পরিবেশ পরিষেবায় অরণ্য রচনা [সঙ্গে PDF]

অরণ্য হল পরিবেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং প্রাণী জগতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু। অরণ্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে এই পৃথিবীতে রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত অবর্ণনীয় অবদান রেখে চলে। তাই আমরা সকলে অরন্যের কাছে চিরঋণী। এই ঋণ শোধ করার উপায় মানুষের নেই। তবে উপায় আছে বর্তমান যুগে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা অরণ্য ধ্বংসকে রোধ করবার।

অরণ্য ধ্বংসের ফলে যাতে সভ্যতার সংকট নেমে এসে সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে না পারে, তার জন্য প্রয়োজন পরিবেশ পরিষেবায় অরন্যের অবদান সম্পর্কে সার্বজনীন সচেতনতার। সেই সচেতনতা প্রসারের একটি সামান্য উদ্যোগ হিসেবে আমাদের আজকের প্রতিবেদনটির উপস্থাপনা।

পরিবেশ পরিষেবায় অরণ্য রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

পৃথিবীতে প্রকৃতির আদিমতম সৃষ্টি হল অরণ্য। অরণ্য আদিম, তাই অরণ্য শাশ্বত আর সুন্দর। অরন্যের সৃষ্টির পর থেকে এ বিশ্বে যা কিছু গড়ে উঠেছে তার সবকিছুই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অরন্যের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি পৃথিবীও তার নিজের বর্তমান রূপ বজায় রাখার জন্য সম্পূর্ণরূপে অরন্যের ওপর নির্ভর করে থাকে। তাই অরণ্য হল সৃষ্টির ধারক তথা বাহক।

কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর তথাকথিত স্বঘোষিত উন্নত জীব মানুষের লোলুপ দৃষ্টির গ্রাসে অরণ্য পড়ছে অস্তিত্ব সংকটে। এই অস্তিত্ব সংকট যে অচিরেই বিশ্ব প্রাণের অস্তিত্ব সংকট ডেকে আনবে তা অনুধাবন করতে পেরেছেন পৃথিবীর সকল সুধীজনেরা। তাই বর্তমানে পরিবেশ পরিষেবায় অরন্যের ভূমিকার কথা আলোচনা একান্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

অরণ্য ও প্রাণী জগৎ:

অরণ্য প্রাণী জগৎ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে প্রাণীজগৎ বিকাশ লাভ করেছে একান্ত অরন্যের ওপর নির্ভর করেই। বিশ্ব সৃষ্টির এতোকাল পরেও সকল প্রাণীরাপ্রয়োজনে প্রত্যক্ষভাবে নির্ভর করে অরন্যের ওপর। তা খাদ্য হোক বা বস্ত্র কিংবা বাসস্থান, সবকিছুর জন্যই প্রাণীদের পরম ভরসা হলো অরণ্য। সর্বোপরি অরন্যের দান করা অক্সিজেন গ্রহণ করে প্রাণীরা শ্বাসকার্য চালায়।

সে কারণে অরণ্য ব্যতীত পৃথিবীতে প্রাণীদের অস্তিত্ব কল্পনা করাই সম্ভব নয়। আর মানুষের সঙ্গে অরণ্য সম্পর্ক অত্যন্ত আদিম কথা সুন্দর। মানুষ আদিতে অরন্যের বড় বড় বৃক্ষের কোটরে জীবন যাপন করেছে, বৃক্ষের ফল খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেছে, গাছের ছাল বাকল হয়েছে মানুষের লজ্জাবস্ত্র। সময়ের সাথে সভ্যতা যতই উন্নতি লাভ করুক না কেন, অরন্যের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা এতটুকুও কমেনি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। আর অরণ্যও পরম বন্ধুর মতন নিজেকে উজাড় করে দিয়ে মানুষের সব চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। তাই মানুষ চিরকাল অরন্যের কাছে ঋণী। 

জীবিকা উপার্জনে অরণ্যের ভূমিকা:

ইতিপূর্বেই অরণ্যের কাছে মানুষের ব্যাপক চাহিদার কথা আলোচনা করা হচ্ছিল। এই সমূহ চাহিদার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো মানুষের জীবিকা উপার্জনের তাগিদ। জীবনধারণের জন্য জীবিকা উপার্জনের প্রয়োজনে সকল মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অরন্যের ওপর নির্ভর করে।

যে মানুষটি অরণ্য থেকে কাঠ, ফলমূল কিংবা মধু সংগ্রহ করে জীবন যাপন করে, শুধুমাত্র সে ই অরন্যের ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং যে মানুষটি অফিসের টেবিলে বসে ঠাণ্ডা ঘরে অনবরত কাগজের উপর কলমের আঁচড় কেটে চলেছেন, তিনিও সমানভাবে তার জীবিকার প্রয়োজনে অরন্যের ওপর নির্ভরশীল।

তার কারণ হলো এই পৃথিবীর এমন কোন উপাদান নেই যা অরন্যের অবদান ছাড়া তৈরি হয়েছে। তাছাড়া পৃথিবীর বহু মানুষ এখনো প্রত্যক্ষভাবে তাদের জীবিকার প্রয়োজনে অরন্যের ওপর নির্ভর করে থাকে। আর পরোক্ষ নির্ভরশীলতার উদাহরণ স্বয়ং এই মানবজাতি। 

ওষুধ তৈরিতে অরণ্য:

অরণ্য হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম চিকিৎসক। মানুষ যখন অরন্যের কোলে একান্ত নিরাপদ আশ্রয়ে বসবাস করত, সেই সময় যখন মানুষ নানা ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হত, তখন সেই রোগ নিরাময়ের জন্যও তারা নির্ভর করত অরন্যের ওপরেই। এইভাবে ধীরে ধীরে জ্ঞানচর্চার ফলে গড়ে ওঠে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, যে শাস্ত্র বিভিন্ন গাছ গাছড়া দ্বারা রোগমুক্তির বিষয়ে বিশেষ আলোচনা করে থাকে।

তাছাড়া বর্তমানে অসংখ্য ওষুধ তৈরির সংস্থা বিভিন্ন উন্নত মানের ওষুধ তৈরির জন্য নির্ভর করে থাকে অরন্যের ওপর। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এই ধরনের ভেষজ ঔষধি সমন্বিত অরন্যের গাছপালাকে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে এই সকল গাছপালা সম্পর্কে সচেতনতা এত বেশি, যে সাধারণ মানুষের জন্য আলাদা করে আইন প্রণয়নেরও খুব একটা প্রয়োজন হয় না।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে অরণ্য:

অরণ্য পৃথিবীর নানা ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে বিশেষ ভাবে সাহায্য করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বন্যা এবং অনাবৃষ্টির কথা উল্লেখ করা যায়। ব্যাপক বন্যার মূল কারণ হলো ভূমিক্ষয়। অরণ্য তার শিকরবাকড় দ্বারা ভূমিকে আপ্রাণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রাখে। এইভাবে ভূমিক্ষয় রোধের মাধ্যমে অরণ্য বন্যার ভয়াবহ রূপকে বাধা প্রদান করতে পারে।

আবার অন্যদিকে অনাবৃষ্টি কিম্বা খরার প্রধান কারণ রূপে অরন্যের অপ্রতুলতাকেই চিহ্নিত করা যায়। যেসব স্থানে অরন্যের মাত্রা যত কম, সেই সব জায়গায় অনাবৃষ্টি কিংবা খরার হার তত বেশি। অরণ্য জলাভূমি থেকে জলীয় বাষ্প হয়ে উঠে আসা মেঘকে আকাশের বুকে ঘনীভূত করে এবং বৃষ্টিপাত ঘটায়।

ফলে পৃথিবী খরা কিংবা অনাবৃষ্টির মতন দুর্যোগ থেকে রক্ষা পায়। এছাড়া অরন্য হল অসংখ্য স্থলচর এবং খেচর প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল। এই সকল প্রাণীরা তাদের জীবনধারার মাধ্যমে সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই অরণ্যের অপ্রতুলতা যদি এদের অস্তিত্বকে সংকটের সম্মুখীন করে, তাহলে পৃথিবীর ভারসাম্যকেও সংকটের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।

অরণ্য এবং দূষণ:

বর্তমান পৃথিবীতে কোন দেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাহলো পরিবেশ দূষণের নিয়ন্ত্রণ করা। বিশ্বের সভ্যতার অগ্রগতির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি যেমন ঘটেছে, তেমনি সমগ্র বিশ্বজুড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে দূষণের মাত্রাও। পৃথিবীর কোন কোন স্থানে এই দূষণের মাত্রা এতই ব্যাপক ও তীব্র যে সেখানকার বায়ুকে বিজ্ঞানীরা বসবাসের অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন।

অরণ্য বাইরে থেকে এই সকল বিষাক্ত ও দূষিত পদার্থ কে অপসারিত করতে ব্যাপক ভাবে সাহায্য করে থাকে। মানুষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে অরণ্য তার খাদ্য তৈরীর নিমিত্ত শোষণ করে এবং পরিবর্তে পরিবেশের বুকে ছড়িয়ে দেয় বিশুদ্ধ অক্সিজেন। এভাবেই মানুষের সভ্যতার বোঝা ক্রমাগত অরণ্য নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে চলে।

অরণ্য ও বর্তমান পৃথিবী:

পৃথিবীর সাথে অরণ্য সম্পর্ক আদিমতম হলেও, বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের সাথে অরন্যের সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয়। মানুষ নিজের জীবনে তার এই পরম বন্ধুর অসামান্য অবদানকে ভুলে গিয়ে সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নির্বিচারে অরণ্য ছেদন করে চলেছে। পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুবিশাল বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমি।

এইসকল অরণ্য পরিচয় পায় পৃথিবীর ফুসফুস রূপে। তাদের নির্বিচার হত্যালীলা যে আদপে মানুষের অস্তিত্বের সংকটই ডেকে আনবে, সেকথা সমাজের সিংহভাগ মানুষ এখনো অনুধাবন করতে পারেনা। তবে আশার কথা এই যে পৃথিবীর অসংখ্য পরিবেশ সচেতন সুধীজনেরা সভ্যতাকে রক্ষার নিমিত্ত অরণ্য ছেদনের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। সে কারণে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল মাত্রায় হলেও অরণ্য ধ্বংসের বিষয়ে সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

উপসংহার:

অরণ্য হল প্রাণিজগতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু। মানুষ যদি নিজেকে এই প্রাণী জগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব বলে মনে করে, তাহলে তার অরন্যের ব্যাপারে অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। কারণ তা না হলে কখন যে অচিরেই আপন উন্নত সভ্যতার পতন মানুষ নিজেই ডেকে আনবে, তা সে বুঝতেই পারবে না। পৃথিবীতে সভ্যতার প্রয়োজনে অরন্যের প্রাসঙ্গিকতা অনুভব করে জনৈক দূরদর্শী লেখকদের কলমে লিখিত হয়েছিল-

“বৃক্ষ নেই প্রাণের অস্তিত্ব নেই বৃক্ষহীন পৃথিবী যেন প্রাণহীন মহাশ্মশান”।।


সংক্ষেপে এই ছিল পরিবেশ পরিষেবায় অরন্যের অবদান। আলোচ্য বিষয়টি সম্পর্কে পরিবেশ পরিষেবায় অরণ্য শীর্ষক প্রবন্ধে আমরা চেষ্টা করেছি সবকটি দিককে যথোপযুক্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরার। তাছাড়া পরীক্ষার প্রয়োজন অনুযায়ী উক্ত প্রবন্ধটিতে আমরা একটি সাধারণ শব্দসীমা বজায় রাখারও যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।

উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন