একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা [PDF]

একঘেয়েমি জীবনের অবসরে ঘুরতে যাওয়ার মজাই আলাদা।বছরের বিভিন্ন সময়ে পছন্দ মতো নানান জায়গায় ঘুরতে যায় আমরা।ঘুরতে যাওয়ার আনন্দের সেই সময় গুলোতে নতুন নতুন জিনিস দেখার ,অনেক কিছুর নতুন শেখার অভিজ্ঞতাও হয় আমাদের।সে নিয়েই আজকের বিষয় একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা।

একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

বর্তমান যুগের ব্যস্ততা সর্বস্ব জীবনের ইঁদুর দৌড়ে আমাদের শরীর ও মন যখন রোজকার একই পরিবেশের ক্লান্তি এবং একঘেয়েমিতে ভরে ওঠে, তখন নিত্যদিনের সেই চেনা চারপাশ থেকে আমাদের মন একটুখানি মুক্তির আনন্দের জন্য ছটফট করে। সেই সময় মনকে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম দিতে এবং নিজের ক্লান্তি ও একঘেয়েমি দূর করে জীবনের পরবর্তী ব্যস্ততার জন্য তৈরি হতে প্রয়োজন ভ্রমণের।

ভ্রমণ আমাদের বর্তমান জীবনের এমন একটি অংশ যাকে অস্বীকার করে কোনোভাবেই ভালো থাকা যায় না। ভ্রমণ আমাদের ক্লান্তি ও গ্লানিতে ভরে ওঠা মনকে পুনরায় কোন এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সতেজ করে তোলে। আমি আদ্যোপান্ত একজন ভ্রমণপিপাসু বাঙালি। প্রত্যেক বছর কোথাও-না-কোথাও ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুদিনের মুক্তি খুঁজে নেওয়ার উদ্দেশ্যে আমি ছুটে যাই। তেমনই আমার এই বছরের ভ্রমণ গন্তব্য মোহময়ী সুন্দরবন।

জীবনে ভ্রমণের তাৎপর্য:

জীবনে ভ্রমণের তাৎপর্য বলে শেষ করার মতন নয়। ভ্রমণ আমাদের শরীর তথা মন উভয়কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম। ভ্রমনের ফলে একদিকে আমাদের মন যেমন জীবনের ক্লান্তি ও গ্লানি দূর করে সতেজ হয়ে উঠে, অন্যদিকে আমাদের শরীরও সকল জড়তা কাটিয়ে সতেজতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। এমনকি বিভিন্ন রোগ মুক্তির ক্ষেত্রেও ভ্রমণের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

সে কারণেই প্রাচীন যুগ থেকে এখনো পর্যন্ত চিকিৎসকেরা বহু রোগ থেকে সেরে ওঠে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পূর্বে ভ্রমণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাছাড়া ভ্রমণ মানুষকে চিন্তাশীল হতে শেখায়। শেখায় জীবনের প্রতিকূল অবস্থার সাথে যুঝে নিতে। প্রাচীনকালে রাজারা রাজ্য চালনার ক্ষেত্রে কোন বিশেষ প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হলে মৃগয়ায় যেতেন। এই মৃগয়াতে শিকার অপেক্ষা ভ্রমণের গুরুত্বই বেশি থাকত।

এবারের স্থান নির্বাচন:

যথাযথ স্থান নির্বাচন একটি সুন্দর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লাভের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভ্রমণের স্থান নির্ভর করে ভ্রমণকারীর মানসিক অবস্থা, শারীরিক সক্ষমতা, পারিবারিক পরিস্থিতি, আর্থিক স্বচ্ছলতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর। আমি সাধারণতঃ চিরাচরিত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে প্রকৃতির বুকে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ছুটে যেতেই ভালোবাসি। পাহাড়, নদী, সমুদ্র ও জঙ্গল এই সবই আমার অত্যন্ত পছন্দের বিষয়।

তবে সপরিবারে যাওয়ার হলে বিশেষ চিন্তাভাবনা করে ভ্রমণের স্থান নির্বাচন করতে হয়। এইবার আমার বাড়ির অত্যন্ত কাছে অবস্থিত সুন্দরবনকে ভ্রমণের স্থান হিসেবে আমি বেছে নিয়েছিলাম। এই সুন্দরবন একই সাথে নদী, মোহনা এবং জঙ্গলের এক অপূর্ব সমাহার। তাই কাছাকাছির মধ্যে প্রকৃতির কোলে কয়েকটি দিন কাটানোর জন্য সুন্দরবনের থেকে বেশি উপযুক্ত জায়গা আর কিইবা হতে পারে।

গন্তব্য ও যাত্রাপথ:

আমাদের গন্তব্য সুন্দরবনের যাত্রা শুরু হয় শিয়ালদা স্টেশন থেকে। এইখান থেকে লোকাল ট্রেনে চেপে ক্যানিং স্টেশন হয়ে বাস কিংবা অটোতে আমরা পৌছে গেছিলাম সোনাখালি লঞ্চঘাট। সেখান থেকে লঞ্চে করে সুন্দরবনের বুকে একটু একটু করে আমাদের প্রবেশ শুরু। লঞ্চে ওঠার পর থেকেই মুহূর্তে মুহূর্তে চারপাশের দৃশ্য বদলে যেতে থাকে।

বেশ খানিকটা যাওয়ার পর দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের নাম-না-জানা গাছ, পাখিদের মিষ্টি আওয়াজ নদীর দুপাশ থেকে কানে ভেসে আসে। লঞ্চ থেকে জলের দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম বিখ্যাত গাঙ্গেয় ডলফিন বা চলতি ভাষায় যাকে বলা হয় শুশুক। তারপর লঞ্চ থেকে যখন নামলাম তখন সূর্য প্রায় পশ্চিম গগনে ঢলে পড়ার মুখে। শীতের দিন বলে একটু শীত শীত করতে লাগলো। 

উদ্ভিদজগতের অপরূপ বাহার:

সুন্দরবন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর। আমাদের যে গাইড তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম ভারত-বাংলাদেশ এই দুই দেশ জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায়। এর মধ্যে অধিকাংশই ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদ। পৌঁছনোর পরেরদিন জঙ্গল সাফারিতে বেরিয়ে দেখতে পেলাম ঘন বনের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে মাটিতে।

বিভিন্ন নাম না জানা গাছ, পাখিদের আওয়াজ আর অদ্ভূত এক মায়াবী নিস্তব্ধতা সমগ্র প্রকৃতিকে যেন ঘিরে রেখেছে। এরইমধ্যে শ্বাসমূল আর ঠেস মূল যুক্ত গাছগুলি পরিবেশকে আরো মায়াবী করে তুলেছে। পথে চলতে চলতে চোখে পড়ল বিভিন্ন ধরনের অত্যন্ত সুন্দর সুন্দর সব ফুল আর লতা গুল্ম। গাইডের থেকে শুনলাম এই জঙ্গলে বহু ধরনের ভেষজ উদ্ভিদ পাওয়া যায়। সবচেয়ে মনমুগ্ধকর গাছ গুলির মধ্যে চোখে পড়ল বিখ্যাত সুন্দরী, গরান ও গেওয়া গাছ।

সুন্দরবনের প্রাণীকুল:

সুন্দরবনের জঙ্গলের আরেকটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো এখানকার প্রাণীকুল। সুন্দরবনের স্থলভাগ বিভিন্ন ধরনের প্রাণীদের স্বর্গরাজ্য। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যদিও বর্তমানে বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার দরুন সহজে বাঘ চোখে পড়ে না।

জঙ্গল সাফারির প্রথম দিনে আমরাও বাঘ দেখতে পাইনি। তবে চোখে যা পড়েছিল তা কোনো অংশে কম নয়। দূর থেকে আমরা দেখেছিলাম সুন্দরবনের বিখ্যাত চিত্রা হরিণের পাল জল খেতে এসেছে নদীর ধারে; গাছের ডাল থেকে উড়ে যাচ্ছে অদ্ভূত সুন্দর রঙের পাখিরা।

আমাদের গাইডের সাহায্যে গাছের উপরে দেখতে পেলাম অদ্ভুত সুন্দর গিরগিটি। এছাড়া চোখে পড়ল গোসাপ, বন বিড়াল আরো কত কি। চলতে চলতে লোকমুখে জানতে পারলাম সুন্দরবনের জঙ্গলে অত্যন্ত সুদর্শন কিন্তু ভয়ংকর বিষাক্ত বহু সাপ রয়েছে। তাদের থেকে সাবধান থাকার জন্য ভ্রমণের সময় সঙ্গে গাইড এবং কার্বলিক অ্যাসিড রাখা বাধ্যতামূলক।

জলপথে ভ্রমণ:

জঙ্গল সাফারির পরের দিন শুরু হলো সুন্দরবনের জলপথে আমাদের রোমাঞ্চকর ভ্রমণ। সুন্দরবনের জলপথ অন্যান্য জায়গা থেকে একেবারে অন্যরকম। কাছাকাছি মোহনা থাকার কারণে এখানকার জলভাগের প্রাণীবৈচিত্র্যও অন্যান্য জায়গা থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক আলাদা।

বড় একটি লঞ্চে চেপে আমরা সেইদিন রওনা হলাম সুন্দরবনের আরো ভেতরে। সাথে সাথে নদীর দু’পাশের অরণ্যও ঘন হয়ে উঠতে থাকলো। লঞ্চ থেকে নদীর দিকে তাকাতে আবারও চোখে পড়লে শুশুক, তাছাড়া দেখা গেল বিভিন্ন ধরনের মাছ, বক, মাছরাঙ্গা পাখি ইত্যাদি। ইতিমধ্যে কয়েকবার কয়েকটি কচ্ছপও চোখে পড়ল।

বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর নদীর একপাশে কাদার উপর দেখতে পেলাম দুটি কুমির রোদ পোহাচ্ছে। সেই দিন লঞ্চেই আমাদের রাতের খাওয়া দাওয়া এবং ঘুমের ব্যাবস্থা হয়েছিল। খাওয়া-দাওয়ার পর লঞ্চের ডেকে এসে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম জ্যোৎস্না ভরা জঙ্গলের অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ। সমগ্র মন প্রসন্নতায় ভরে উঠলো।

ট্রি-হাউসে একটি দিন:

জলপথে ভ্রমণের পরের দিন আমাদের গাছের ঘর বা ট্রি-হাউসে থাকার একটি অনন্য অভিজ্ঞতা হল। জঙ্গলের বেশ খানিকটা ভিতরে একটি বড় গাছের ওপর সুন্দর ছোট ছিমছাম একটি ট্রি-হাউজ; সেইখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। দিনের বেলা সেই ঘর থেকে আশেপাশের জঙ্গল দেখা যায়।

এছাড়া চোখে পড়ে বহু পাখিদের আনাগোনা, কানে আসে তাদের কলতান। নিচ থেকে একটি অস্থায়ী কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ট্রি-হাউসে উঠতে হয়। বিকেলের পর গাছের উপর থেকে নিচে নামা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

সেইখানে রাত যখন খানিকটা গভীর হয়ে এসেছে তখন ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে নিচের দিকে তাকাতেই পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় স্পষ্ট চোখে পড়ল বহু প্রতীক্ষিত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। দেখতে পেলাম দুটি বাঘ গাছের নিচের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাঁদের আলোয় জোছনা রাতে বাঘ দেখার সেই অভিজ্ঞতা যে কতটা মনোমুগ্ধকর ছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

রসনা তৃপ্তি:

বাঙালি একদিকে যেমন ভ্রমণপিপাসু, আরেকদিকে তেমন খাদ্যরসিকও বটে। তাই ভ্রমণে গিয়ে স্থানীয় রসনার স্বাদ না নিলে সেই ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই উদ্দেশ্যেই সুন্দরবনের বিভিন্ন খাবার চেখে দেখতে গিয়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম।

এখানকার স্থানীয়দের মাটির হাঁড়িতে রান্না করা বন মোরগের মাংসের ঝোলের স্বাদ কোনদিন ভুলতে পারবোনা। তাছাড়া জলবিহারের দিন লঞ্চের রান্না হওয়া কাঁকড়ার ঝোলও ছিল অনবদ্য। এছাড়া এখানকার বন থেকে সংগ্রহ করা খাটি মধুর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। বাকি দিনগুলিতে বিভিন্ন ধরনের টাটকা সুস্বাদু মাছ আমাদের রসনা তৃপ্তি ঘটিয়েছিল।

উপসংহার:

এইভাবে কয়েকটি দিন সুন্দরবনে প্রকৃতির কোলে কাটিয়ে আমরা পুনরায় নিজেদের জীবনে ফিরে এলাম। ফিরে আসার জন্য আমরা বেছে নিয়েছিলাম জলপথকে। অর্থাৎ সুন্দরবন থেকে সরাসরি লঞ্চে করে পুনরায় শহরে ফিরে আসা। সেই অভিজ্ঞতাও অদ্ভুত সুন্দর ছিল।

প্রকৃতির এই পরম আশ্রয়ে ওই কয়েকটি দিন আমার পরবর্তী সারা বছরের জন্য বাঁচার রসদ জুগিয়ে দিল। সেজন্যই হয়তো আজও রাতে শহরের ঘরের নরম বিছানায় ঘুমাতে গেলে লঞ্চে কাটানো রাতের সেই জোছনাময় জঙ্গলের কথা কিংবা ট্রি-হাউজের জানালা থেকে পূর্ণিমার রাতে বাঘ দেখার স্মৃতি মনে ভেসে আসে। এখানেই ভ্রমণের প্রকৃত সার্থকতা।


একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা প্রবন্ধ রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো কমেন্ট করে জানাবেন।আপনার একটি কমেন্ট আমাদের অনেক উৎসাহিত করে আরও ভালো ভালো লেখা আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ায় জন্য।বানান ভুল থাকলে কমেন্ট করে জানিয়ে ঠিক করে দেওয়ার সুযোগ করে দিন।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন:

একটি শিক্ষামূলক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা
Print Friendly, PDF & Email

“একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা [PDF]”-এ 7-টি মন্তব্য

Greninja শীর্ষক প্রকাশনায় মন্তব্য করুন জবাব বাতিল