অধ্যবসায় রচনা [সঙ্গে PDF]

স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার একনিষ্ঠ ও নিরলস প্রচেষ্টার নাম অধ্যবসায়। সাফল্য অর্জন করার পথে সকল প্রতিকূলতাকে জয় করার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হল অধ্যবসায়। ছাত্র জীবনে অধ্যবসায় এর গুরুত্ব নিয়ে আজকের উপস্থাপন অধ্যবসায় রচনা।

অধ্যবসায় রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

“কেন পান্থ ক্ষান্ত হও হেরি দীর্ঘ পথ
উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ?”

কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার।

জীবনের সঙ্গে সময়, কর্ম এবং কর্মের সঙ্গে অধ্যবসায়- এ যেন একই সুতোয় গাঁথা মালা। একটি বাদ পড়লে অপরটিতেও টান পড়ে। প্রত্যেক মানবজীবনে এক কর্মযজ্ঞ নিরন্তর চলমান, আর এই কর্মযজ্ঞে সাফল্য ব্যর্থতা দুইই যেন “চক্রবৎ পরিবর্তন্তে”। তবু মানুষ সর্বদা সাফল্যের প্রতিই ধাবমান হয়, আর অধ্যবসায় হল যেন এই সফলতার গুপ্ত চাবিকাঠি।

অধ্যবসায় ছাড়া মানবজীবনে সাফল্য এক দিবাস্বপ্ন মাত্র। অধ্যবসায় তাই প্রতিটি মানুষের জীবনে এক অবশ্য পালনীয় অভ্যাস যা তাকে পরিবর্তে সাফল্য এনে দেয়। এযাবৎকালের যত সফল মানুষের উদাহরণ আমরা দেখতে পাই, প্রত্যেকের জীবনে অধ্যবসায় এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

অধ্যবসায়ের সংজ্ঞা এবং তার বৈশিষ্ট্য:

মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে তার জীবনকে সুন্দর করে সাজানোর, তার ইচ্ছে মত জীবন চালানোর, সকলেই চায় সফলতার মুখ দেখতে- কিন্তু জীবনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, বরং কণ্টকাকীর্ণ। মানুষ তার জীবৎকালে যেসমস্ত কাজ সমাধা করতে চায়, সেই সব কাজেই সহজে সাফল্য পাওয়া যায়না। অনেক কাজেই সাফল্য একবারে আসেনা।

বরং বারংবার চেষ্টা আর নিরলস পরিশ্রমই সাফল্য এনে দিতে পারে সেসব ক্ষেত্রে। একবারের চেষ্টায় সাফল্য না এলে তাই হতাশ হতোদ্যম হলে কাজে সাফল্য পাওয়া দুরাশা মনে হতে পারে। সাফল্য লাভের আশায় বুক বেঁধে বারবার এই প্রয়াস করে যাওয়াই আদতে অধ্যবসায়। অধ্যবসায়ের এমন দুরূহ ধারণাকেই কবি প্রচলিত প্রবাদ এর মতন ফুটিয়ে তুলেছেন একটি কবিতায়-

“পারিবনা এ কথাটি বলিও না আর, 
কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার;
পাঁচজনে পারে যাহা,
তুমি ও পারিবে তাহা,
পারো কি না পারো করো যতন আবার
একবার না পারিলে দেখো শতবার।”

কোন কাজে সাফল্য পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে নিরলস প্রচেষ্টা করে যাওয়ার নামই অধ্যবসায়। এই অধ্যবসায় আসলে কয়েকটি বিশেষ গুণের সমাহার। চেষ্টা, উদ্যোগ, আন্তরিকতা, পরিশ্রম, ধৈর্য ও হতাশ না হওয়া- এই সকল গুণের একত্র সাধন এর মধ্যে দিয়েই মানুষের অধ্যাবসায় সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে।

শুধুমাত্র ভাগ্যের দিকে চেয়ে না থেকে, পরিশ্রম এবং ধৈর্য কে অবলম্বন করে নিজের মনের আপন বিশ্বাস ও স্বপ্নগুলোকে বাস্তব রূপদানের আন্তরিক প্রচেষ্টার মধ্যেই নিহিত রয়েছে অধ্যাবসায়ের সার্থকতার মূল বাণী। 

অধ্যবসায়ের গুরুত্ব:

মানবসভ্যতার বর্তমান যে উন্নয়ন, তার মূলে অধ্যবসায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আদিম গুহাজীবন থেকে আজকের সভ্য নগরজীবনে উঠে আসতে মানবজাতির একমাত্র হাতিয়ার ছিল এই অধ্যবসায়ই। মানবজীবনের যেকোন কাজে বাধা আসাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সেই বাধাকে ভয় পেলে কিংবা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলে সাফল্য অধরাই থেকে যাবে।

রাতের অন্ধকার পেরিয়ে যেমন দিনের আলোর প্রকাশ ঘটে, ঠিক তেমনই, বারবার অবিশ্রাম চেষ্টার পরেই মানুষের ভাগ্যাকাশে উদিত হয় সাফল্যের সূর্য। অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ বড় হয়, সে যেকোন অসাধ্য সাধন করতে পারে। পৃথিবীতে সকল ধর্মগ্রন্থ তথা দার্শনিক আকরগ্রন্থে অধ্যাবসায়কে একটি মহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

মেধা, সুযোগ কিংবা বিশ্বাস, কোনটাই মানুষকে চূড়ান্ত সাফল্য এনে দিতে পারবেনা যদি না অধ্যবসায়কেই মুখ্য করে তোলা যায় এদের যথাযথ প্রয়োগে। নিজেকে একজন সত্যিকার সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে অধ্যবসায়ের কোন বিকল্প নেই। অধ্যবসায়ী মানুষই সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে পারে। নিরাশা বা ব্যর্থতার গ্লানিকে মুছে নতুন করে শুরু করার একমাত্র পথ হল অধ্যবসায়ী হওয়া- কেননা, Failure is the pillar of success. 

অধ্যাবসায়ের আদর্শ:

জীবনসংগ্রামে জয়লাভের মূলমন্ত্র হল অধ্যবসায়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় মধ্যযুগীয় ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কথা। কেবলমাত্র অধ্যাবসায়ের জোরেই নেপোলিয়ান সামান্য এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান থেকে ফ্রান্সের সম্রাট হতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে আমাদের দেশেও অধ্যাবসায়ের আদর্শকে পাথেয় করে জীবনে সাফল্যের মুখ দেখার উদাহরণ কম নেই।

একদিকে শ্রীনিবাস রামানুজন, অন্যদিকে জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, তথা এপিজে আবদুল কালাম- এরা সকলেই কেবলমাত্র অধ্যাবসায়ের আদর্শকে সামনে রেখে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের জীবনে সফল হয় সমগ্র বিশ্বের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। অধ্যবসায়ের আদর্শ ব্যতীত জীবনে সাফল্য আসা এক প্রকার অসম্ভব বলা যেতে পারে।

এই অধ্যাবসায়ের নিয়মিত অভ্যাসের মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে দৃঢ়চেতা মোহন এবং আদর্শ, যা জীবনকে নিয়ে যায় সাফল্যের শিখরে। আদর্শের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করার পথ দীর্ঘ হতে পারে, কঠিন হতে পারে; কিন্তু সেই পথে বিশ্বাস হারালে ব্যর্থতার অতল গহবরে ডুবে যেতে হয়।

নিরলস প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার একমাত্র উপায় হলো নিজের ওপর পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস রাখা। অধ্যবসায়ের আদর্শকে সামনে রেখে আপন ব্যক্তিত্বের দাঁড়া ধৈর্যশীল হয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়াই সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি। সেজন্যই তো কবি লিখেছেন- 

“ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো! বাঁধো বাঁধো বুক,
শত দিকে শত দুঃখ আসুক আসুক।”

ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব:

অধ্যাবসায় জীবনের যে পর্যায়ে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো মানুষের ছাত্র জীবন। ছাত্রজীবনে অধ্যাবসায় ব্যতীত কোন ব্যক্তির জীবন গড়ে উঠতে পারে না। তাই বলা যায় ছাত্র জীবন এবং অধ্যাবসায় এই দুটি শব্দ পরস্পর সমার্থক ভাবে কাজ করতে পারে।

বাকি জীবনের মতোই ছাত্র জীবনে আসতে পারে চূড়ান্ত ব্যর্থতা। কিন্তু সেই ব্যর্থতায় গ্লানির নাগপাশে জড়িয়ে না পড়ে, অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে পরবর্তীর জন্য তৈরি করাই হল আদর্শ ছাত্রের কাজ। জীবনের অন্যান্য পর্যায়ের মত এই পর্যায়েও অধ্যবসায়ের আদর্শকে ভুলে হতোদ্যম হলে চলবে না।

ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব:

মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি ব্যক্তিই নিজের ভেতর কোনো না কোনো প্রতিভা নিয়েই পৃথিবীতে আসে। যারা মনে করে তাদের কোনো প্রতিভা নেই, আদপে তারা অধ্যাবসায়হীনতার কারণে নিজেদের সেই সুপ্ত প্রতিভাকে খুঁজে বার করতে ব্যর্থ হয়েছে।

কেউ যদি নিজেকে প্রতিভাহীন মনে করে হাল ছেড়ে দেয়, তাহলে হতাশার গ্লানি তাকে আচ্ছন্ন করে। স্বাভাবিকভাবেই আসে ব্যর্থতা। প্রকৃতপক্ষে জীবনে প্রতিভার থেকেও যে গুণটির গুরুত্ব সর্বাপেক্ষা বেশি, তা হলো অধ্যাবসায়। বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক স্যার আইজ্যাক নিউটনও তার জীবনে প্রতিভার থেকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন অধ্যাবসায়কে।

তার মতে শুধুমাত্র পরিশ্রম, ধৈর্য এবং অভ্যাসের মাধ্যমেই সাফল্যের শিখরে আহরণ করা যায়। তার জন্য আলাদা করে বিশেষ কোনো প্রতিভার দরকার হয় না। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার মনে করতেন, প্রতিভা বলে প্রকৃতপক্ষে কোন কিছুই নেই; যা আছে তা হল ধৈর্যশীল অধ্যাবসায়ের অঙ্গীকার।

জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব:

জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের সাথে সাথে জাতীয় জীবনেও অধ্যবসায়ের এক বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত মনে রাখা দরকার ব্যক্তিমানুষকে নিয়েই একটি জাতি গড়ে ওঠে। তাই কোন জাতির ব্যক্তি মানুষগণের গড় চারিত্রিক গুণই সেই জাতির সামগ্রিক চরিত্রে প্রতিফলিত হয়। এ কারণে কোন ব্যক্তি যখন অধ্যাবসায়ী হয়, সে তার নিজের সাথে সাথে তার জাতীয় ক্ষেত্রেও উন্নতি ঘটায়।

এইভাবে কোন জাতির ব্যক্তি সমষ্টি যখন অধ্যাবসায়ী হয়ে ওঠে তখন সেই জাতির সামগ্রিক চরিত্রই হয়ে ওঠে ধৈর্যশীল এবং অধ্যাবসায়ী। তাছাড়া একটি জাতির সামগ্রিক উন্নতি তখনই সম্ভব, যখন সেই জাতির প্রতিটি মানুষ অনন্ত অধ্যাবসায়কে পাথেয় করে সেই জাতির উন্নতির ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করবে। সেজন্য কোনোদিক থেকেই জাতীয় জীবনে অধ্যাবসায়ের গুরুত্বকে অস্বীকার করা চলে না। 

উপসংহার:

অধ্যবসায়ী ব্যক্তির জীবনের মূলমন্ত্র হল- ব্যর্থতাই সাফল্যের সোপান। নিজের অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজের এবং জাতির সামগ্রিক উন্নতিসাধন সম্ভব- একথা প্রমাণিত সত্য। “মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন”- অধ্যবসায় সম্পর্কে এটি একটি চরম সত্য প্রবাদ। যে ব্যক্তি অধ্যবসায়ী নয়, সে জীবনের সাধারণ কোন কাজেও সফলতা পায়না।

জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা এই অধ্যবসায়ের উপরেই নির্ভর করে, তাই প্রতিটি মানুষেরই উচিৎ অধ্যবসায়ের মত মহৎ গুণটিকে আয়ত্ত্ব করা। অধ্যবসায় আমাদের জীবনে পরশপাথরের মতো কাজ করতে পারে। যদি আমরা তাকে আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি, তবে তার ছোঁয়ায় আমাদের যেকোন কাজেই স্বর্ণসফলতা আসতে বাধ্য। 


অধ্যবসায় রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।এরকম নতুন নতুন ও পরীক্ষায় সম্ভাব্য রচনা পাওয়ার জন্য আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন। সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

“অধ্যবসায় রচনা [সঙ্গে PDF]”-এ 3-টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন