একটি রাজপথের আত্মকথা রচনা [সঙ্গে PDF]

আমাদের প্রতিদিনের যাওয়া আসার ব্যাস্ত পথ তার অন্তরে ইতিহাসের কত স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে তা শুধু সে একাই জানে। মাটির রাস্তা থেকে শহরের ব্যাস্ত রাস্তা হয়ে ওঠার দীর্ঘ সময় কত পরিবর্তনেরই না সাক্ষী রয়েছে সে। একটি প্রাচীন রাজপথের নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে আজকের আলোচ্য বিষয় একটি রাজপথের আত্মকথা রচনা বা একটি রাস্তার আত্মকথা রচনা।

একটি রাস্তার ছবি

ভূমিকা:

আমি এই কলকাতা শহরের বুকে সুবিস্তৃত এক রাজপথ। সেই কোন সুদীর্ঘকাল ধরে হাজার রকম ওঠাপড়া, ভাঙ্গাগড়ার নিয়ত নীরব সাক্ষী আর এই মহাকালের বুকে থমকে থাকা সময়ের অদম্য প্রহরী আমি। সত্যিই যেনো সময় আমার ধুলোতে এসে থমকে দাঁড়ায়। দিন কেটে যায়, ঘটে চলে নানা ঘটনা; কিন্তু সময়ের সকল রূপ ধরা থাকে আমার কঠিন কঠোর শরীরে।

তারা আমার সাথে কথা বলে, প্রতিনিয়ত বয়ে চলে আমার জীবনের সাথে। এ দীর্ঘ জীবনে কত ঘটনাই না চোখের সামনে দেখেছি ঘটতে, কতবার আমার বুকে তৈরি হয়েছে কত ক্ষত, কতবার মানুষ এসে প্রলেপ দিয়েছে সেই ক্ষতের ওপর; তার হিসাব রাখতে পারিনা। তবে আজ সময় হয়েছে মহাকালের বুকে ইতিহাসের সাক্ষ্য দেবার।

তাই জীবনের রঙ্গমঞ্চে নীরবতা ভেঙেছে আমারও। এই রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার এ শুষ্ক কঠিন-কঠোর জীবনের প্রাণময় নানা কাহিনী শুনিয়ে যাব অতি সংক্ষেপে। এই কাহিনীর চরিত্র অগণিত হতে পারে, তবু এ গল্প একান্তই আমার। আমি, সকলের পরিচিত বয়সের ভারে বৃদ্ধ এক রাজপথ।

আমার জন্ম:

বাইরে থেকে বাহ্যিকভাবে আমায় দেখতে এত কঠিন কঠোর মনে হলেও, আমার শরীরের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে আছে সবুজ ঘাস, কচি পাতার কোমল ইতিহাস। আমার বুক জুড়ে পিচের গরম অন্ধকার প্রলেপ পড়বার আগে, আমি ছিলাম মানুষের পায়ে হাঁটা এক মেঠো পথ। তারপর মহাকালের নিয়মে একদিন আমার বুকে বাড়লো মানুষের চলাচল, চলল মোটরগাড়ি।

আর আধুনিকতার প্রয়োজনে মেঠো পথ থেকে আমি আরো চওড়া হলাম, বুকে কংক্রিটের প্রলেপ নিয়ে তৈরি হলো রাজপথ। যখন আমি মেঠো রাস্তা ছিলাম তখন আমার চারপাশ জুড়ে ছিল বৃক্ষরাজির সাজসজ্জা, অনতিদূরে ঘন জঙ্গল, তাতে পাখিদের কোলাহল।

কিন্তু আধুনিকতার প্রয়োজনে বৃক্ষরাজি নিজেদের প্রাকৃতিক সজ্জা ছেড়ে পড়ে রইল সভ্যতার প্রসাধনের অলংকার রূপে। সময়ের সাথে সাথে বিদায় নিল আমার চিরচেনা ঘন জঙ্গল; পাখিদের কলতানও তাই আজ বহুকাল হলো আর শোনা যায় না। এমন ভাঙ্গা-গড়া, ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়েই আমার জন্ম।

স্মৃতির পাতায় অতীত রূপ:

আমার ওপর দিয়ে যখন বয়ে চলে অনন্ত অসীম ঘটনার স্রোতপ্রবাহ, তার প্রত্যেকটি অক্ষর লেখা হয়ে যায় আমার স্মৃতির পাতায়। এই স্মৃতি অল্পসময়ের নয়, বরং তা দীর্ঘকালের দীর্ঘদিন ধরে অগণিত ঘটনাপ্রবাহের ছাপ পড়তে পড়তে তৈরি হওয়া এক রাজপথের জীবনের অনন্ত শাশ্বত অভিজ্ঞতা।

এই অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি আমার বুকের উপর পালকি চলতে, ঘোড়ার গাড়ি চলতে। তারপর সময়ের নিয়মে এসেছে মোটরগাড়ি, আমার বুকে খোদাই হয়ে বসেছে কঠিন ইস্পাতের ট্রাম লাইন। আমার অভিজ্ঞতায় আমি নানা শাসকের উত্থান দেখেছি, পতন দেখেছি; অত্যাচারীর লাল চোখের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মরণপণ সংগ্রাম দেখেছি। ভাইয়ে ভাইয়ে, বন্ধুতে বন্ধুতে লড়াই দেখেছি; আবার চরম শত্রুদের মধ্যে দেখেছি পরম মিলন।

আমার শরীরের উপর ঘটে চলা অগণিত ঘটনা যেমন প্রভাবিত করেছে হাজার হাজার মানুষের জীবনকে, তেমনি এই সকল ঘটনাপঞ্জী নিয়েই গড়ে উঠেছে আমার জীবন। এই কঠিন-কঠোর বুকে কোন আনন্দের ঘটনার উচ্ছ্বাসে আমি যেমন উচ্ছ্বসিত হয়েছি, তেমনি নানা হৃদয়বিদারক ঘটনার মর্মস্পর্শে রক্ত ঝরেছে আমারও। এভাবেই সময়ের প্রবাহে ঘটে চলা নানা অভিজ্ঞতা স্মৃতির পাতায় সঞ্চয় করতে করতে আমি উপনীত হয়েছি বর্তমানে। 

বর্তমানকালের কথা:

অনেক মানুষ বলে থাকে বর্তমান কাল নাকি অস্থির সময়। কিন্তু আমার তা বোধগম্য হয় না। আমি আমার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে দেখেছি মানুষ তাদের বর্তমানকে অস্থির বলে মনে করে, আর অতীতের দিনগুলিকে মনে করে সোনালী। তবে একথা সত্য আজকাল মানুষের মধ্যে আগের মতন আর প্রাণ খুঁজে পাইনা। ঘটনাস্রোতের উত্থানপতন পূর্বের তুলনায় অনেক কমে গেলেও, সবই কেমন যেন আমার মত শুষ্ক আর কঠোর।

মানুষের জীবনে এমন নীরসতা তো বাঞ্ছিত ছিল না। বর্তমানে সভ্যতার তর্জন গর্জন যেন খানিক বেশিই। আজ দেখতে পাই আমার ওপর দিয়ে কলের পুতুলের মত মানুষ চলেছে, বিলাসবহুল গাড়ি চলেছে হুহু করে; তাদের দাঁড়াবার অবকাশ নেই এক মুহূর্তও। সবার চোখে-মুখে কেমন যেন অস্বস্তি আর তীব্র ব্যস্ততা; কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কেন করছে তার খোঁজ যেন তারা নিজেরাই রাখে না।

আমার শরীরের ওপর ছোট-বড় ক্ষতগুলো মেরামত করতে আগের মতন আর সময় লাগে না বটে, তবে মানুষের প্রাণহীনতায়, কাঠিন্যতায়, যান্ত্রিকতায় এই কঠিন রুক্ষ রাজপথের কোমল মনের ভেতর যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তাতে প্রলেপ দেবে কোন মহৌষধ! আমার দুপাশ জুড়ে প্রসাধিত বৃক্ষরাজির অলংকরণও এখন কমে এসেছে। তবু যখন বেঁচে থাকা কোনো বৃক্ষ থেকে কোন একটা রঙিন ফুল আমার এই রক্ষ ত্বকের ওপর ঝরে পড়ে, তখন বুঝতে পারি আজো বেঁচে আছি।

উপসংহার:

আমি আজ বয়সের ভারে বৃদ্ধ হতে পারি, তবে জীর্ণ নই। আমি তো কঠিন-কঠোর; আমার মন যতই কোমল হোক সে মনের ভাব প্রকাশের সামর্থ্য আমায় বিধাতা দেননি। নিজের জন্মকাল থেকে এ পৃথিবীতে আমি কারোর লক্ষ্য নই, সকলের উপায়মাত্র। আমি সকলকে মনে রাখি, কিন্তু কেউ আমায় মনে রাখেনা। জীবনের এক পর্যায়ে নিজেকে হতভাগ্য বলবো নাকি সৌভাগ্যবান, এই ভেবে বিভ্রান্ত হতাম।

তবে অভিজ্ঞতার ভারে বৃদ্ধ হয়ে আজ বুঝতে পারি এ পৃথিবীতে সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য দুইই জীবনের অদ্বিতীয় অংশ। শুধু আজকাল ব্যথিত হই মানুষের প্রাণহীনতা, মূল্যহীনতার বাড়বাড়ন্তে। জীবনের শুষ্কতা আর কাঠিন্য যে কতটা অসহ্যকর হতে পারে, তা আমার থেকে ভালো বোধহয় কেউ জানেনা। তবু বিধাতা আমায় যে ক্ষমতা দিয়েছেন, তার সবটুকু দিয়ে আমার এ প্রাণের শহরের ভার আজীবন বয়ে নিয়ে চলবো আমি; আজ মহাকালের কাঠগড়ায় ইতিহাসের সাক্ষ্য দিতে দাঁড়িয়ে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।


একটি রাজপথের আত্মকথা/একটি রাস্তার আত্মকথা রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন:

একটি বটগাছের আত্মকথা
একটি নদীর আত্মকথা
একটি কলমের আত্মকথা রচনা
Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন