একটি কলমের আত্মকথা রচনা [সঙ্গে PDF]

যে কলম দিয়ে রচিত হয়েছে ইতিহাস, লিখিত হয়েছে কালজয়ী সব সাহিত্য, যার কালিতে রচিত হয়েছে কতশত মহান মানুষের জীবনী, সেই কলম তার নিজের কথা তার কালিতে কখনও প্রকাশ করতে পারেনি। একটি কলম যদি তার নিজের জীবনের কথা বলার সুযোগ পায় তাহলে কেমন হবে তার আত্মকথা? এই আমাদের আজকের উপস্থাপন একটি কলমের আত্মকথা রচনা।

একটি কলমের আত্মকথা রচনা

ভূমিকা:

আমি এক নগণ্য কলম। মুখে বলছি আমি নগন্য, তবে আমার ভূমিকা অনন্য সাধারণ। এ পৃথিবীতে সভ্যতার কাহিনীকে সংরক্ষণের ধারায় যার অবদান সবচেয়ে বেশি তা হল আমি। আমার নিব দিয়েই রচিত হয় যুগ-যুগান্তরের ইতিহাস, আমার কালিতেই লিখিত হয় কালজয়ী সব সাহিত্য, আবার আমার আচরেই রচিত হয় এমনসব বৈজ্ঞানিক তথ্য যা পৃথিবীকে পাল্টে দিতে পারে অচিরেই।

এমন অনন্য ভূমিকা নিয়ে পৃথিবীর কোন বস্তু নগণ্য হতে পারে না। আত্মপ্রচারের মতন শোনালেও একথা সত্য যে আমায় ছাড়া এ সভ্যতার এগিয়ে চলা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতো। অতীতের সাথে বর্তমানের বাঁধন যেতো ছিড়ে, বিজ্ঞানের তথ্যের অভাবে রচনা হতোনা অগ্রগামী ভবিষ্যৎ, মানুষের মনের রসাস্বাদনের জন্য রচিত হতোনা কালজয়ী সাহিত্য কিংবা কবিতা।

তাই এ পৃথিবীর ধারণ ও বহনে অক্সিজেনের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি এই আধুনিক মানব সভ্যতার ধারণ ও বহনে আমারও ভূমিকা আছে। আমি হলাম মানব সভ্যতার অক্সিজেন; মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার। আমার জন্ম মুহূর্ত গৌরবময় না হলেও, আমার জীবন নগণ্য নয়। আজ সেই অনন্য সাধারন জীবনের কাহিনী সকলকে বলে যাবার উদ্দেশ্যেই এই আত্মচরিতের অবতারণা।

কলম হিসেবে জন্মমুহূর্ত:

ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি, জন্মমুহূর্ত আমার গৌরবময় নয়, বরং তা বেদনার ও দুঃখের। কিভাবে নলের খাগড়া থেকে আজকের ধাতব নিবে আমি পরিণতি পেয়েছি সে কথা আজ নাইবা বললাম। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করি একটি কলমের জন্ম তখন হয় না যখন তাকে তৈরি করা হয়। একটি কলম সেই সময়ে প্রাণ পায় যখন তার শরীর থেকে প্রথমবার নিঃসৃত হয় সাহিত্যে প্রাণসঞ্চারকরী কালি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা স্থান পায় খাতার পাতায়, কিংবা যখন একটি কলমের কালি দিয়ে লেখা হয় অতীত ইতিহাসের গাঁথা।

আমার জন্যেও একথা সার্বিক রূপে সত্য। আমি ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলাম এক সুসজ্জিত দোকানে, যেখান থেকে এক সুদর্শন ভদ্রলোক আমায় কিনে নিয়ে গিয়ে স্থান দিয়েছিলেন তার কাজের টেবিলের পেনদানিতে। যেদিন তিনি প্রথম আমার ঢাকনা খুলে কাগজের পাতায় আঁচড় কেটেছিলেন, সেদিন আমার ঘুম ভাঙ্গে। বহু প্রতীক্ষিত সেই জন্মলগ্নের পর কলম হিসেবে আমার যাত্রা শুরু হয়।

জীবনযাত্রা:

সত্যি বলতে আমার প্রাথমিক জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত মধুর। আমি সেই সুদর্শন ভদ্রলোকের শখের কলম। একদিন বর্ষাকালে পড়ন্ত বিকেলের বৃষ্টিস্নাত আলোয় খাতার পাতায় যেদিন তিনি আমার কালিতে প্রথম লিখতে শুরু করলেন- “এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর”, সেইদিন বুঝতে পেরেছিলাম এই ভদ্রলোক শুধুমাত্র সুদর্শন নন, পরম জ্ঞানী এক মনীষী- যাকে তোমরা সবাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে চেনো। তার পরিচয় পেলাম রচনার শেষ লাইনে, যেখানে তিনি নিজের হাতে আমায় দিয়ে সই করলে নিজের নাম। এর পরবর্তীতে আমার স্থান হয়েছিল তোমাদের কবিগুরুর বুকের কাছে। সেই বুক থেকে নামিয়ে নৌকাবিহারে তিনি কত গান, কত কবিতা আমার আঁচড়ে রচনা করেছেন তার হিসেব না আমি রেখেছি, না রেখেছেন তিনি।

আমার টানে প্রতিদিন রচনা হয়েছে কালজয়ী ইতিহাস। যখন আমার কালি ফুরিয়ে যেত, কবিগুরু সযত্নে আমার শরীরের অন্তঃস্থলে বইয়ে দিতেন নীল কিংবা কালো কালির উচ্ছ্বসিত স্রোতধারা। কখনো আবার নিজেরই রচনা করা সৃষ্টিকে আমারই অন্তরে কেটে ছারখার করে দিতেন, আবার রচনা করতেন নতুন করে। 

যাত্রার পরিসমাপ্তি:

আমি আমার জীবনে একাধিক সঙ্গীর সঙ্গলাভ করেছি। তোমাদের বিশ্বকবির পেনদানিতে আমারই সঙ্গে স্থান পেয়েছিল তার একাধিক কলম। তাদের সঙ্গে আমি গোপনে কথা বলতাম; নিভৃত আলাপচারিতায় ভাগ করে নিতাম গুরুদেবের বুকের কাছে থাকার অভিজ্ঞতাকে। সে সময় কখনো কখনো আমার লেখক এর হাতে চামড়ার ভাঁজ অনুভব করতে পারতাম, লিখনীর পথে কখনো থেমে তার মুখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করতাম বয়সের জীর্ণতা।

বুঝতে পারতাম বয়স হচ্ছে আমারও, হয়তো এই যাত্রাপথের পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। তারপর একদিন হঠাৎ চারপাশে উঠল ক্রন্দন-রোল, আমাদেরকে আড়াল করে, সামনে ভিড় করে গুরুদেবকে দেখতে হাজির হলো সবাই। বুঝতে পারলাম তিনি আর নেই, বুক ফেটে কান্না এলো আমাদেরও। কিন্তু মানুষের কাছে আমরা তো নিতান্তই জড়; সেজন্য সেই দিন আমাদের চোখের জল স্পর্শ করেনি কোন মানুষের হৃদয়কে।

তারপর থেকে আমাদের কেউ স্পর্শ করেনি, অবহেলায় ধুলো জমেছে আমাদের বুকে। যে নিব, যে কালি দিয়ে একদিন গীতাঞ্জলি অমৃতরস রচিত হয়েছিল আজ সেই কালি শুকিয়ে গিয়েছে। স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করেছি আমিও। তারপর একদিন আমায় পরিষ্কার করে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো সুসজ্জিত এক কাঁচের ঘরে। বুঝতে পারলাম এ হল বিশ্বকবির বসতবাড়ীতে তৈরি হওয়া মিউজিয়াম। সেই থেকে আমার পরিসমাপ্ত জীবনের আশ্রয় হল এখানেই।

উপসংহার:

আমাদের কলমের সবার জীবন একই ধারায় বয়ে চলে না। কলমের জীবনযাত্রার বাহুল্য নির্ভর করে সেই কলমের মালিক এর উপর। নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছি মানুষের জীবনে আমাদের মতই একই নিয়মে চলে। চরিত্রের দিক থেকে সকল জীবন, সকল প্রাণ এক ও অনন্য।

কিন্তু সেই জীবনের ধারার চরিত্র নির্ভর করে সেই প্রাণের ধারকের ওপর। ধারক যদি ধারণকে সঠিক পথে পরিচালিত করে তবেই সেই ধারণ সার্থক হয়ে ওঠে। সক্ষম হয় ইতিহাস রচনা করতে; সার্থক হয় এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ রচনার কাজে।


একটি কলমের আত্মকথা রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার।এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন:

একটি বটগাছের আত্মকথা
একটি নদীর আত্মকথা
একটি রাজপথের আত্মকথা
Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন