কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচনা [সঙ্গে PDF]

সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিংশ শতাব্দীতে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কবি এবং গদ্যকার। তিনি তার জীবনে কাব্যচর্চার পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার দীর্ঘ জীবন ছিল অত্যন্ত বর্নাঢ্য এবং বিতর্কের কন্টক দ্বারা সুসজ্জিত। তার সেই জীবনের সমুদ্রসম গভীরতায় সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

ভারতবর্ষের বুকে পশ্চিমবঙ্গে আধুনিক বাংলা কাব্য আন্দোলন যে মানুষগুলোর চিন্তায় প্রাণ পেয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। দর্শন, কাব্য ও রাজনীতি নিয়ে বর্ণময় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন। এই জীবনে বারবার তিনি মতাদর্শগত দিক পরিবর্তন করেছেন, কখনো কবিতার জগতে হারিয়ে গিয়েছেন, কখনো বা রাজনীতিতে গা ভাসিয়েছেন।

তাঁর জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য অগণিত বিতর্ক। কিন্তু সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে এই বাঙালি কবি ও গদ্যকারের খদ্দরের পাঞ্জাবি পাজামা পরা মাথাভর্তি ঘন কোকড়ানো চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, চোখ চশমা, মুখের বাম দিকে একটা বড় আঁচিল- এই প্রতিচ্ছবি সকল বাঙালি সমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়ে গিয়েছে। তার বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার উদ্দেশ্যে আমাদের এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন:

এই বাঙালি প্রবাদপ্রতিম প্রতিভার জন্ম ১৯১৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে তার মামাবাড়িতে। তার পিতার নাম ছিল ক্ষিতিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মা ছিলেন যামিনী দেবী। পিতা ক্ষিতিশচন্দ্র সরকারের অধীনে আবগারি বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। তার বদলির চাকরি হওয়ার সুবাদে ছেলেবেলা থেকেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন কেটেছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়। এর মধ্যে ছেলেবেলা শুরুর দিকের কিছুকাল তিনি কলকাতায় কাটিয়েছিলেন।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষ্যমতে তার শৈশব কেটেছিল রাজশাহীর নওগাঁয়। ছেলেবেলা থেকেই পাঠ্যবইয়ের থেকে গ্রন্থাগারের বইয়ের প্রতি তার অধিক আগ্রহ ছিল। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার দরাজ মনের মানুষের মধ্যে বড় হয়ে ওঠার পথে তার মনেও স্নিগ্ধ সরলতার সঞ্চার হয়েছিল। 

শিক্ষাজীবন:

যতদূর জানা যায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল রাজশাহীর নওগাঁর মাইনর স্কুলে। সেইখান থেকে তিনি এসে ভর্তি হন কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে। পরবর্তীকালে তার বাকি স্কুল জীবনটা কেটে ছিল সত্যভামা ইনস্টিটিউশনে। এরপর ভবানীপুরের মিত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

স্কুলজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি গান, আবৃত্তি, অভিনয় ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তিনি সমানভাবে দক্ষ ছিলেন। স্কুলজীবন শেষ করে ১৯৪১ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনা অনার্স সহ সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিএ পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ কলেজে উচ্চ শিক্ষা অধ্যয়নের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তবে সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে যুক্ত থাকার দরুন তার এই শিক্ষা বেশিদুর অগ্রসর হতে পারেনি। 

কর্মজীবন:

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবনে বারবার এসেছে অসংখ্য উত্থান পতনের কাহিনী। কিশোর জীবন থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার দরুন অল্প বয়সে স্থায়ী কর্মজীবন বলতে তার কিছু ছিল না। প্রথম জীবনে তার রাজনৈতিক পার্টি নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হলে বেশ কিছুদিন তাকে কারাবন্দি থাকতে হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনে নেমে এসেছিল অসম্ভব অর্থকষ্ট।

এই সময় তিনি একটি নতুন প্রকাশনা সংস্থার অধীনে মাত্র ৭৫ টাকা বেতনে সাব-এডিটরের চাকরি পান। তবে ১৯৫১ সালে সেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি পরিচয় পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার কর্মজীবনে তিনি কিছুকাল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সন্দেশ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদকের কাজও করেছেন। সংক্ষেপে এই ছিল তার পেশাগত কর্মজীবনের বর্ণনা।

রাজনীতি:

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবন ছিল সবথেকে বেশি বর্ণময়। রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ অত্যন্ত অল্প বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর। এই সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদলের সক্রিয় সদস্য রূপে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৩৯ সাল নাগাদ লেবার পার্টির সাথে তার সম্পর্ক হয়।

কিছু গান এই পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত থাকার পর ছাত্রনেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি লেবার পার্টি ত্যাগ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সংস্পর্শে আসেন। তবে ১৯৪৮ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে তাকে অন্যান্য অসংখ্য রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে কারাবরণ করতে হয়।

১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবার পরও সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে যান তার পুরনো পার্টিতেই। এরপর ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হলে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য কারাবরণ করেন। ১৯৫১ গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর বজবজ এলাকার শ্রমিকদের সংগঠনের সঙ্গে যোগ দিয়ে তিনি তৃণমূল স্তরের রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েছিলেন।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়:

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে শিল্পীসত্তার আত্মপ্রকাশ অত্যন্ত শিশু বয়সে। কলকাতার বিভিন্ন স্কুলে পড়াকালীন নানা ছোটদের ম্যাগাজিনে তার বিভিন্ন রচনা নানা সময় প্রকাশিত হতো। একজন কবি হয়ে ওঠার পথে অনুপ্রেরণা হিসেবে সুভাষ মুখোপাধ্যায় পেয়েছিলেন কবি কালিদাস রায় এবং কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক মুরলীকৃষ্ণ বসুকে।

রাজনৈতিকভাবে কারাবন্দি থাকাকালীন আব্দুর রাজ্জাক খান, চারু মজুমদার, সতীশচন্দ্র পাকড়াশী প্রমূখরাও তার জীবনে অনুপ্রেরণার কাজ করেছিলেন। এই সকল অনুপ্রেরণার বশবর্তী হয়েই সক্রিয় রাজনীতি করার পাশাপাশি তিনি সমগ্র জীবন জুড়ে রচনা করেছেন অসংখ্য কাব্য এবং কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া অন্তরীপ, হ্যানসেনের অসুখ, ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন প্রভৃতি কালজয়ী গদ্য রচনা তার কলম থেকেই বেরিয়েছে।

এছাড়া তিনি রচনা করেছেন ‘চিঠির দর্পণ’ -এর মতন সম্পূর্ণ অপ্রচলিত কাঠামোর উপন্যাস। কবিতা এবং উপন্যাস কিংবা গল্প রচনার পাশাপাশি সুভাষ মুখোপাধ্যায় জীবনে উল্লেখযোগ্য অনুবাদের কাজও করেছেন। তিনি অনুবাদ করেছেন চর্যাপদ, পাবলো নেরুদা এবং হাফিজের কবিতা, অমরুশতক ইত্যাদি। 

রচিত গ্রন্থাবলী:

সুভাষ মুখোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের চল্লিশের দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে পরিচিত। তার লেখায় বারবার ফিরে ফিরে এসেছে বঞ্চিত, বৈষম্য লাঞ্ছিত মানুষের দুর্দশার কথা। ১৯৪০ সালে তাঁর রচিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ পদাতিক -এ মানুষগুলোর কথাই তিনি বার বার উল্লেখ করেছেন।

মানবিক বোধ তথা রাজনৈতিক বাণী ছিল তার কবিতার অন্যতম প্রধান অভিমুখ। তার কাব্যভাষা ছিল সাধারণ মানুষের ভাষা, যা আড়ম্বরহীন। এই আড়ম্বরহীন ভাষাতেই তিনি রচনা করেছিলেন চিরকুটের মতন ফ্যাসিবিরোধী বাংলা কাব্য। কবিতার ছন্দে সাধারন মানুষের ভাষায় তার দৃপ্ত বলিষ্ঠ ঘোষণা জনমানষে অদ্ভুত জোয়ার সৃষ্টি করত।

১৯৪৮ সালে নিজের পার্টির দৈনিকে টাকা তোলার জন্য সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচনা করেছিলেন মাত্র পাঁচটি কবিতার সংকলন অগ্নিকোণ। এই রচনা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন “রাজনীতিকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির জন্য অগ্নিকোণের প্রকাশ।” তাছাড়া এই সকল কাব্যগ্রন্থ ছাড়া কাল মধুমাস, ফুল ফুটুক, একটু পা চালিয়ে ভাই ইত্যাদি তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য রচনা। 

প্রাপ্ত পুরস্কার এবং সম্মাননাসমূহ:

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে অসংখ্য অসম্মানজনক মন্তব্য এবং বিতর্ক সৃষ্টি হলেও সাহিত্যের অঙ্গনে সমগ্র ভারতবর্ষে ব্যাপকভাবে সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান’ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার দ্বারা তাকে ভূষিত করা হয়। এছাড়া ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে আফ্রো-এশিয়ান লোটাস প্রাইস, ১৯৮৪ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৯২ সালে ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার দ্বারাও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ভূষিত হয়েছিলেন।

তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম লাভ করেছিলেন। এইসব পুরস্কার ছাড়াও তাকে নিয়ে তার জীবদ্দশায় এবং জীবনত্তোর কালে অসংখ্য লেখালেখি ও গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্মানার্থে তার কাব্যগ্রন্থ পদাতিকের নামানুসারে ২০০৯ সালে শিয়ালদা নিউ জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেস এর নাম বদল করে রাখা হয় পদাতিক এক্সপ্রেস। এছাড়া ২০১০ সালে কলকাতা মেট্রো নিউ গড়িয়া স্টেশনটি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নামে উৎসর্গ করে ‘কবি সুভাষ’ নামকরণ করে 

উপসংহার:

সমগ্র জীবন জুড়ে অসংখ্য রাজনৈতিক আন্দোলন এবং কাব্য রচনার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করলেও বিতর্ক কোনদিন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পিছু ছাড়েনি। আধুনিক যুগে বাংলার এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক যকৃত এবং হৃদপিন্ডের সমস্যার কারণে দীর্ঘকাল অসুস্থতার পর ২০০৩ সালে কলকাতায় পরলোকগমন করেন।

কবি সুভাষ ছিলেন অশান্ত সময়ের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর। তিনি কোনদিন সময়ের স্রোতে গা ভাসাননি। সব সময় নিজের যুক্তি দিয়ে যেটাকে ঠিক বলে মনে করেছেন, সেটাকে নিজের সবটুকু দিয়ে পালন করেছেন। যেমন সত্তরের দশকে যখন অসংখ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা নকশাল আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল, তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায় সেই প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে গিয়ে এই উগ্রপন্থী আন্দোলনের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু তা বলে তাতে তার বামপন্থী রাজনৈতিক মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তার কলম থেকে উচ্চারিত হয়েছে-

“বাঁয়ে চলো ভাই,
বাঁয়ে-
কাল রাত্রির বুক চিরে,
চলো 
দুহাতে উপড়ে আনি
আমাদেরই লাল রক্তে রঙিন সকাল।”


কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে যতগুলি দিক আলোচনা করা সম্ভব তার সবকটি আমরা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। আশা করি এই প্রতিবেদনটি আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।

উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন