আমার প্রিয় শিক্ষক রচনা [সঙ্গে PDF]

আমাদের প্রত্যেকের বিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক থাকেন, তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে জীবনের সঠিক পথ প্রদর্শনে সহয়তা করেন। তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের কাছে সমান শ্রদ্ধেয়। কিন্তু প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অন্তরে একজন কোনো শিক্ষকের জন্য বিশেষ স্থান থাকে। এই নিয়েই আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় আমার প্রিয় শিক্ষক রচনা।

একজন শিক্ষক ও ছাত্রের ছবি

ভূমিকা:

শিক্ষকরা হলেন আমাদের জীবনে চলার পথে অন্যতম প্রধান পথপ্রদর্শক এবং অভিভাবকস্বরূপ। জীবনে চলার পথে কোনটা করা উচিত আর কোনটা উচিত নয় সেই শিক্ষা আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়ে থাকি। তাছাড়া বিশেষত ছাত্রজীবনে কি করতে হবে এবং সর্বোপরি কিভাবে করতে হবে এই ব্যাপারে তারা আমাদের পথনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তাই শিক্ষকরা আমাদের কাছে পরম পূজনীয় ব্যক্তি।

জীবনে পিতা-মাতার পরে স্থান হল শিক্ষকের। পিতা-মাতারা যেমন আমাদের জন্ম দেন, লালন পালন করেন তেমনি শিক্ষকরা আমাদের মনের দরজা উন্মুক্ত করে আমাদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। তাই জীবনে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের বাইরে উভয় জায়গায় আমরা নানান শিক্ষকদের সান্নিধ্যে আসি। তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কেউ কেউ আপন ব্যক্তিত্বের মহিমায় আমাদের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেন। তারাই হলেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক।  

আমার প্রিয় শিক্ষক:

আমি আমাদের গ্রামের সীতারামদাস উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর একজন ছাত্র। আমাদের বিদ্যালয়টিতে উচ্চ শিক্ষককে নিয়ে মোট ৪৬ জন শিক্ষক ও শিক্ষিকা রয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই আমাদের বিদ্যালয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, খেলাধুলা থেকে শুরু করে পড়াশোনা, হাতের কাজ ইত্যাদি সবকিছুতে ছাত্রদের পাশে থেকে সাহায্য করেন।

তবে এদের সবার মধ্যে আমার যিনি সবথেকে প্রিয় শিক্ষক, তার নাম হলো শ্রী নির্মল কুমার বন্দোপাধ্যায়। আমরা বিদ্যালয়ের সকল ছাত্ররা তাকে নির্মল স্যার নামে চিনি। তিনি আমাদের বিদ্যালয়ের ইতিহাসের একজন শিক্ষক। নির্মল স্যার শুধু আমার কাছেই নন, আমার একাধিক সহপাঠীদের কাছেও সমানভাবে প্রিয়। তার মুখেই আমরা গল্প শুনেছি তার প্রকৃত বাড়ি কলকাতায়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজের পড়াশোনা শেষ করে বেশ কিছুদিন পর তিনি আমাদের এই গ্রামের স্কুলটিতে ইতিহাসের শিক্ষক হয়ে আসেন। তিনি বলেন শিক্ষকতা শুধুমাত্র তার পেশাই নয়, বরং নেশাও। আমরা সকলে তার ক্লাসে কোন প্রকার গোলযোগ করিনা। ক্লাসের সব থেকে বেশি দুরন্ত ছাত্রটিও নির্মল স্যারের পড়ানো মন দিয়ে শোনে।

প্রথম সাক্ষাৎ:

প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবার পর আমি যখন এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন আমার মনে ভয় ছিল এই বিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ে। যদিও পঞ্চম শ্রেণীতে বিভিন্ন শিক্ষক এবং শিক্ষিকাদের স্নেহের সান্নিধ্যে এই ভয় অনেকটাই দূর হয়ে গিয়েছিল। তখনো আমার সাথে নির্মল স্যারের পরিচয় হয়নি। স্যারকে আমরা প্রথমবার চিনলাম ষষ্ঠ শ্রেণি শুরুতে।

সেই বছরের শুরুর প্রথম সপ্তাহে একদিন বিদ্যালয়ে টিফিনের পরের পিরিয়ডে বেঁটেখাটো যুবাবয়স্ক নতুন একজন শিক্ষক আমাদের ক্লাসে এলেন। এসে প্রথমেই তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে নিজের নামটি বড় বড় অক্ষরে লিখে দিলেন। সেই প্রথম স্যারের সাথে আমাদের পরিচিতি। তারপর একে একে তিনি আমাদের সকলকে দাঁড় করিয়ে নিজেদের নাম, জীবনে কি হতে চাই এবং শখ জিজ্ঞাসা করলেন। তার হাসিখুশি স্বভাব এবং আমাদের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ প্রথম দিনই সকলের মন জয় করে নিল। 

কেন আমার প্রিয়:

নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায় স্যার কেন আমার এত প্রিয় তার নির্দিষ্ট কোনো একটি কারণ নেই। প্রথম দিন থেকে আমাদের সকলের সাথে তার মিশুকে আচরণের কারণে শ্রেণীর সকল ছাত্ররা তাকে নিজেদের খুব কাছের মনে করতে থাকলো। দ্বিতীয়তঃ আমার কাছে ইতিহাস বিষয়টি শুরু থেকেই খুব জটিল এবং কঠিন বলে মনে হতো। এমন একটি বিষয়কে নির্মল স্যার অত্যন্ত সহজ ভাষায় গল্পের আকারে আমাদেরকে বুঝিয়ে দেন।

তার বোঝানোর পর আলাদা করে বইয়ের কঠিন ভাষা পড়বার প্রয়োজনও আমাদের হয় না। কোন ছাত্র যদি ইতিহাসের কোন জায়গায় বুঝতে অসুবিধা বোধ করে, তাহলে তাকে তিনি বিদ্যালয় ছুটির পর আলাদা সময়ে বিষয়টি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেন। আমি বহুবার তার কাছে বিদ্যালয়ের মাঠে বসে ছুটির পর ইতিহাসের নানান গল্প বুঝে নিয়েছি।

তাছাড়া ৪৫ মিনিটের একটি ক্লাসে প্রথম ৩০ মিনিট পড়াবার পরে তিনি আমাদেরকে নানান ধরনের সৃজনমূলক খেলাধুলা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন আশ্চর্যজনক গল্প বলে থাকেন। ফলে আমরা তার ক্লাসে শুধুই পড়তে পড়তে কখনো ধৈর্য হারিয়ে ফেলি না। এছাড়া জীবনের কোন প্রকার ছোটখাট সমস্যা নিয়ে তার কাছে হাজির হলেও স্যার আমাদেরকে বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে থাকেন। 

একটি স্মরণীয় ঘটনা:

তখন আমি সবে মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছি। সপ্তম শ্রেণীর ক্লাস শুরু হয়েছে, এমন একদিনে টিফিনের সময় খেলতে খেলতে হঠাৎ মাঠে পড়ে গিয়ে আমার মাথা ফেটে যায়। সহপাঠীরা ধরাধরি করে আমাকে প্রধান শিক্ষকের ঘরে নিয়ে গেলে, সেখানেই বিদ্যালয় তরফ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। অবিলম্বে বাড়িতে খবর দেওয়া হলে বাবা এসে আমায় নিয়ে যান।

পরদিন সকালবেলা হঠাৎ নির্মল স্যার বাড়িতে আমায় দেখতে আসেন। মা-বাবার সাথে বসে সে কথা বলেন এবং সবশেষে আমার কাছে এসে বোঝান যে জীবনে চলার পথে এমন চোট বহু লাগবে, কিন্তু সেগুলিকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়াতেই জীবনের সার্থকতা।

স্যারের ঐ কথাগুলি সারাজীবন আমার মনে থাকবে। সেই দিনটি থেকেই তিনি আমার মনের মনিকোঠায় স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন। এখনো যখন প্রত্যেকদিন বিদ্যালয়ে যাই, তখন ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করে থাকি নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্যারের ক্লাসটুকুর জন্য।

উপসংহার:

আমাদের মত প্রত্যেক ছাত্রের জীবনেই এই রকম কোনো না কোনো শিক্ষক তার স্নেহ, ব্যক্তিত্ব ও ভালোবাসা দিয়ে হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তাদের প্রতি আমাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা বাড়তে বাড়তে কখন যে তারা আমাদের জীবনের আদর্শ হয়ে ওঠেন, তা আমরা বুঝতেও পারি না। এই যেমন আমিই বড় হয়ে নির্মল স্যারের মতন হতে চাই। জীবনে নম্রতা, ভদ্রতা এবং স্নেহবাৎসল্যের প্রাচুর্য সত্বেও যে নিজের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব বজায় রাখা যায় তা আমি আমার এই প্রিয় শিক্ষকের কাছ থেকে শিখেছি।

আমার প্রিয় শিক্ষক রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান। আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো। সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন