একটি গ্রন্থাগারের আত্মকথা রচনা [সঙ্গে PDF]

গ্রন্থাগার হল আমাদের সমগ্র সমাজ তথা সভ্যতার একটি অবিচ্ছেদ্য তথা অপরিহার্য অঙ্গ। গ্রন্থাগার ছাড়া একটি সমাজ সামগ্রিকভাবে সত্যিকারের শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে না। তাই সমাজ গঠনে গ্রন্থাগারের ভূমিকা ব্যাপক। কিন্তু গ্রন্থাগার থেকে জ্ঞান অর্জন ছাড়া আমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি যে জ্ঞানের এই বিপুল ভান্ডার যদি মানুষের মতন প্রাণোচ্ছল হত, যদি লিখতে পারতো, বলতে পারতো; তাহলে কোন সাহিত্য রচিত হতো তার কলমে! কোন বাণী নিঃসৃত হতো তার ভাষায়! আজ কল্পনার সেই নৌকাতেই ভর করে একটি গ্রন্থাগারে প্রাণ সঞ্চারের মধ্যে দিয়ে আমাদের আজকের উপস্থাপনা- ‘একটি গ্রন্থাগারের আত্মকথা’।

একটি গ্রন্থাগারের আত্মকথা রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

জন্মের পর থেকেই এই পৃথিবীর বিভিন্ন উপাদান একটি মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব রেখে যায়। সেই সকল প্রভাব মিলিয়েই একজন মানুষের মনুষ্যত্ব গড়ে ওঠে। মানুষ তার জীবনে খুঁজে পায় যথাযথ দিকনির্দেশনা। পৃথিবীতে সেই সকল প্রভাব সৃষ্টিকারী উপাদান গুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি হলো গ্রন্থাগার। মানুষের জীবন গঠনকারী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো জ্ঞান।

সেই জ্ঞানের আকর হল গ্রন্থ। যে স্থানে অসংখ্য গ্রন্থ একত্রে মিলিত হয়ে তথ্যসমৃদ্ধ জ্ঞানভান্ডার তৈরি করে, তাকেই গ্রন্থাগার বলা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরে শৃংখলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। আমি বাংলার বুকে এমনই একটি প্রাচীন গ্রন্থাগার যে আজ জীবনের খানিক অবসরে নিজের আত্মকথা ব্যক্ত করতে চলেছে। 

আমার জন্মের ইতিহাস:

ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, বয়সে আমি নবীন নই, বরং প্রাচীন। বাংলার নদীয়া জেলার হালিশহরে আজ থেকে প্রায় একশো কুড়ি বছর আগে আমার জন্ম হয়েছিল। এ কথা ভাবতে খানিক আশ্চর্য লাগলেও সত্য যে একটি স্থানীয় গ্রন্থাগার হয়েও জীবনের এতোগুলো বছর কাটিয়ে আমি এখনো টিকে আছি। আমার জন্মের সাথে জড়িয়ে রয়েছে গৌরবান্বিত ইতিহাস গাঁথা। ১৯০১ সালের এপ্রিল মাসের একটি বিকেলে আমার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল।

সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার এখনো মনে আছে, সেই পড়ন্ত বিকেলের সূর্যাস্তের লাল আলো তার গালে এসে পড়েছে, আর তিনি এই হালিশহরের বুকে আমার স্থাপনার গুরুত্ব তথা অপার সম্ভাবনার কথা বক্তৃতা করে চলেছেন। এইভাবে কবিগুরুর হাত দিয়ে আমার জীবনের পথ চলা শুরু হয়েছিল। বিশ্বকবি নিজের হাতে একটি কাগজের পাতায় আমার জন্ম নিয়ে কিছু লাইন লিখে দিয়েছিলেন। সেই কাগজখানি আজও সযত্নে আমি আগলে রেখেছি। 

কৈশোর ও যৌবনের আমি:

রক্ত মাংসে গড়া শরীরের না হলেও আমি মনে করি এ পৃথিবীতে সবকিছুরই জীবন কালে শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্য: এই পর্যায়গুলি সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম অনুযায়ীই আসে। রক্ত মাংসে গড়া প্রাণ হয়তো পর্যায় গুলির রূপে প্রভাব ফেলতে পারে, তবে সাধারণ চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য তাতে বদলায় না। আমার কৈশোর অবস্থা কেটেছিল অল্প কটি বই নিয়ে। মাঝেমধ্যে এলাকার মানুষজন তাদের নিজেদের পুরনো বই আমার কাছে সংরক্ষণ করে রাখার উদ্দেশ্যে দান করে যেতেন।

সে সময় আমি মাত্র একটি ঘর আর বেশ কয়েকটি বইয়ের আলমারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারপর ধীরে ধীরে সময়ের আবর্তে আমার কাছে সংরক্ষিত বইয়ের ভাণ্ডার বহরে বাড়তে থাকলো। সেই বই সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখার জন্য আমার দেওয়াল ঘেঁষে তৈরি হল সংলগ্ন আরও একখানি ঘর। সে সময় আমার ভরা যৌবন। নিয়মিত আমার কাছে দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন জ্ঞানীগুণী মানুষ, শিক্ষক, ছাত্র প্রমুখের আনাগোনা লেগেই থাকে। 

সময়ের প্রবাহে আমার বিবর্তন:

সেই যে সময়ের আবর্তের এর কথা বলছিলাম, সময়ের সেই অমোঘ চক্রে স্থির নয় কিছুই। সেখানে বদলে যাওয়াই যেন সাধারণ রীতি। সময়ের সেই রীতি মেনে ধীরে ধীরে আমার শরীর তথা চাল-চরিত্রেও লেগেছে বিবর্তনের ছোঁয়া। আমি চোখের সামনে দেখেছি প্রতিনিয়ত এই সমাজকে বদলে যেতে; সমাজের সাথে সাথে সমাজের প্রয়োজন মেনে বদলে যেতে হয়েছে আমাকেও। বদলেছে আমার কাছে সংরক্ষিত বইগুলির চরিত্র, বদলেছে আমার কাছে রোজ পড়তে আসা মানুষগুলির চেহারা।

যে ছাত্র একদিন উদ্দীপিত চোখ নিয়ে বই পড়তে আসত, চোখের সামনে তাকে বার্ধক্যে উপনীত হতে দেখেছি। যে শিক্ষক একদিন ওই কোনায় বসে আমার বইগুলি নিয়ে ছোট ছোট ছাত্রদের পড়াতেন, কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেখেছি তাকেও। আমার এই দীর্ঘ জীবনে সময়ের প্রবাহে ঘটনার আবহ দেখতে দেখতে আর গুনতে গুনতে কখন যে আমিও আমার চারপাশটার মতন বৃদ্ধ হয়ে উঠেছি, তা বুঝতেই পারিনি। 

আমি ও বর্তমান:

সময়ের সাথে সাথে আমার পাঠকদের চেহারা যেমন বদলেছে, তেমনি বদলেছে তাদের চরিত্রও। বদলে যাওয়া সেই চরিত্রের সাথেই পরিবর্তিত হয়েছে তাদের বই পড়ার আকাঙ্ক্ষা এবং রুচি তথা চাহিদা। আজকাল আমার পাঠকেরা বইয়ের থেকে তুলনামূলকভাবে ডিজিটাল মাধ্যমের প্রতি বেশি আগ্রহী। তাই এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে বদলে গেছি আমিও। সময়ের চাহিদা মেনে আমার মাথার উপর তৈরি হয়েছে আরো দুখানি ঘর।

আমি এখন আর সেই ১০০ বছর আগের প্রাচীন জীর্ণ গ্রন্থাগারটি নই। আমার দোতালায় তৈরি হওয়া ঘরগুলিতে সার দিয়ে বসেছে কম্পিউটার। সেসব কম্পিউটারের মধ্যে আমি সংরক্ষণ করে রাখি হাজার হাজার ডিজিটাল বই বা ই-বুক। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কাগজে গড়া বইয়ের তুলনায় ই-বুকে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমার গায়ে বর্তমানে নতুন রং লেগেছে, পুরনো ঘরগুলি সযত্নে মেরামত করা হয়েছে, আমি হয়েছি সম্পূর্ণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। 

আমার সেকাল ও একাল:

দীর্ঘ জীবনের এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে তুল্য মূল্য বিচার করার সামর্থ্য কিংবা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। তাই এই ‘সেকাল-একাল’ তুলনামূলক আলোচনা নয়, বরং কেবলই আমার জীবনের একটি পর্যালোচনা মাত্র।  এই পর্যালোচনার মাধ্যমে আমি বুঝতে পারি কালের গর্ভে প্রাচীন শুধুমাত্র হারিয়েই যায় না, বরং সময়ের আবর্তে প্রাচীন আবার নতুন করে যুগোপযোগী রূপে সেজে উঠতে পারে।

আমার জন্ম লগ্নে যে উপাদানগুলি দিয়ে আমার সূচনা হয়েছিল তারমধ্যে আমার গেটের সামনে সাদা রঙের জরাজীর্ণ ওই ফলক আর এই মূল ভবনের ইঁটগুলি ছাড়া বাকি সবই নতুন। এমনকি যে প্রাচীন পাখাগুলি একসময় গ্রীষ্মের দিনে আমার পাঠকদের স্বস্তি এনে দিত, সেগুলিও খুলে ফেলা হয়েছে। প্রাচীন সেই বইগুলির অধিকাংশই এখন আর অবশিষ্ট নেই। কিছু হারিয়ে গেছে, কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আর যে গুলি আছে তাদের অবস্থা অত্যন্ত জরাজীর্ণ। সেগুলিতে এখন আর সাধারণ পাঠকদের হাত দিতে দেওয়া হয় না। আর রয়েছে সেই প্রাচীন মেহগনি কাঠের আলমারি গুলি, মূল ভবনের একেবারে পিছনের দিকে বন্ধ একটি ঘরে, ধুলার বিছানায়। সেই আলমারি গুলির জায়গা এখন নিয়েছে বড় বড় কাঁচের তৈরী বইয়ের শোকেস। 

উপসংহার:

আত্মজীবনের এই পর্যালোচনা থেকে আমি উপলব্ধি করতে পারি মহাসৃষ্টির সারসত্য। এই সৃষ্টির নিয়ম অনুযায়ী প্রাচীনকে স্বাভাবিকভাবেই পিছনে সরে গিয়ে নবীনের জায়গা করে দিতে হয়। নবীন সেই প্রাচীনের ঐতিহ্য, অহংকার তথা আত্মার মূল চরিত্রকে বয়ে নিয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে। এইভাবে ঐতিহ্যের রাজদণ্ড প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে নিয়ে চলতে হয়। পিছনে সরে এসে নবীনকে এই জায়গা করে দেওয়ার মধ্যে কোন গ্লানি থাকেনা, বরং থাকে গর্ব। আসলে জীবনের উদ্দেশ্য পূরণের এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জীবনের সার্থকতা। আমার জীবনের ভূমিকা যদি আমি সার্থক ভাবে পালন করতে পারি তাহলে মাটিতে মিশে গিয়েও আমার কোন গ্লানি থাকবে না। 


একটি গ্রন্থাগার যদি নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারত তাহলে আমাদের সে কি কি বলতো, আজকের আলোচ্য উপরিউক্ত এই প্রবন্ধে আমরা সেই বিষয়ের উপর আলোকপাত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। সম্ভাব্য সবকটি দিককে তুলে ধরা ছাড়াও, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে এই উপস্থাপনায় নির্দিষ্ট শব্দ সীমা বজায় রাখারও চেষ্টা করা হয়েছে। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।

উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন