গাছ হলো মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে অপরিহার্য অঙ্গ। গাছ ছাড়া পৃথিবীতে মানুষ তো দূর, কোন প্রাণীর পক্ষেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কারণবশত বিশ্বজুড়ে গাছের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে এক মহাসংকটের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকট দূরীকরণের উদ্দেশ্যে বিশ্বজুড়ে সুধীজনের উদ্যোগে শুরু হয়েছে ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’ আন্দোলন। এই শ্লোগান এবং বিশ্বব্যাপীউদ্ভিদের ব্যাপক ও সর্বৈব প্রাসঙ্গিকতা সংক্রান্ত আলোচনার উদ্দেশ্যেই আমাদের আজকের প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।
সূচি তালিকা
ভূমিকা:
এই পৃথিবীতে সকল প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো গাছ। প্রাণীকূলকে গাছ নিঃস্বার্থভাবে সেবাদান করে বলে গাছকে বলা হয় প্রাণীর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। গাছ ছাড়া পৃথিবীতে মানুষ তো দূর, একটি পতঙ্গের অস্তিত্ব কল্পনা করাও কষ্টসাধ্য। তবে বর্তমান যুগে আধুনিক সভ্যতার গ্রাসে প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের সাথে সাথে গাছের অস্তিত্বও বিশেষভাবে সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।
সেই কারণে মানবজাতিকে নিজের স্বার্থেই পুনরায় পৃথিবীর এই মহাসম্পদ রক্ষা এবং তার সুস্থিত পুনঃস্থাপনের জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হতে হয়েছে। এই উদ্যোগ কেবলমাত্র মানুষেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত এবং আপন অস্তিত্ব রক্ষার নিমিত্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদের আদিমতম বন্ধন পুনর্গঠনের স্বার্থান্বেষী একটি প্রয়াস মাত্র। পৃথিবীতে উদ্ভিদ সম্পদ এবং প্রাণিসম্পদের পারস্পরিক এই সম্পর্ক ও বিবর্তিত মিথস্ক্রিয়ার উপর আলোকপাতের উদ্দেশ্যেই এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।
প্রকৃতিতে গাছ:
গাছ বা উদ্ভিদ হল বিশ্ব সৃষ্টির আদিমতম উপাদান। পৃথিবীতে যখন ন্যূনতম প্রাণের অস্তিত্ব ছিলনা, তখন থেকে ধীরে ধীরে উদ্ভিদরাই ধরিত্রীর দখল নিতে শুরু করে। তারপর সময় যত গড়িয়েছে, ততই সমগ্র বিশ্বসংসার ছেয়ে ফেলেছে উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদের প্রভাবেই নিয়ত পরিবর্তিত পরিবেশ ধীরে ধীরে প্রাণী জন্ম ও বসবাসের অনুকূল হয়ে উঠেছে।
এইভাবে কেটে গিয়েছে লক্ষ লক্ষ বছর; সময়ের সাথে বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটেছে একের পর এক প্রাণীর। এই সকল প্রাণী প্রাথমিকভাবে উদ্ভিদকুলের ওপর নির্ভর করেই পৃথিবীতে তাদের জীবন ধারণ করেছে। প্রাণীকুলের মধ্যে সবচেয়ে শেষে এসেছে মানুষ; সবচেয়ে শেষ, অথচ সবচেয়ে বুদ্ধিমান।
সেই বুদ্ধিকে প্রতিনিয়ত নিজের জীবনে কাজে লাগিয়ে সর্বক্ষেত্রে প্রকৃতির ওপর প্রত্যক্ষ নির্ভরশীলতা দূর করে মানুষ হয়ে উঠেছে স্বনির্ভর। আদির অসভ্য-বর্বর রূপ থেকে মানুষের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার সফরে যে মানুষকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে তা হল এই গাছ। সে কারণে মানুষের সাথে গাছের বন্ধন অত্যন্ত নিবিড়।
প্রাণীকুলের রক্ষায় গাছের গুরত্ব:
পৃথিবীর সকল প্রাণীকুল জীবনধারণের জন্য কোনো না কোনোভাবে গাছের উপর নির্ভর করে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো পৃথিবীর কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না। গাছের এ বিশ্বের প্রাণ রক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক ও সাধারণ দান হলো অক্সিজেন। এ-বিশ্বে মুক্ত অক্সিজেনের পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য।
গাছ তার খাদ্য তৈরীর জন্য সূর্যালোক এবং প্রকৃতি থেকে প্রাণীদের বর্জ্য কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে নেয় এবং বিনিময়ে বিতরণ করে মুক্ত অক্সিজেন। এই অক্সিজেন গ্রহণ করেই প্রতিনিয়ত সকল প্রাণীকুল জীবন ধারণ করে থাকে। প্রাণীকুলের কাছে গাছের দ্বিতীয় অবদানটি খাদ্য সংক্রান্ত। পৃথিবীর সকল প্রাণী খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে গাছ বা উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল।
আবার, আশ্রয় কিংবা বাসস্থানের জন্যও পৃথিবীর সকল প্রাণী প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ভর করে গাছের উপর। কি মানুষ কি অন্য প্রাণী সকলেই উদ্ভিদকে ব্যবহার করেই নিজের আশ্রয় নির্মাণ করে থাকে। মানুষের বস্ত্রটুকুও উদ্ভিদের দান। সেই আদিম যুগ থেকে এখনো পর্যন্ত বস্ত্রের প্রয়োজনে মানুষ বহুলাংশে উদ্ভিদের উপরেই নির্ভর করে।
গাছ এবং প্রাণীর পারস্পরিক বন্ধন:
গাছ এবং প্রাণীকুলের পারস্পরিক বন্ধন সেই সুদূর অতীতকাল থেকেই অত্যন্ত নিবিড়। প্রাণীরা যেমন জীবনধারণের জন্য প্রতিনিয়ত উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করে থাকে, তেমনি গাছও প্রাণীকুলের উপর নির্ভর করে বহুলাংশে বিকাশ লাভ করে। উদ্ভিদের বর্জ্য হিসেবে ত্যাগ করা অক্সিজেন গ্রহণ করে প্রাণীরা যেমন বেঁচে থাকে তেমনই প্রাণীকুলের বর্জ্য ত্যাগ করা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে উদ্ভিদরা জীবনধারণের নিমিত্ত খাদ্য প্রস্তুত করে থাকে।
তাছাড়া প্রাণীদের ত্যাগ করা বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ, এমনকি প্রাণীদের দেহাবশেষ গাছের জন্য বিশেষ উপযোগী সার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই একথা মেনে নিতেই হয় যে প্রাণী এবং উদ্ভিদ কুলের এই পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াই পৃথিবীতে জীবনচক্রকে নিয়ত গতিশীল রেখেছে।
উদ্ভিদকুলের ধ্বংস ও জীবকুলের প্রাণসংকট:
উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া পৃথিবীর জীবনচক্রের চাকাকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে দীর্ঘকাল সচল রাখলেও এতে বাধ সাধল আধুনিক সভ্যতার অস্বাভাবিক অগ্রগতি। মানুষের এগিয়ে যাওয়ার অদম্য বাসনা এবং অসম্ভব লোভের বলি হলো পৃথিবীর আদিমতম নিয়ম।
উদ্ভিদ কোষের ওপর চলতে থাকল ব্যাপক রূপে যথেচ্ছাচার। এই যথেচ্ছাচারী শুধু যে পৃথিবী থেকে উদ্ভিদরাই বহুলাংশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকলো তা নয়, সাথে সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল অসংখ্য অগণিত প্রাণীরাও। খুব স্বাভাবিকভাবেই এর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়ল মানুষের নিজের উপরেও। তবে লক্ষ লক্ষ বছরের নিয়ম ধুলিসাৎ হয়ে যাওয়ার প্রভাব একদিনে অনুভূত হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরে মানুষের শোষণ ও নিপীড়নে প্রকৃতি তার উত্তর ফিরিয়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে পৃথিবীর নির্মল পরিবেশ হয়ে উঠেছে দূষিত, বিশ্বের অসংখ্য জায়গা হয়ে উঠেছে বসবাসের অযোগ্য, দেখা দিচ্ছে ব্যাপক জীবন সংকট। অরণ্য ধ্বংসের সাথে সাথে পৃথিবী থেকে যেমন হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণীরা, তেমনই তার প্রভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবীর খাদ্য শৃংখল।
‘একটি গাছ একটি প্রাণ’ অভিযানের গুরুত্ব:
পৃথিবীতে বিশ্ব প্রকৃতির এই সংকটের মুহূর্তে ব্যাপকভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী অরণ্য সম্পদ এর পুনঃস্থাপনের। বর্তমান যুগে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা সহ সকল সুধীজন এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে পেরেছেন যে অরন্যের পুনঃস্থাপন ছাড়া মানব জাতি তথা এ বিশ্বের প্রাণীকূলকে রক্ষার অন্য কোন উপায় নেই।
মাত্র গত চারশত বছরের মধ্যে পৃথিবীর যে তিন-চতুর্থাংশ অরণ্য অঞ্চল মানুষ ধ্বংস করে ফেলেছে তার যতটুকু সম্ভব পুনঃস্থাপন না করতে পারলে অচিরেই এই বিশ্ব থেকে সভ্য দাম্ভিক মানবজাতিকে বিদায় নিতে হবে। তাই সমগ্র বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বৃক্ষরোপণ, বৃক্ষ সংরক্ষণ তথা অরণ্য পুনঃস্থাপন সংক্রান্ত কর্মসূচি।
পশ্চিমের বিভিন্ন উন্নত দেশগুলিতে বিদ্যালয়ের প্রাথমিক জীবন থেকেই শিশুদের গাছের উপযোগিতা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত করে তোলা হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে অরণ্য পুনঃস্থাপন কর্মসূচি একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের রূপ নিচ্ছে। এই আন্দোলনে জনপ্রিয়তা লাভ করছে একটি স্লোগান- “একটি গাছ একটি প্রাণ; গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান”।
ভাষা, ধর্ম, জাতি, দেশ নির্বিশেষে সকল মানুষের সাধারণ বাণী হয়ে বিশ্বের প্রতিটি কোনায় বর্তমানে এই স্লোগানটি ধ্বনিত হচ্ছে। এই স্লোগানটি কাজ করছে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সচেতন করে তোলার। কারণ একমাত্র মানুষ সচেতন হয়ে উঠতে পারলে তবেই অরণ্য পুনঃস্থাপনের মতন অভিষ্ঠ পবিত্র একটি লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে।
উপমহাদেশে অরণ্য আন্দোলনের ঐতিহ্য:
ভারতীয় উপমহাদেশে অরণ্য আন্দোলনের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। সুদূর অতীতকাল থেকেই ভারতবর্ষের ভূমিতে অরণ্যকে দেবতা রূপে পূজা করার প্রচলন রয়েছে। কোথাও কোথাও আদিম ভারতীয় কোন উপজাতির কাছে অরণ্য হয়ে উঠেছে নিজের পরিবার কিংবা একান্ত ঘরের লোক। আর তথাকথিত এই আধুনিক যুগে বিশ্বব্যাপী অরণ্য পুনঃস্থাপনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে শুরু করেছিলেন বনমহোৎসব।
এই বনমহোৎসবের মাধ্যমে তিনি ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’ সংক্রান্ত কর্মসূচিকে একটি ব্যাপক উৎসবের রূপদান করতে চেয়ে ছিলেন। তার হাত ধরে শুরু হওয়া উৎসব এখনো পর্যন্ত প্রতিবছর সমগ্র শান্তিনিকেতন জুড়ে মহা আড়ম্বরে পালিত হয়ে থাকে।
উপসংহার:
মানুষের দীর্ঘকালীন অন্যায়ের ফলে যেমন পৃথিবীর আজ এই দুর্দশা, তেমনি মানুষকেই দায়িত্ব নিতে হবে ধরিত্রী মায়ের এই দুঃখ মোচনের। আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য হলেও মানুষকে প্রয়োজন অনুযায়ী আত্মত্যাগ করতে হবে। কারণ ত্যাগ ছাড়া অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণ কোন ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়।
বর্তমান পৃথিবীতে সুধীজনের অভিষ্ট লক্ষ্য হলো এই বিশ্বকে পুনরায় সবুজ অরণ্যে ভরিয়ে তোলা। আবার সেই প্রাণী ও উদ্ভিদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া সুনিবিড় সম্পর্ককে পুনঃস্থাপন করা এবং মানুষের মধ্যে থেকে আধুনিক যান্ত্রিকতা দূর করে নিবিড় অরণ্যের ছায়ায় মান এবং হুঁশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। তাই আজ মানুষের নিজের কাছে নিজের কথা দেওয়ার এই মহা সন্ধিক্ষণে পরম ব্রত হোক:
“দাও ফিরে সে অরণ্য লহ এ নগর,
লহ যত লৌহ , লোষ্ট্র, কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নব সভ্যতা ।”
উপরিউক্ত প্রতিবেদনটিতে ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’ সংক্রান্ত আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে যতখানি আলোচনা করা সম্ভব, বিষয়ের সব দিক মাথায় রেখে আমরা ততখানি চেষ্টা করেছি। আশা করি এই প্রতিবেদনটি আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে। উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান।
আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।
এই রচনা গুলো কি 400 শব্দের মধ্যে ? শীঘ্র জানালে ভাল হয়।
রচনা গুলি ৪০০ শব্দের অনেক বেশি। প্রয়োজন মতো পয়েন্ট বাদ দিয়ে ছোট করে নিতে পারেন। ধন্যবাদ।