একটি খেলার মাঠের আত্মকথা রচনা [সঙ্গে PDF]

শৈশবে যে মাঠে খেলা করতে করতে বিকেলের পর বিকেল পেরিয়ে গিয়েছে সেই মাঠের কথা ভাববার অবকাশ নেই আর কারোরই। খোলা আকাশের নীচে আজও সেই মাঠ রয়েছে নিজের মতো। এখন আর মাঠে সেই ভাবে খেলা হয়না, শিশুরা মেতেছে ভিডিও গেমে। যে মাঠে হাজার হাজার মানুষের শৈশব কেটেছে আনন্দ উল্লাসে সেই মাঠের বুকের ক্ষত গুলোর দিকে ফিরে তাকানোর সময় কারোরই নেই আজ। এমনই এক মাঠের মনের কথা কে তুলে ধরে আজকের উপস্থাপন একটি খেলার মাঠের আত্মকথা রচনা।

একটি খেলার মাঠের আত্মকথা রচনা

ভূমিকা:

জীবনে ‘খেলা’কে মানুষ স্বভাবতই শব্দগতভাবে তুচ্ছ বলে মনে করে। কিন্তু সেই তাচ্ছিল্যের সময় মানুষ এই কথা ভাবেনা যে এই খেলাধুলাই তার বাল্যকাল কিংবা কৈশোরের অধিকাংশ সময়কে মাতিয়ে রেখেছিল। জীবনে মানুষ খেলাকে যেভাবে তুচ্ছ বলে মনে করে ঠিক তেমনভাবেই আমাকেও প্রতি পদক্ষেপে পদলেহন করে চলে যায়।

আমি একটি ধূলিধূসরিত খেলার মাঠ আমার জীবনের সম্ভবত অন্তিম লগ্নে নিজের দীর্ঘ জীবনের আত্মকথা ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা করছি। সারা জীবন মানুষ আমায় ব্যবহার করেছে, আমার বুকে দাপিয়ে বেড়িয়েছে প্রতিনিয়ত; কিন্তু আমার দিকে চেয়ে কেউ তাকায়নি। কেউ তাকিয়ে দেখে নি আমার শরীরে কোথায় কতটা ক্ষত জমছে, কেউ দেখেনি ঠিক কোন জায়গায় আমার বুকে নামছে ধস।

সবাই আমার পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে মহানন্দে উল্লাস করেছে, মেতেছে পরমানন্দে। সর্বক্ষেত্রে আমি সবার অবলম্বন, কিন্তু কারোর উদ্দেশ্য হয়ে উঠিনি কখনো। আজ জীবনের সায়াহ্নে উপস্থিত হয়ে সুখ দুঃখে ভরা নিজের কাহিনী শোনাবার সুযোগ আমার হয়েছে। 

আমার জন্মবৃত্তান্ত:

আমার জন্ম আজ থেকে বহু সময় আগে। তখনো আজকের গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়ায়নি। সেই সময় সবেমাত্র ইংরেজরা ভারতবর্ষে এসে কলকাতার বুকে ঘাঁটি গেড়েছে। আমি এখন যেখানে থাকি সেখানে তখন ঘন জঙ্গল। ব্রিটিশ বণিকরা তখন ঠিক করলো নিজেদের অবসর বিনোদনের জন্য একটি খোলা জায়গা দরকার যেখানে তারা নিশ্চিন্ত মনে প্রকৃতির বিশুদ্ধ বায়ুসেবন করতে পারবে, খেলাধুলা করতে পারবে।

যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। কিছুদিনের মধ্যেই জঙ্গল কেটে সাফ হয়ে বুকের উপর ছোট ছোট ঘাস নিয়ে জন্ম হলো আমার। চোখ মেলে নিজের অনতিদূরে দেখতে পেলাম পেল্লায় বড় একটা কেল্লা। লোকমুখে শুনতে পেতাম ওটা নাকি ইংরেজের কেল্লা। আর সেই কেল্লার ধারে অবস্থিত মাঠ বলে সবার মুখে মুখে আমার নাম হয়ে গেল কেল্লার মাঠ। 

স্মৃতির পাতায় অতীত জীবন:

জন্মের শুরুর দিকে আমার যখন ছেলেবেলা, তখন আমার চারধারে ইংরেজ বণিকরা গড়ে তুলেছিল সুন্দর সাজানো ফুলের বাগান। প্রতিদিন বিকেল বেলায় মালি এসে আমার বুকের উপর গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট গাছ আর আমার ঘাসের পরিচর্যা করতো। ভোরের দিকে সাহেবেরা আমার উপর চেয়ার পেতে বসে সকালের চা খেত, কেউ বা ক্রিকেট খেলত।

তারপর একদিন হঠাৎ কি হলো, কার এক আক্রমণে সেই সাহেবেরা আমায় ছেড়ে, আমার অনতিদূরে কেল্লা ছেড়ে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। কিছুদিন পরে সেই কেল্লায় গড়ে উঠতে দেখেছিলাম সাহেবদেরই অফিস। তখন আর ভোর বেলায় আমার গায়ের উপর সাহেবদের আনাগোনা দেখতে পেতাম না। তারপর এক সময় তাদের আসা-যাওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। ব্রিটিশ বণিকদের জায়গা নিল ছোট ছোট ছেলেরা।

তারা প্রতিদিন সকালে বিকেলে আমার কাছে খেলতে আসত। নানান রকমের তাদের খেলা। ওদিকে আমার চারপাশে ছোট ছোট ফুল গাছগুলি যত্নের অভাবে জীর্ণ হয়ে পড়েছে। কেল্লার অপর দিকে যে জঙ্গল আগে দেখা যেত তাও ধীরে ধীরে মুছে যেতে শুরু করেছিল। সেখানে গড়ে উঠেছিল সিমেন্টের রাস্তা, যাতায়াত শুরু করেছিল গাড়িঘোড়া।

জীবনপটে একটি স্মরণীয় দিন:

সাহেবি আমলে সেই সময়ে আমি সাহেবদের পরিচর্যা যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি নিরীহ মানুষের ওপর ইংরেজদের অত্যাচারের দৃশ্য। আমার বুকের উপর দেখেছি অসংখ্য রক্তপাতের ঘটনা ঘটতে। আমার ওপর গজিয়ে ওঠা কচি কচি ঘাস গুলি সিক্ত হয়েছে সেই রক্তের ধারায়।

আমার চোখ দিয়েও তখন গড়িয়েছে অশ্রুধারা। যদিও সেই বারিধারা কখনো কেউ দেখতে পায়নি, কিংবা হয়তো লক্ষ্য করে চেয়ে দেখেনি। সেই অশ্রুধারার অবহেলায় আমার বুকে সারা দেশের মতোই ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘনীভূত হয়েছিল আক্রোশ। হয়তো সে কারণেই যেদিন দেশ স্বাধীন হলো, যেদিন আমার বুকে জড়ো হল একদল মানুষ, আমার ওপর গজিয়ে ওঠা সবুজ কচি ঘাস ছিঁড়ে গর্ত করে পোতা হলো বাঁশ- সেই দিন যন্ত্রণায় অসহ্য কষ্ট হলেও আমি ছিলাম নিঃশব্দ।

কারণ সেই বাঁশের গায়ে বাধা পড়ে হাওয়ায় উড়বে দেশের জাতীয় পতাকা। সেই দিন মানুষের মুখে দেখেছিলাম মুক্তির হাসি, স্বাধীনতার আনন্দ। এটি আমার জীবনের এক অন্যতম স্মরণীয় দিন।

আমি এখন:

সময়ের কালস্রোতে আজ আমার হাল প্রায় বেহাল। এখনো আমার কাছে ছেলেমেয়েরা খেলতে আসে বটে কিন্তু তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। আমার বুকে এখন আর সবুজ কচি ঘাস জন্মায় না। সেখানে এখন পুরু ধুলোর আস্তরণ। আমার অনতিদূরে বিস্তৃত হয়েছে রাজপথ। সেখান দিয়ে সারাদিন ভীষন আওয়াজ করে যখন চলে যায় অসংখ্য গাড়ি। ধুলো উড়ে এসে জমে আমার বুকে। 

আমার জন্মের সময়কার সেই কেল্লা এখনো মাথা তুলে ইংরেজের স্থাপত্যের দর্প নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেই এখন সরকারি কর্মকর্তা আর আধিকারিকদের যাতায়াত। আমার গায়ে জমেছে নানা গভীর ক্ষত। কেউ আজ একবার সে দিকে চেয়েও দেখে না। ইতিমধ্যে একদিন কানাঘুষোয় শুনতে পেলাম রাজপথের ধারে আমার ওপর তৈরি হবে একটি বহুতল। 

উপসংহার:

আজ জীবনের এই সন্ধ্যাকালে স্মৃতির আঙিনায় অতি দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি বুকে জমে ওঠা বিভিন্ন ক্ষতগুলোর যে অসহ্য যন্ত্রনা, তার অবসানের। অপেক্ষা করছি কবে কোন শুভ দিনে ভারী যন্ত্রওয়ালা গাড়ি এসে আমার বুক চিরে নির্মাণ করবে ভবিষ্যতের বহুতলের ভিত।

আমার জীবন তো ইতিহাসের শেষ পর্যায়ে এসে উপস্থিত। কিন্তু আমারই মতন এই শহরের অন্যান্য খেলার মাঠগুলিও যদি এভাবেই ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যায় তাহলে এখানকার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলি কোথায় নিজেদের বাল্যকাল আর কৈশোরের খেলাধুলার মূল্যবান সময়টুকু অতিবাহিত করবে তা আজ হয়তো সত্যিই ভাবার সময় এসেছে।


একটি খেলার মাঠের আত্মকথা রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার।এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন:

একটি বটগাছের আত্মকথা
একটি নদীর আত্মকথা
একটি রাজপথের আত্মকথা
একটি কলমের আত্মকথা রচনা
Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন