহ যদি বর্তমান থাকে, তাকেই পানীয় জল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

পানীয় জলের অভাব জনিত সমস্যা:

মানব সভ্যতা প্রত্যেকদিন প্রতিমুহূর্তে অসংখ্য ছোট-বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবে সেই সকল সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয় সেই মানব সভ্যতাই। মানবজাতির কাছে এমনই একটি জ্বলন্ত সমস্যা হল পর্যাপ্ত পানীয় জলের অভাব। পানীয় জল মানুষের বেঁচে থাকার প্রধানতম উপকরণ।

কিন্তু প্রকৃতির উপর মানুষের যথেচ্ছাচার এবং অনিয়ন্ত্রিত শোষণের ফলে আজ পৃথিবীর পানীয় জলের ভাণ্ডার অনেকখানি নিঃশেষিত এবং যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তার এক বিশাল অংশ বিশেষভাবে দূষিত।

পানীয় জলের অভাব জনিত এই সমস্যা দূরীকরণের জন্য প্রতিমুহূর্তে বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য বিজ্ঞানীরা নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে চলেছেন। তার মধ্যেই উল্লেখযোগ্য একটি হলো অবশিষ্ট জলকে দূষণমুক্ত করার প্রচেষ্টা। সেই দূষক পদার্থের অধিকাংশই আর্সেনিক। 

আর্সেনিক প্রাদুর্ভাব:

পৃথিবীতে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে যেসব মৌলগুলি অবস্থান করে, আর্সেনিক তাদের মধ্যে ২০তম। ইতিহাসে সর্বপ্রথম আর্সেনিকের উল্লেখ পাওয়া যায় রোমান সম্রাট নিরোর যুদ্ধকৌশলে। তিনি যুদ্ধে তাঁর শত্রুদের নিধনের জন্য আর্সেনিক-এর ব্যবহার করেছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায় পদার্থ হিসেবে মানুষের জন্য আর্সেনিক কতখানি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। প্রসঙ্গত ভূপৃষ্ঠে আর্সেনিক থাকে বিভিন্ন ধাতব পদার্থের মধ্যে।

বেশ কিছু কারণে সেই ধাতব পদার্থ ভূ-অভ্যন্তরের জলের সাথে মিশে বিশেষভাবে দূষণ ঘটায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রা অনুযায়ী পানীয় জলে সর্বাধিক ১০ পিপিবি ০.১ মাইক্রো গ্রাম প্রতি লিটার আর্সেনিক থাকতে পারে। এর অধিক মাত্রায় আর্সেনিক পানীয় জলে থাকলে তাকেই আর্সেনিক প্রাদুর্ভাব বলে ধরে নিতে হবে। সেইখানে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের জলে আর্সেনিকের যে সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া গিয়েছে তা হল ৩৮,০০০ মাইক্রোগ্রাম/লিটার।

আর্সেনিক দূষণের কারণ:

পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তবে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আর্সেনিক দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে উঠে আসে অগভীর নলকূপ এবং ভূগর্ভস্থ জলের অনিয়ন্ত্রিত শোষণের কথা। এই সমস্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অগভীর নলকূপ এবং পাম্পের মাধ্যমে কৃষিকাজে জলের ব্যবহার হওয়ায় নলকূপ ও পাম্পের টানে আর্সেনিকের বিষ মেশে ভূগর্ভস্থ জলে।

তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে বন্যায় প্লাবিত নানা অঞ্চলে আর্সেনাইট যৌগ গুলির আধিক্য দেখা দিলে সেখানেও জলে আর্সেনিক দূষণ ব্যাপক সম্ভাবনা থেকে যায়। এছাড়া খরার সময় অতিরিক্ত তাপে বাষ্পীভবনের ফলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমলে আর্সেনাইট যৌগ গুলির আধিক্য দেখা দেয় এবং তা জলে মেশে।

পানীয় জলে আর্সেনিকের ফলাফল:

পানীয় জলে আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব ঘটলে তা ব্যাপকভাবে হানিকারক হতে পারে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সকল মানুষের জন্য। আর্সেনিকের দ্বারা দূষিত জল দীর্ঘকাল গ্রহণ করলে বেদনাদায়ক মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণের কারণে মৃত্যুর প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে।

নৃতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে প্রমাণ হয়েছে যে আজ থেকে প্রায় ছয়-সাত হাজার বছর আগে চিলিতে পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণের কারণে অসংখ্য মানুষ বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যু হয়েছিল। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় কুড়িটি দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণের ফলে জর্জরিত।

আরো আশঙ্কার কথা এই যে এই দেশ গুলির মধ্যে উপরের দিকে রয়েছে এশিয়া মহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, চীন, তাইওয়ান, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম প্রভৃতি উন্নয়নশীল দেশগুলি। তবুও এইসব দেশে এখনো ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার তথা যথেচ্ছাচার অব্যাহত। যার ফলে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের শরীরে বাসা বাঁধে দূষণজনিত নানা মারণ রোগ এবং এদের মধ্যে বহু মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

প্রতিকারের উপায়:

পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণ খুব সহজেই রোধ করা সম্ভব। তবে এই প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন সমাজের প্রতিটি স্তরে আর্সেনিক প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে যথাযথ সচেতনতার। আধুনিক গবেষণার ফলে দেখা গিয়েছে বেশ কয়েকটি পদ্ধতি দ্বারা পানীয় জলকে আর্সেনিক মুক্ত করা সম্ভব হতে পারে। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারটি হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের দ্বারা।

তাদের আবিষ্কৃত এই পদ্ধতিটি অত্যন্ত সরল এবং সাশ্রয়ীও বটে। এছাড়াও অল্প দিনের জন্য জলকে আর্সেনিক মুক্ত করার প্রয়োজনে তিনটি মাটির পাত্র দ্বারা তৈরি ফিল্টারও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এসবের জন্য মানুষকে সর্বপ্রথম আর্সেনিক দূষণ এবং এর ব্যাপক ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। আর্সেনিক দূষণের কবলে পড়া সকল দেশের সকল সরকারই এই উদ্দেশ্যে বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

উপসংহার:

পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণ পৃথিবীর সমগ্র মানব জাতির জন্য একটি ব্যাপক সমস্যা। অবিলম্বে এই সমস্যার সমাধান করতে না পারলে সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। জলের অভাব মানব জাতিকে মুছে দিতে পারে, আর দূষিত জল পান মানবজাতিকে দিতে পারে চরম বেদনাদায়ক মৃত্যু।

তাই বিশ্বের প্রয়োজনে, সভ্যতার প্রয়োজনে আমাদের সকলকে ব্রতী হতে হবে পানীয় জলে আর্সেনিক মুক্ত করার প্রয়াস এবং সচেতনতার প্রসারে। পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে জলের সেই নির্মল বিশুদ্ধ রূপ; যা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে পরম তৃপ্তি লাভ করবে তৃষ্ণার্ত মানুষেরা।


উপরিউক্ত রচনাটিতে যথাসম্ভব বিশদভাবে আমরা পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণ সম্পর্কিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। এ প্রসঙ্গে যতগুলি দিকের ওপর আলোকপাত করা দরকার, সেগুলিও উক্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভালো লেগেছে। এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্ট এর মাধ্যমে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন