পদ্মা সেতু রচনা [সঙ্গে PDF]

সেতু বলতে প্রাথমিকভাবে বোঝায় একটি যোগাযোগের মাধ্যমকে যা প্রাকৃতিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি স্থানকে যুক্ত করে সেখানকার সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজতর করে। বাংলাদেশে সদ্য নির্মিত পদ্মা সেতুর গুরুত্ব সমগ্র দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অপরিসীম। তাই আমাদের আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা এই সেতুর সকল দিক সম্পর্কে নির্দিষ্ট শব্দের বন্ধনীতে সহজ ভাষায় আলোচনার চেষ্টা করব।

পদ্মা সেতু রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা

সেতু বা ব্রিজ হল মানবজাতির তৈরি এমন এক যোগাযোগ পরিবহন মাধ্যম যা পৃথিবীর এক প্রান্তকে অন্য প্রান্তের সাথে যুক্ত করে অনায়াসেই। ইতিহাসের আদিকাল থেকে মানুষ পরিবহনের প্রয়োজনে নির্মাণ করেছে অসংখ্য সেতু। এরমধ্যে বিভিন্ন সেতু ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে হয় তাদের অসামান্য নির্মাণশৈলীর কারণে, নয়তো তাদের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে।

এমনই একটি ঐতিহাসিক সেতু হল আমাদের বাংলাদেশের গর্ব এবং সমগ্র দেশবাসীর অসংখ্য আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু পদ্মা সেতু। নির্মাণশৈলী হোক কিংবা আর্থসামাজিক গুরুত্ব: সকল দিক থেকেই পদ্মা পদ্মা সেত সেতুর ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে অসংখ্য টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে গিয়েও বাংলাদেশ উন্নতির পথে যেসব মাইল ফলক স্থাপন করেছে তারই মধ্যে নবতম সংযোজনটি হল পদ্মা সেতু। 

পদ্মা সেতুর প্রাথমিক বিবরণ

পদ্মা সেতু বা পদ্মা বহুমুখী সেতু হলো ভারতের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক তথা রেল সেতু। এই সেতুটির দ্বারা বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজংগের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়। এই সেতুটি অদ্যবধি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল নির্মাণ প্রকল্প। এই সেতুটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইস্পাত এবং কংক্রিট দ্বারা নির্মিত হয়েছে।

সেতুর উপর স্তরে চার রাস্তার সড়ক পথ এবং নিজের স্তরে উন্নত মানের আধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা নির্মিত একক রেলপথ বর্তমান। পদ্মা ব্রহ্মপুত্র মেঘনা নদীর অববাহিকায় তৈরি মোট ৪১ টি স্প্যান দ্বারা গঠিত। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুটি সমগ্র বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু হবার সাথে সাথে গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতুও বটে। সর্বোপরি প্রায় ১২০ মিটার গভীরতার কারণে পদ্মা সেতু বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতুর খেতাবও অর্জন করে নিয়েছে। 

ইতিহাস

পদ্মা সেতুর নির্মাণ সংক্রান্ত পরিকল্পনা বিষয়ক ইতিহাস বেশ অনেকটাই পুরোনো। আজ থেকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে ১৯৭১ সালে জাপান থেকে আগত জরিপ বিশেষজ্ঞদের একটি দল তবে ইনকাম পূর্ব পাকিস্তানের কাছে ঢাকা ফরিদপুর সড়ক নির্মাণের জন্য একটি সম্ভাব্য খসড়া জমা দেয়। পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনাও এই খসড়ারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিলেও তারা মৃত্যুর কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি।

এরপর ১৯৯৯ সালে জুলাই মাস নাগাদ সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে ২০০৪ সালে শেষ করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এর জন্য বিদেশি এবং জাতীয় উভয় উৎস থেকে অর্থ যোগান দেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয়েছিল।  তবে নানা কারণে এই পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি। অবশেষে ২০০৮ সালে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্দেশ্যে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে।

তবে ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্ব ব্যাংক এই ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। এরপর ২০১৪ সালে এই বহুমুখী সেতুটি নির্মাণে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সাথে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ অপর একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং এর পরের বছর প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন হয়।

পরিকল্পনা ও নির্মাণশৈলী

পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ নকশা তৈরীর দায়িত্ব দেওয়া হয় এইসিওএম এর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দলকে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়।

সেতুর নির্মাণ কাজকে মূলত চারটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়: যথা: মূল সেতু, নদী শাসন, জাজিরা সংযোগকারী সড়ক, এবং টোল প্লাজ। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল নকশা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ তদারক করত। এই পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি। পদ্মা সেতুর মোট ৪১ টি স্প্যানের প্রত্যেকটি লম্বায় ১৫০.১২ মিটার এবং চৌড়ায় ২২.৫ মিটার। 

নির্মাণের পথে প্রতিকূলতাসমূহ

যেকোনো অসামান্য নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়িত করার পথে অসংখ্য বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতেই হয়। বাংলাদেশের গর্ব পদ্মা সেতুও তার ব্যতিক্রম নয়। পদ্মা সেতুর নির্মাণের পথে প্রথম যে প্রতিকূলতাটির সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা ছিল পাইলিং এর সমস্যা। প্রথমদিকে সেতু নির্মাণকারী ইঞ্জিনিয়ার এবং বিশেষজ্ঞদের নদীর তলদেশের মাটি খুঁজে পেতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।

স্বাভাবিক মাটি না পাওয়া গেলে নদীর তলদেশে স্ক্রীন গাউনটিং পদ্ধতিতে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটির বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাথা  হয়। অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে সেতুর নির্মাণ ব্যয়ও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাংলাদেশ সরকার এই উদ্দেশ্যে সেতু কর্তৃপক্ষকে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণদান করে। সেতু নির্মাণের খরচ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিনিয়ত উঠে আসা নিত্যনতুন সমস্যা এবং মুদ্রাস্ফীতিকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। 

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন

দীর্ঘ পরিকল্পনার পর অসংখ্য প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অবশেষে ২০২১ সালের শেষ দিক নাগাদ পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর ২০২২ সালে শুরুর দিকে শেষ কিছু কাজ সম্পন্ন করে পদ্মা সেতুকে উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত করে তোলা হয়। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাংলাদেশে ব্যাপক উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল।

বাংলাদেশের প্রতিটি অংশ থেকে হাজার হাজার মানুষ স্বপ্নের এই সেতুর উদ্বোধনের সাক্ষী হতে পাড়ি জমিয়েছিলেন পদ্মাপারে। অবশেষে ২০২২ সালের ২৫ শে জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন। তারপরের দিন থেকেই সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান ও জঙ্গি হেলিকপ্টার বিশেষ মহড়া প্রদর্শন করে।

বিভিন্ন দেশ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা আসে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে। তবে উদ্বোধনের পর জনসাধারণের উন্মাদনার প্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এমনকি প্রথম দিন সড়ক দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হলে পদ্মা সেতুতে পার্কিং, যানবাহন থামানো, পায়ে হেঁটে পার হওয়া, এবং মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। 

পদ্মা সেতুর আর্থসামাজিক গুরুত্ব

সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর গুরুত্ব ব্যাপক। দেশের দীর্ঘতম এই সেতুটি একদিকে মানুষের যাতায়াতকে যেমন সহজতার করবে, তেমনি করবে দ্রুততর। অন্যদিকে জলপথে পরিবহনের ওপর থেকে অত্যধিক চাপ কমিয়ে সংশ্লিষ্ট পথের দীর্ঘকালীন সমস্যা হিসেবে পরিচিত যানজট কমিয়ে আনবে।

ফলে বাংলাদেশের মোট এলাকার প্রায় ২৯ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে তিন কোটিরও অধিক জনগণ এই সেতুটির দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে লাভবান হবেন। অন্যদিকে এই সেতুর দ্বারা বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবহনও বিশেষভাবে লাভবান হবে। ধারণা করা হচ্ছে এই সেতুটি নির্মাণের ফলে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।

উপসংহার

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের স্বপ্নের সেতু; সমগ্র দেশবাসীর আত্মার শক্তি নিহিত আছে যে সেতুর নির্মাণে। অসংখ্য প্রতিকূলতা পেরিয়ে এই সেতু নির্মাণ কাজ সফল হওয়ার পর সমগ্র বাংলাদেশী জনগণের উন্মাদনা তাই খুব স্বাভাবিক। বিশেষজ্ঞদের মতে নিকট ভবিষ্যতেই পদ্মা বহুমুখী সেতুটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ধরা দেবে। তাছাড়া অসামান্য স্থাপত্য পরিকল্পনার কারণে সমগ্র দেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে পদ্মা সেতু হয়ে থাকবে চিরস্মরণীয়। 


উপরিউক্ত প্রতিবেদনে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সকল দিকে যথাসম্ভব সুসংহতভাবে আলোকপাত করেছি। আশা করি আমাদের এই প্রতিবেদন আপনাদের ভাল লেগেছে। এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনাদের মতামত নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের অন্যান্য প্রতিবেদন পড়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটটি ঘুরে দেখার অনুরোধ রইলো।

ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন