আমার প্রিয় শহর (কলকাতা) রচনা [সঙ্গে PDF]

বর্তমান যুগের শহুরে জীবনে যে মানুষ যে শহরে থাকে সেই শহরের সঙ্গেও জড়িয়ে যায় মানুষের আবেগ ও ভালোবাসা। আর সেই শহর যদি হয় প্রাণবন্ত নগরী তিলোত্তমা কলকাতা, সেই শহর নিজস্ব স্বকীয় অনন্য মহিমায় আপন করে নেয় সকল মানুষকে। তেমনি সকল কলকাতাবাসীর প্রিয় শহর কলকাতাকে নিয়েই আমাদের আজকের এই আমার প্রিয় শহর কলকাতা প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

আমার প্রিয় শহর কলকাতা রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

সিটি অফ জয় নামে পরিচিত আমার জন্মস্থান কলকাতা আমার প্রিয় প্রানের শহর। ভারতের পূর্ব প্রান্তে উত্তরপূর্ব ভারতবর্ষে প্রবেশের দুয়ারে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী হল কলকাতা। নাম একটু সামান্য শহর হলেও আদপে এই শহরটি সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ। এখানে আমরা প্রায় সমস্ত ধর্ম ও জাতির  মানুষকে একসাথে দেখতে পাই।

এখানে মানুষ ধর্ম বর্ণ জাতিগত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে জীবন সংগ্রামে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে পথ চলে। দুর্গাপুজোর ভিড় থেকে ক্রিসমাসের যানজট, সব মিলেমিশে পাঁচমিশালি শহর আমাদের এই কলকাতা।

জীবনের শত দুঃখ, দারিদ্র, অভাব কিংবা চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের কলকাতা শহর হাসতে জানে, ভালবাসতে জানে, জানে অতি সহজে সরল মনে সকলকে আপন করে নিতে। বহু ইতিহাস বুকে নিয়ে, বহু সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে স্থবির দাঁড়িয়ে থাকা পরম প্রাণবন্ত এই শহর কেন আমার এত কাছের, এতোখানি প্রিয় তা ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যেই এই উপস্থাপনা।

কলকাতা শহরের ইতিহাস:

কলকাতা শহরের ইতিহাস ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য বিভিন্ন শহরের মতো প্রাচীন না হলেও ভারতবর্ষের ইতিহাসে কলকাতা শহর একেবারে নবাগতও নয়। এ শহরের ইতিহাস ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো। যতদূর জানা যায়, বাংলার ধনী সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার বর্তমান কলকাতার বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে জমিদারি পরিচালনা করত।

পরবর্তীতে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ বণিক জোব চার্নক এই অঞ্চলে কলিকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি এই তিনটি গ্রাম কিনে নিয়ে বর্তমান কলকাতা নগরীর পত্তন করেন। তারপর থেকে কলকাতা শহরকে আর কখনো পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতায় ধীরে ধীরে চেপে বসা ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর শিকড় ছিল কলকাতাতে। এ শহর যেমন একদিকে ব্রিটিশ বণিকদের আগমন দেখেছে, তেমনিই স্বাগত জানিয়েছে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ কিংবা আর্মেনীয়দেরও।

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের ক্ষণকালের জন্য কলকাতা শহর থেকে বিতাড়িত করে এ শহরের নাম রেখেছিলেন আলিনগর। তারপর হুগলি নদীতে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে; কলকাতা শহর ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেখেছে তীব্র গণ আন্দোলন, দেখেছে ধর্মে-ধর্মে দাঙ্গা। কলকাতার মাটি লাল হয়ে গেছে মানুষের রক্তে। ইতিহাসে সমৃদ্ধ এমন এক শহরকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়!

শহুরে জীবনের চালচিত্র:

কলকাতা শহর নানা অংশে বিভক্ত। সময়ের সাথে সাথে শহরের জনসংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে শহরের আয়তনও। ফলে চারিপাশের চেনা সীমানা ছাড়িয়ে কলকাতা বিস্তার লাভ করেছে অনেক দূর পর্যন্ত। বর্তমানে প্রধানত কলকাতা শহরের তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলি হল: উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ কলকাতা। উত্তর কলকাতা হল কলকাতার সবচেয়ে আদি অংশ।

শহরের এই অংশে পুরনো সব বাড়ি, বড় বড় বনেদি একান্নবর্তী পরিবার, মানুষের জীবনযাত্রায় সাবেকি চাল ইত্যাদি উত্তর কলকাতার অনন্য বৈশিষ্ট্যকে বয়ে নিয়ে চলে। শহরের এই অংশের মধ্যে বাগবাজার, শোভাবাজার, শ্যামবাজার, হেদুয়া ইত্যাদি অঞ্চল অন্যতম। উত্তর কলকাতা পেরিয়ে খানিক দক্ষিণে পৌছলে আসবে মধ্য কলকাতা। এই অঞ্চল বিশেষত নানা প্রকারের বাজারে ভর্তি।

‘কলকাতায় চাইলে বাঘের দুধ পাওয়া যায়’- এমন প্রবাদের উদ্ভব হয়তো হয়েছে শহরের এই অংশটির কারণেই। মধ্য কলকাতার ধর্মতলা, পার্কস্ট্রিট কিংবা ময়দান পেরিয়ে শুরু হয় দক্ষিণ কলকাতা। শহরের এই অংশটি তুলনামূলকভাবে নতুন। উত্তর কলকাতার উপর জনসংখ্যার চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকার কারণে এই অঞ্চলের সৃষ্টি। এই অঞ্চলের মানুষ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী আধুনিক জীবনযাপনে করে থাকে। আধুনিক যুগের ক্যাফে কালচার দক্ষিণ কলকাতায় বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করেছে।

কলকাতা শহরের ঐতিহ্য:

সুদীর্ঘ অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলার কারণে এই কলকাতা শহর নানা ঐতিহ্য দ্বারা মন্ডিত। ব্রিটিশ ভারতের প্রধান শাসন ব্যবস্থা আমাদের এই কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতাই ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। ইংরেজরা ভারতবর্ষের তাদের এই বাসস্থানকে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের অনুরূপ করে গড়ে তুলেছিল। ফলে কলকাতায় দিকে দিকে চোখ ফেরালে এখনও দেখা যায় বিভিন্ন ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন।

ইংরেজরা কলকাতাকে সত্যই করে তুলেছিল প্রাসাদ নগরী। কলকাতার ঐতিহ্য রূপে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাওড়া ব্রিজ, ট্রাম, পাতাল রেল তথা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মতন সৌধ। এছাড়া দীর্ঘদিন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী থাকার কারণে পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল কলকাতা। সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অসংখ্য মনীষা সমগ্র ভারতবর্ষকে একসময় পথ দেখিয়েছে। সময়ের বিবর্তনে এই কলকাতাই হয়ে উঠেছে বৃটিশের বিরুদ্ধে ভারতীয় আন্দোলন তথা রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র।

কলকাতা শহরের সংস্কৃতি:

আমার প্রানের মহানগরী কলকাতা নানাবিধ বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সার্থক মিলনক্ষেত্র। এক সময়ে শহরকে কেন্দ্র করেই বিকাশ লাভ করেছে সমকালীন ভারতবর্ষের সর্বোৎকৃষ্ট সংস্কৃতি। এই শহরের বুক থেকে উঠে এসেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ কিংবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতন অসংখ্য সাহিত্যিক ও কবিরা।

এছাড়া এই শহর চলচ্চিত্র নির্মাণেও পথ দেখিয়েছিল সমগ্র ভারতবর্ষকে। তাছাড়া কলকাতার চলচিত্র জগৎ থেকেই বিখ্যাত হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন কিংবা ঋতুপর্ণ ঘোষের মতন প্রবাদপ্রতিম পরিচালকেরা। কলকাতার মানুষ এখনো প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে কলকাতার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উদযাপন করে। এজন্য বাঙালির জীবনে ধর্মীয় উৎসব এর তুলনায় সাংস্কৃতিক উৎসব এর সংখ্যা অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে উৎসবের আলোচনায় বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় কলকাতার দুর্গাপুজোর কথা।

এই দুর্গাপুজো রাজ্য ও রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীতে খ্যাতি লাভ করেছে। নিজস্ব চরিত্রে কলকাতা এই উৎসবের ক্ষেত্রেও ধর্ম ও জাতির ভেদাভেদ ঘুচিয়ে একে মানুষের সার্থক মিলনোৎসবে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছে। তাই সার্থকভাবেই কলকাতাকে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে । 

খাবার-দাবারে কলকাতা:

আমার প্রিয় শহর কলকাতাকে ভালোলাগা ও ভালোবাসার আলোচনায় কলকাতার খাবার-দাবারের কথা উল্লেখ করতেই হয়। কলকাতার খাবার-দাবার এখানকার অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে সমগ্র ভারতবর্ষে বিখ্যাত। একজন মানুষ এখানে যেমন অতি স্বল্প খরচে একটি গোটা দিনের খাওয়া-দাওয়া করতে পারে, তেমনি সমগ্র দিনের খাওয়া দাওয়ার জন্য কেউ বিপুল খরচ করতে চাইলেও এ শহরে তা অসম্ভব নয়।

এছাড়া বিশেষভাবে উল্লেখ করতে কলকাতার খাদ্য বৈচিত্র্যের কথা। কোন ধরনের খাবারটা পাওয়া যায়না এই শহরে! চাইনিজ, মোগলাই, মহাদেশীয়, উত্তর ভারতীয়, দক্ষিণ ভারতীয় ইত্যাদি সব ধরনের খাবারের সন্ধান এই শহরে মেলে। আর খাবারের মধ্যে বিখ্যাত হলো কলকাতার বিরিয়ানি এবং কলকাতার মিষ্টি। বাংলার জিআই ট্যাগ পাওয়া রসগোল্লা এই কলকাতা শহর থেকেই সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

উপসংহার:

সময়ের সাথে পাল্লা দিতে দিতে কলকাতা শহরের বিভিন্ন চরিত্রে অসংখ্য পরিবর্তন এসেছে। আজ বড় বড় বনেদি বাড়ির স্থান দখল করছে দম্ভ ভরা বহুতল। মানুষের জীবনের চূড়ান্ত ব্যস্ততা ও গতিময় জীবনযাত্রার সাথে তাল মেলাতে না পেরে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে কলকাতার সাবেকিয়ানা। তবুও কলকাতা তার মূল চরিত্র থেকে এতটুকু বিচ্যুত হয়নি।

আজ কলকাতার মানুষ তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে একইভাবে সমাদর করে। একইভাবে নিজের ইতিহাসকে উদযাপন করতে শহরবাসী মেতে ওঠে। কলকাতা শহরের অলিতে গলিতে কান পাতলে আজ শোনা যায় ইতিহাসের স্পন্দন। এ বিশ্বের মানব সভ্যতার সার্বিক চরিত্রের আমূল পরিবর্তনে কলকাতা সেই আধুনিকতাকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করেও নিজস্ব স্বকীয় সত্তাকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে। তাই শুধু আমার কাছেই নয়, কলকাতার বাইরেও এমন বহু মানুষ আছেন যাদের কাছে কলকাতা তাদের প্রিয় প্রানের শহর।


উপরিউক্ত প্রতিবেদনটিতে আমরা তিলোত্তমা নগরী কলকাতাকে ভাললাগার ও ভালোবাসার কারণগুলি যথাযথভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশাকরি আমার প্রিয় শহর কলকাতা শীর্ষক এই উপস্থাপনাটি আপনার ভালো লেগেছে। এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনাদের মতামত মন্তব্যের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের প্রতিবেদনকে ভবিষ্যতে আরো উপযোগী করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন