২০২০: অন্যরকম দুর্গাপূজা / করোনা আবহে দুর্গাপূজা রচনা [সঙ্গে PDF]

দুর্গাপূজা হলো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। এই উৎসবের সঙ্গে বাঙালি জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। ২০২০ সালে ভয়ঙ্কর মহামারীর প্রকোপে সেই জীবনই যখন সংকটে, তখন সেই সংকটের অনিবার্য প্রভাব পড়েছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের উপরেও। এই বছর বাঙালি প্রত্যক্ষ করেছিল এক সম্পূর্ণ অন্যরকম দুর্গাপূজা। সে দুর্গাপূজার রূপ কাম্য নয়, কিন্তু ভোলার মতনও নয়। ২০২০ সালের সেই অন্যরকম দুর্গাপূজার স্মৃতিচারণার উদ্দেশ্যেই আজকের এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

করোনা আবহে দুর্গাপূজা রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

২০২০ সালটি বিশ্বের সবার কাছে একটি অভিশপ্ত বছর হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই বছরে অন্যান্য সকল দুঃসংবাদকে অতিক্রম করে বছরটির শীর্ষক রূপে জায়গা করে নিয়েছিল করোনা মহামারী। কোন এক অজানা অচেনা ভাইরাস এসে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিল সমগ্র বিশ্বের জীবনযাত্রা।

মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রা সাথে সাথে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল মানুষের বেঁচে থাকার রসদ হিসেবে বছরভর চলতে থাকা উৎসবগুলিও। আমাদের বাংলার বুকে উৎসবের স্তব্ধতা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছিল ২০২০ সালের দুর্গাপূজার সময়। এমন অদ্ভুত এক দুর্গাপূজা ইহজনমে কাউকে দেখতে হবে এমন কল্পনাও হয়তো কেউ কখনো করেনি। করোনাভাইরাস-এর প্রাক্কালে এক অচেনা দুর্গাপূজার স্মৃতিচারণার উদ্দেশ্যেই এই প্রবন্ধের উপস্থাপনা।

বাঙালির দুর্গাপূজা:

করোনাভাইরাস এর প্রাক্কালে এবছরের দুর্গাপূজা কেমন কেটেছে তা নিয়ে কথা বলার আগে উল্লেখ করা প্রয়োজন বাঙালি দুর্গাপূজার স্বরূপ আসলে কেমন। কারণ তা না হলে মহামারীর প্রাক্কালে এ বছরের দূর্গাপূজা কেন অদ্ভুত তার ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব হল দুর্গাপূজা।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে দুর্গাপূজার সময় একযোগে, একস্থানে, এক উদ্দেশ্যে অংশগ্রহণ করে থাকে। একটি সমীক্ষা মতে প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার রাস্তায় দুর্গাপূজার দিনগুলিতে প্রতিদিন অন্তত পক্ষে এক কোটি মানুষের জনসমাগম হয়ে থাকে। সারা রাত ভোর কলকাতা এবং কলকাতার সংলগ্ন অঞ্চল জুড়ে মুহুর্মুহু যানবাহন চলাচল করে। মানুষের কোলাহলে, দুর্গাপুজোর আলোতে গমগম করে তিলোত্তমা কলকাতা।

মহামারীর অন্ধকারে শারদীয়া:

উপরিউক্ত পংক্তিতে দুর্গাপূজার যে রূপের কথা উল্লেখ করা হলো তার বিন্দুমাত্র লেশ এ বছরে ছিল না। মহামারী রোধের জন্য অনিবার্য সর্তকতা হিসেবে এ বছর দুর্গা পূজার বহু আগে থেকে সমগ্র দেশব্যাপী জারি করা হয়েছিল লকডাউন। মানুষের মধ্যে বিরাজমান ছিল সংক্রমনের ভয়ের আবহ।

উৎসবের মিলনের তুলনায় জীবনরক্ষার তাগিদ অনেক বেশি- এই উপলব্ধিতে উৎসবের দিনগুলিতে আত্মত্যাগ করতে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল মানুষ। কিন্তু প্রকৃতি তো আর মহামারীর বাধা মানে না। শারদীয়ার রং প্রকৃতির গায়ে লাগে নিজের নিয়মেই। মহামারীর অন্ধকারেও নীল আকাশের গায়ে ভিড় করে আসে পেঁজা তুলোর মতন সাদা মেঘ। এমন পরিবেশে মৃদুমন্দ হাওয়া দুলতে থাকা কাশ ফুলের মতন দুলে ওঠে বাঙালির মনও। এই ভাবেই কিছুটা ভালো লাগা আর অনেকখানি মন খারাপ একসাথে মিলে করোনা মহামারীর অন্ধকারে ফিরে আসে শারদীয়া।

শহুরে ঐতিহ্যের স্তব্ধতা:

দুর্গাপূজার দিনগুলিতে শহরের রাস্তায় ব্যাপক জনসমাগম, আলোর রোশনাই, মাইকে চলতে থাকা গান বাজনা ইত্যাদি বিষয়গুলি শহুরে শারদীয়ার শাশ্বত ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইসব উপাদান ছাড়া শহরের শারদীয়াকে উৎসব বলে মনেই হয় না। এই বছর স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র বিশ্বজুড়ে মহামারি পরিবেশ বিরাজমান থাকায় শহরের রাস্তাগুলি ছিল সেই সকল শাশ্বত ঐতিহ্যহীন।

আর্থিক অভাব হোক কিংবা সচেতন পদক্ষেপ- শহর কলকাতা অসংখ্য ছোট-বড় পূজা ২০২০ সালে বাতিল হয়ে গিয়েছিল। দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম নামকরা বেশ কয়েকটি পূজার ক্ষেত্রে এবছর নিয়মরক্ষাটুকুও হয়নি। যে ক’টি জায়গায় পূজা হয়েছিল সেগুলিও অত্যন্ত সর্তকতা মেনে, প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে। অধিকাংশ জায়গাতেই দর্শকদের এবছর ভিড় করতে দেওয়া হয়নি। 

কলকাতার অচেনা রাস্তাঘাট:

ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, মহানগরী কলকাতার রাজপথ দুর্গাপূজার দিনগুলিতে ব্যাপক জনসমাগমের ফলে রীতিমতন গমগম করে। কিন্তু এই বছর তিলোত্তমা নগরীর চিত্রটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। তেমন সংখ্যক পূজা মন্ডপ নেই, প্রতি বছরের মত শোনা যায় না ঢাকবাদ্যির মধুর আওয়াজ, মাইকে মাইকে গানের বদলে ক্রমাগত বেজে চলেছে মহামারী সম্পর্কিত সতর্কতাবাণী। রাস্তায় মানুষের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় কিছুই নয়।

প্রতিটি মণ্ডপের সামনে হাতে হাতে দেওয়া হচ্ছে স্যানিটাইজার, পুজোর নতুন জামা কাপড়ের সঙ্গে মুখের উপর যুক্ত হয়েছে সতর্কতামূলক মাস্ক। মণ্ডপের সামনে কোভিড সর্তকতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে গোল করে গণ্ডি কেটে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে গণ্ডিতেও মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মতন নয়।

প্রকৃতপক্ষে সংক্রমনের বিষয়ে মানুষের ভয় এবং সমগ্র দেশব্যাপী যানবাহনের সাধারন পরিষেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকায় মানুষজন এ বছরের দুর্গা পূজায় কলকাতামুখী হতেই পারে নি। আর কথায় আছে, কলকাতা ছাড়া বাঙালির দুর্গাপূজা সর্বদাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। 

উন্মাদনাহীন অষ্টমী:

দূর্গাপূজার দিনগুলির মধ্যে সবচেয়ে উন্মাদনা ভরা দিনের প্রশ্নে সর্বপ্রথম মাথায় আসে মহাষ্টমীর কথা। পূজার অন্যদিনগুলোতে যে যাই করুক, মহাষ্টমীর দিন প্রতিটি বাঙালির মনের প্রফুল্লতা সর্বোচ্চ মাত্রা পায়। এই পুণ্য তিথিতে বাঙালির দিন শুরু হয় দেবী দুর্গার চরণে পুষ্পাঞ্জলির মাধ্যমে। তারপর প্রতিটি বাঙালি ঘরে পালিত হয় ভিন্ন ভিন্ন পারিবারিক রেওয়াজ। তার জন্য বাজার, পথঘাট মানুষের ভীড় আর কোলাহলে ভরে থাকে। কিন্তু এই বছরের মহাষ্টমীর রোগ ছিল চোখে জল এনে দেওয়ার মতন।

পূজামণ্ডপে পুষ্পাঞ্জলির ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতন কম। বাজার তুলনামূলকভাবে অনেকখানি ফাঁকা। আর সর্বোপরি মহাষ্টমীর সন্ধ্যে থেকে কোলাহলপূর্ণ রাত্রি ছিল প্রায় নিস্পন্দ। অধিকাংশ মানুষই পূজামণ্ডপ দর্শনের তুলনায় কোন নিরাপদ স্থানে বসে সতর্কতাঃ মেনে জমায়েতকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। যে কজন মানুষ বাইরে বেরিয়ে ছিলেন তাদেরও প্রত্যেকের চোখে ছিলো অস্বস্তি, শরীরে ছিল সর্তকতা। শারদীয়ার আনন্দে গা ভাসিয়ে উদ্দাম মহাষ্টমীর রাত্রিযাপন ২০২০তে প্রায় চোখে পড়েনি বললেই চলে।

সতর্কতা এবং দেবী দর্শন:

এই বছর কোভিড সর্তকতা মেনে পুজা মণ্ডপগুলি মণ্ডপসজ্জা এবং দর্শকদের প্রবেশ ও দর্শনের ব্যবস্থা করেছিল। প্রতিটি মণ্ডপের সামনে ছিল মাস্ক এবং স্যানিটাইজারের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা। কোন কোন বড় পূজা মন্ডপ দর্শকদের শরীরের তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থাও করেছিলেন। শহরের রাস্তায় মাইকে মাইকে অনবরত ঘোষিত হচ্ছিল মহামারীর সচেতনতামূলক বার্তা।

অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি:

২০২০ সালের দুর্গাপূজায় আম বাঙালির উৎসবের আনন্দ যাপনে বিঘ্ন যেমন ঘটেছিল, তার থেকেও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সামাজিক এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। সমাজ আবদ্ধ থাকে উৎসবের বন্ধনে। সেই উৎসব উদযাপনে যদি বিঘ্ন ঘটে, স্বাভাবিকভাবেই সমাজের বন্ধনে পরোক্ষ শিথিলতা আসে। আর অন্যদিকে দুর্গাপূজার মতন বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবটির অপর নির্ভর করে আবর্তিত হয় এক বিশাল অংকের অর্থনীতি।

বহু মানুষের বার্ষিক উপার্জনে এই দুর্গাপূজা সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি অন্যরূপ হওয়ায় প্রতিমা শিল্পী, মন্ডপ শিল্পী, ঢাকি এবং অসংখ্য ছোট-বড় বিপণন কেন্দ্রগুলি বিক্রি তথা সাধারণ পুঁজির অভাবে ধুঁকে পড়েছিল। কোথাও কোথাও দূর্গা পূজার চাঁদা তুলে এই সকল মানুষদের সাহায্য করার নিদর্শন দেখা গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অতি নগণ্যই।

উপসংহার:

দুর্গাপূজা বাঙালির পরমানন্দের উৎসব। এই উৎসব বাঙালিকে করেছে বাঙালি, কলকাতাকে করেছে কলকাতা। দুর্গাপূজা ছাড়া বাঙালি এবং কলকাতাকে যেনো কল্পনাই করা যায় না। সে কারণেই ২০২০’র দুর্গোৎসব সত্যিই ছিল অকল্পনীয়।

তবে মহামারীর কবলেও মানুষ এবছরের পূজা পরিবারের সাথে কাটানোর সুযোগ পেয়েছে, ঘরে ঘরে পারিবারিক রেওয়াজগুলিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাদ যায়নি। আর সকল অন্ধকারের পর ফুটে ওঠে আলোকবর্তিকা। পরবর্তী দুর্গাপূজাগুলি আবার আগের মত উদযাপনের সেই আলোকবর্তিকার আশা নিয়েই ২০২০’র দুর্গাপূজার সমাপ্তি ঘটেছিল।


মহামারীর কবলে দুর্গাপূজা সম্পর্কে এই ছিল আমাদের উপস্থাপনা। ২০২০: অন্যরকম দুর্গাপূজা শীর্ষক প্রবন্ধে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়টিকে যথাসম্ভব সর্বাঙ্গীনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া পরীক্ষার প্রয়োজন অনুযায়ী উক্ত প্রবন্ধটিতে আমরা একটি সাধারণ শব্দসীমা বজায় রাখারও যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি।

আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে। উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন