আমার জীবনের লক্ষ্য শিক্ষক হওয়া রচনা [সঙ্গে PDF]

আমাদের প্রত্যেকের জীবনেরই নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য থাকে। শৈশব লক্ষ্য পূরণের জন্য আমরা ছেলেবেলা থেকে প্রস্তুত হয়ে ধীরে ধীরে লক্ষ্য পূরণের পথে এগিয়ে যাই। শিক্ষকতা হল পৃথিবীর অন্যতম পবিত্র একটি পরিষেবা। তাই আমি শিক্ষকতাকে আমার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্বাচিত করে পরবর্তী প্রতিবেদনটির উপস্থাপনা করতে চলেছে।

ভূমিকা:

ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্য অনুযায়ী মনে করা হয় এ পৃথিবীতে প্রত্যেকের আগমনের কিছু না কিছু পৃথক গুরুত্ব রয়েছে। মানুষকে শুধুমাত্র তার নিজের জীবন দিয়ে, বা বলা ভাল জীবন দর্শন দিয়ে পৃথিবীর প্রতি নিজের সেই পৃথক ভূমিকাটিকে নির্বাচন করে নিতে হয়।

ছেলেবেলা থেকে বড় হওয়ার পথে মানুষের মনে যখন প্রক্ষোভের সঞ্চার ঘটে তখন আপন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানুষ নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে নেয়। আমিও বিশ্বের এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের ব্যতিক্রম নই। জীবনে চলার পথে নিজের লক্ষ্য হিসেবে আমি নির্ধারণ করে নিয়েছি শিক্ষকতাকে। জীবন দর্শনের দোত্যনা দ্বারা নিজেকে একজন সার্থক শিক্ষক রূপে গড়ে তুলতে পারলে তবেই আমার এই লক্ষ্য পূরণ হবে।

জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের গুরুত্ব:

জীবনের সুস্থ যাপনের জন্যে তার একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা অভিমুখ থাকা একান্ত জরুরি। জীবনের অনেক সময় অনেকভাবে আমরা অপচয় করে ফেলি, যার কোন ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হয় না।মানুষের নিজস্ব একটা লক্ষ্যস্থান থাকলে সেই স্থানেই সে নিজেকে উন্নীত করতে পারে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কোনো না কোনো স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য মানুষকে পরিশ্রম ও সাধনা করতে হয়।

নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকলে জীবনে সফলতা লাভ করা যায় না। কান্ডারি বিহীন তরী যেমন অকূল মহাসমুদ্রে তীর খুঁজে পায়না, তেমনি লক্ষ্যবিহীন জীবনও এ কন্টকাকীর্ণ পৃথিবীতে সাফল্যের সোপান খুঁজে পায় না। মানুষের মনের মধ্যে লালিত স্বপ্নই তাকে তার লক্ষ্যের বন্দরে পৌঁছে দেয়। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে জীবনে বিপথগামী, লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা অর্থবহ লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন।

এই প্রসঙ্গে ডা. লুৎফর রহমান এর বক্তব্য স্মরণীয়- ‘জীবনের প্রথম থেকে ঠিক করে নাও তুমি কোন কাজের উপযুক্ত। এটা একবার, ওটা একবার করে যদি বেড়াও তাহলে তোমার জীবনের কোনো উন্নতি হবে না। এরূপ করে অনেক লোকের জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তোমার যেন তা না হয়।’ 

লক্ষ্য নির্বাচনের সঠিক সময়:

ছাত্রজীবন আদতে তপস্যার সময়। এই সময় কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের সময়। তাই ছাত্রজীবনে কোনো অর্থবহ লক্ষ্যকে সামনে রেখে সঠিক পথে পরিশ্রম ও মনপ্রাণ দিয়ে সাধনা করলেই লক্ষ্যে পৌঁছে জীবনকে সার্থক করা যায়। তাই ছাত্রাবস্থাতেই একটি লক্ষ্য স্থির করে তাকে বাস্তব রূপদান করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হয়।

কেন শিক্ষকতা:

শিক্ষকতাকে আমার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়ার পিছনে বিশেষ কতকগুলি কারণ বিদ্যমান। আমার কাছে শিক্ষকতা হল পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র পরিষেবা। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো শিক্ষকতাকে পেশা না বলে পরিষেবা বলার কারণ, পেশার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে অর্থের আদান-প্রদান।

কিন্তু শিক্ষকতার ক্ষেত্রে জীবনধারণের প্রয়োজনে অর্থের আদান-প্রদান থাকলেও শিক্ষকতা সার্থক রূপ অর্থের বিনিময় এর মাধ্যমে আসতে পারে না। চরম বিপদের দিনেও যে কোন মানুষকে ছেড়ে যায় না তা হলো মানুষের শিক্ষা। এই শিক্ষাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেন সমাজের শিক্ষকেরা। তাই তারা হলেন সমাজ বন্ধু। সমাজ বন্ধুর দান করা এই অমূল্য পরিষেবাকে অর্থের মাপকাঠি দ্বারা বিচার করা কখনোই বাঞ্ছনীয় নয়।

সমাজে শিক্ষকের ভূমিকা:

মানবসমাজে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যথাযথ শিক্ষক ছাড়া একটি সমাজ অচিরেই দিকভ্রষ্ট হতে পারে।শিক্ষকেরা একটি সমাজকে জ্ঞানের সুষম বন্টন দ্বারা নতুন পথের দিশা। শিক্ষকদের হাত ধরে একের পর এক প্রজন্ম নিজেদের জীবনে চলার দিকনির্দেশ খুঁজে পায়।

পৃথিবীর প্রত্যেকটি কাজ কোন না কোন শিক্ষারই ফলাফল। তাই শিক্ষকদের ব্যাপ্তিও সমাজের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সমাজের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনো ভাবে কোনো না কোনো শিক্ষক তার পেশাগত জীবনে কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে 

ইতিহাসে শিক্ষকতা:

পৃথিবীর ইতিহাসে শিক্ষকদের স্থান বরাবরই উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। ভারতীয় উপমহাদেশে ঐতিহ্যগত এবং ঐতিহাসিক ভাবে শিক্ষকদের সমাজে সর্বোচ্চ মর্যাদা দানের কথা বলা হয়েছে। এইখানে শিক্ষকেরা সমাজের সাধারণ মর্যাদা অতিক্রম করে গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত হন। আর ভারতীয় উপমহাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিটি মানুষের কাছে তাদের গুরুই হন প্রধান উপাস্য।

ভারতীয় উপমহাদেশে যুগে যুগে অসংখ্য রত্নসম জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাদের জীবন দর্শন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সমাজে একজন শিক্ষকের ঠিক কি রকম হওয়া উচিত। ভারতবর্ষের ইতিহাসে আর্যভট্ট, বরাহমিহির, পানিনি, কণাদ প্রমুখের মত প্রবাদপ্রতিম প্রতিভারা যুগ যুগ ধরে শিক্ষকতার নজির সৃষ্টি করে গিয়েছেন।

আর ভারতে শিক্ষা কতার ইতিহাসের আলোচনায় যে মানুষটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় তিনি হলেন বিষ্ণুগুপ্ত শ্রী চাণক্য কৌটিল্য। তিনি তাঁর অসীম ক্ষুরধার বুদ্ধি এবংজ্ঞানের বিপুল ভান্ডার দ্বারা একজন অতি নগন্য বালককে রাষ্ট্র শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট রূপে। 

শিক্ষকতার নৈতিক অবক্ষয়:

পৃথিবীর বুকে শিক্ষকদের স্থান বরাবরই উচ্চমানের হওয়া সত্বেও বর্তমান যুগের চতুর্দিক ব্যাপী নৈতিক অবক্ষয় থেকে রেহাই পায়নি শিক্ষক সমাজ। প্রসঙ্গত এ কথা মনে রাখা দরকার শিক্ষকরাও আমাদের মতই সাধারন মানুষ এবং সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই সমাজকে যদি কোন অবক্ষয় গ্রাস করে তাহলে শিক্ষকদের ওপর তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। এই নিয়মের ব্যতিক্রম এখনো হয়নি।

বর্তমান যুগে শিক্ষকতা পরিষেবার স্থান থেকে নেমে এসেছে পেশাগত সঙ্কীর্ণতায়। পৃথিবীর বহু অঞ্চলে ভোগমূলক সভ্যতার ব্যাপক বিকাশ এবং বিশ্বায়নের ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে পেশাগত আর্থিক লেনদেন অত্যন্ত সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। শিক্ষা আজ নেমে এসেছে পণ্য বিকিকিনির পর্যায়ে। শিক্ষকেরা সমাজের ভিত্তিকে মজবুত করেন। সেই শিক্ষকদেরকে যদি এমন অবক্ষয় গ্রাস করে তাহলে সমাজের ভিতরটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে।

আমার লক্ষ্য পূরণে পরিকল্পনা:

প্রত্যেকটি মানুষের লক্ষ্য পূরণের জন্য নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। এই পরিকল্পনা গুলির মাধ্যমে মানুষ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে পারে। আমিও আমার জীবনের লক্ষ্য শিক্ষক হওয়ার জন্য পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে চলেছি। আমার পছন্দের বিষয় হল ইতিহাস।

আমি ঠিক করেছি আমি বড় হয়ে এই বিষয়ের শিক্ষক হব। সেই জন্য স্কুল জীবন শেষ করে ইতিহাসে স্নাতক নিয়ে পড়াশোনা করে আমার শিক্ষকতা নিয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে। আমি প্রথমত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাই। আমি মনে করি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাটানো দিন গুলি হল হল বিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়।

এই সময়ই আমরা নিজেদের শিক্ষাগত চরিত্র বুঝতে পেরে পরবর্তীকালে সাধারণ বিষয়গুলিকে গভীরভাবে পড়বার জন্য নিজেদের তৈরি করে থাকি। আমি শিশু মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে সমাজের ভবিষ্যতের সেইসব কারিগরদের তৈরি করতে চাই।

উপসংহার:

আমরা আজ এই পারস্পারিক হিংসা হানাহানির যুগে,এই কঠিন সময়ে ভালো কিছু করার কথা, অন্যের বিষয়ে ভাববার কথা ভুলতে বসেছি। কেউ আজ আত্মস্বার্থের কথা ভুলে জাতির সেবায় আত্মনিয়োগের কথা ভাবলে সে সমাজে উপহাসের পাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। তবু আশা রাখি যে আজ যা আমার স্বপ্ন, আমার জীবনে তাকে বাস্তবায়নের পথে আমি সফল হব।

আর্তপীড়িত মানুষের দুঃখ কিংবা দারিদ্রের অভিশাপ সার্বিক রূপে দূর করার ক্ষমতা হয়তো আমার কখনও হবেনা, কিন্তু আমার এই লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে সমাজের ভিত্তিকে মজবুত করবার যে ক্ষমতা আমি আয়ত্ত করব- তা দিয়েই সকলের মঙ্গলসাধনের চেষ্টায় ব্রতী হব আমি, এই আমার জীবনের লক্ষ্য।


উপরিউক্ত আমার জীবনের লক্ষ্য শিক্ষক শীর্ষক রচনাটিতে আমি সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সবকটি দিক নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আমাদের এই প্রয়াস আপনার ভালো লাগবে এবং নির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুযায়ী আপনাকে সহায়তা করবে এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্ট এর মাধ্যমে আমাদের জানান।

আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।। 

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন