স্বাবলম্বনের মূল্য রচনা [সঙ্গে PDF]

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে”_
অন্যের ভরসা না করে আত্মবলে বলিয়ান হয়ে ওঠার নামই হল স্বাবলম্বন। বেঁচে থাকার জন্য আমরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল ঠিকই কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সবকিছুতেই আমাদের অন্যের প্রতি নির্ভরশীল হতে হবে। স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভশীলতা হল পরিণত মানবচরিত্রের এক মহৎ গুণ। এ নিয়ে আমাদের আজকের উপস্থাপন স্বাবলম্বনের মূল্য রচনা।

স্বাবলম্বনের মূল্য রচনা

ভূমিকা:

মানুষ তার জীবনে একা বাঁচতে পারে না। কারোর না কারোর ওপর কোনো না কোনোভাবে মানুষকে নির্ভর করতেই হয়। তবে তার অর্থ এই নয় যে শুধুমাত্র পরনির্ভরশীলতাই বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। অতিরিক্ত পরনির্ভরশীলতা মানুষকে সমাজের আগাছা স্বরূপ করে তোলে। সমাজে মানুষ তার মূল্য হারায় এবং লতানো পরগাছার মত একটা গোটা জীবন কাটিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে।

অন্যদিকে স্বাবলম্বন হল দৃঢ় মানবচরিত্রের চূড়ান্ত পর্যায়। যেকোনো পরিণত মানুষ অন্য কোন কিছুর ওপর নির্ভরশীলতার সংস্রব যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে স্বাবলম্বী হতে চায়। তার মানে এই নয় যে স্বাবলম্বন-এর অর্থ অসামাজিকতা। স্বাবলম্বন-এর অর্থ হল ‘স্ব’ অর্থাৎ নিজের উপর অবলম্বন বা নির্ভরতা। অন্য কারোর উপর নির্ভর না করে আত্মবলে বলীয়ান হয়ে সমাজে দৃঢ় আত্ম চরিত্র প্রতিভাত করার নামই স্বাবলম্বন।

স্বাবলম্বনের বৈশিষ্ট্য এবং অনুশীলন:

এক দিক থেকে দেখতে গেলে স্বাবলম্বন হল সামাজিকতার চূড়ান্ত রূপ। সামাজিক স্তরের স্বাবলম্বন একটি উন্নত চরিত্রের অধিকারী মানুষদের দ্বারা গঠিত সামাজিক চিত্রকে নির্দেশ করে। তবে বলা বাহুল্য স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভরতা নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করেন। মানুষকে তার জীবনের অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে কিছু নির্দিষ্ট গুণাবলী অর্জন করতে হয়।

সেই সকল গুণাবলীর মিলিত রূপের প্রকাশই হলো স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভরতা। এই সকল গুণাবলীর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো উদ্যোগ, উদ্যম, সময়ানুবর্তিতা, আগ্রহ, নিষ্ঠা শিষ্টাচার, সততা এবং কর্তব্যপরায়ণতা। মানবচরিত্রের এই সকল গুনগুলির পরিণত মিশ্রণে মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।

প্রকৃতপক্ষে মানব চরিত্রের এই গুনগুলির বিকাশ ঘটলে পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী মানুষকে আলাদা করে কারোর উপর নির্ভর করতে হয় না। তবে এই সকল গুলিকে চরিত্রের মধ্যে আত্মস্থ করে দৈনন্দিন জীবনে তার নিয়মিত অনুশীলন প্রয়োজন। অনুশীলন ছাড়া যে মানুষ শুয়ে থাকে, তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে। 

কর্মই হাতিয়ার:

মানুষ কি দ্বারা মহান হয়? মানুষ মহান হয় তার চিন্তা এবং জীবনের কর্মে সেই চিন্তার প্রয়োগের দ্বারা। প্রতিটি মানবাত্মার অন্তস্থলেই লুকিয়ে থাকে পরম সম্ভাবনাময় স্ফুলিঙ্গ। মানুষ আপন চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা সেই স্ফুলিঙ্গকে জীবনে কর্মের যজ্ঞাগ্নি হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে।

সকল উন্নত চারিত্রিক গুণাবলির মিশেলে জীবনব্যাপী কর্ম মানুষকে অচিরেই আত্মনির্ভর করে তোলে। কর্ম ছাড়া স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভরতা অর্জন করার আর কোন বিকল্প নেই। মানুষ যখন পরম নিষ্ঠা সহকারে কোন কর্ম করে তখন সেই কর্মে সফলতা অবশ্যম্ভাবী।

আর সেই অবশ্যম্ভাবী সফলতা মানুষের পরনির্ভরশীলতা বা পরমুখাপেক্ষী মানসিকতা দূর করে। নিজের কর্মের দ্বারাই দুর্জয় সাহস এবং আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে মানুষের পরনির্ভরশীলতার মোহাবরণ ছিন্ন হয়; গড়ে ওঠে আত্মনির্ভরশীল মানসিকতার ইমারত। তাই জীবনে স্বাবলম্বন আয়ত্ত করার প্রধান হাতিয়ারই হল কর্ম।

স্বাবলম্বনে পূর্ণ বিকাশ:

স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভরতার দ্বারা মানুষের চরিত্রের প্রকৃত পূর্ণ বিকাশ ঘটে। সকল চারিত্রিক গুণাবলীকে নিজের মধ্যে একত্রিত করে মানুষ যখন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, তখন সেই মানুষের অন্তঃস্থলে এমন এক অদ্ভুত শক্তি সঞ্চারিত হয়, যে সে নিজের উদ্দেশ্য পূরণের পথে সকল বাধাকে অতিক্রম করতে পারে অনায়াসে।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম হয়তো এই আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়েই লিখেছিলেন “আমি ঝন্ঝা আমি ঘূর্ণি/ আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই তাই চূর্ণি”। এই দানবীয় আত্মশক্তি মানুষকে একদিকে যেমন বিস্মিত করে অন্যদিকে এক উন্নত জীবনের অগ্রগতিতে পাথেয় হয়ে ওঠে।

আত্মনির্ভরতার পথে প্রতিকূলতাসমূহ:

আত্মনির্ভরতা বা স্বাবলম্বনকে একটি সার্থক জীবনের চূড়ান্ত স্বরূপ বলে মনে করা হয়। তাই একথাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে সাফল্য বা সার্থকতা অর্জনের পদ সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী কণ্টকাকীর্ণ হয়। একইভাবে স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভরতা অর্জনের পথও বাধাহীন নয়।

আত্মনির্ভরতা বা স্বাবলম্বন অর্জনের নিমিত্ত যেসকল গুণাবলীর বিকাশমূলক সমাবেশ প্রয়োজন হয়, তার প্রত্যেকটি সুষ্ঠুভাবে আয়ত্ত করা অত্যন্ত কঠিন। বর্তমান যুগের ভোগবাদী জীবনে একটি আদর্শ জীবনধারা গঠনের ক্ষেত্রে মানুষকে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

কখনো সেই বাধা আসে মায়াবী লোভের বেশে; কখনো বা আসে নানা ধরনের ভয় হয়ে। কিন্তু সেই সকল লোভ কিংবা ভয় অতিক্রম করে জীবনের পরম উদ্দেশ্যটি পূরণের লক্ষ্যে ছুটে চলার নামই সার্থক স্বাবলম্বন। 

বিশ্বে মনীষীদের দৃষ্টান্ত:

আমাদের এই পৃথিবীতে যুগে যুগে আবির্ভাব ঘটেছে এমন অসংখ্য সব মনীষীদের, যারা তাদের জীবন দিয়ে সমগ্র সমাজকে আত্মনির্ভরতার শিক্ষায় শিক্ষিত করে গিয়েছেন। এ পৃথিবীর সকল মনীষীগণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে চূড়ান্তরূপে স্বাবলম্বন এর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন।

সফল আত্মনির্ভরতা ছাড়া জীবনে কোন ধরনের সাফল্যই যে অর্জন করা যায় না, তা এই সকল মনীষীরা সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ উজ্জ্বল প্রতিভার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসকল মনীষী ছাড়া পৃথিবীর সকল ধর্মগুরু মানুষকে তাদের নীতি এবং আদর্শের মাধ্যমে আত্মবলে বলীয়ান হয়ে স্বাবলম্বী হতে বলেছেন।

শিক্ষার্থী জীবন এবং স্বাবলম্বনের মূল্য:

জীবনে স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভরতা অর্জনের শ্রেষ্ঠ সময় হলো শিক্ষার্থী জীবন। ছাত্রাবস্থায় মন যখন উদ্যম ও নিষ্পাপতায় পূর্ণ থাকে তখনই এই স্বাবলম্বন-এর পাঠ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ছাত্রদের মনে আত্মনির্ভরতা মূলক শিক্ষার পাঠ বিশেষভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে হয়তো পরীক্ষার খাতায় নম্বর বেশী মেলে ঠিকই, কিন্তু এই একঘেয়ে চর্বিত চর্বনে প্রকৃত জ্ঞানের উপলব্ধি হয় না।

পুঁথিগত শিক্ষাকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে আপন প্রতিভার দ্বারা মৌলিক চিন্তার মধ্যে দিয়েই কেবলমাত্র জ্ঞানের উপলব্ধি সম্ভব। আর এই মৌলিক চিন্তার উৎপত্তি হয় অর্জিত আত্মনির্ভরতা থেকে। তাই আত্মনির্ভরতা ছাড়া শিক্ষার্থীর পূর্ণবিকাশ কোনদিন সম্ভব নয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীর মধ্যে ভবিষ্যতের অনন্ত সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা প্রতিটি শিক্ষার্থীকে নিজের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা সেই অনন্ত সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে সাহায্য করে।

সমাজ জীবনে স্বাবলম্বন:

সাবলম্বনের প্রয়োগমূলক গুরুত্ব যেখানে সবথেকে বেশি, তা হলো মানুষের সমাজজীবন। একটি সমাজে স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভরতা ছাড়া মানুষ নিয়ত চলতে থাকা ইঁদুর দৌড়ে পা মিলিয়ে চলতে পারে না। সেই কারণে বর্তমান সমাজে বাঁচার জন্য স্বাবলম্বী হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

শুনতে খারাপ লাগলেও একথা সত্য যে, কোন মানুষ যদি পরনির্ভরশীল হয়, তার সেই নির্ভরশীলতার সুযোগ নিয়ে তাকে ব্যবহার করতে অপরদিকের মানুষটি পিছুপা হয়না। আর অন্যদিকে একজন স্বাবলম্বী মানুষ নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের মহত্ব দিয়ে সমাজের হিত সাধন করতে পারে। এইভাবে একটি সমাজের সকল মানুষ যদি স্বাবলম্বী বা আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে তাহলে সেই সমাজ প্রভূত উন্নতি সাধন করবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে স্বাবলম্বনের গুরুত্ব:

জাতীয় বা আন্তর্জাতিক জনসত্ত্বা বলতে বোঝানো হয় বিশ্বব্যাপী সকল সমাজ তথা সকল মানুষ নিয়ে গঠিত জনসমষ্টির সার্বিক চরিত্রকে। সভ্যতার অগ্রগতির নিমিত্ত এই জনসত্ত্বার ক্ষেত্রে কাঙ্খিত লক্ষ্য হল সর্বব্যাপী সার্বিক উন্নতি। সর্বব্যাপী এই সার্বিক উন্নতি কেবলমাত্র সাধিত হতে পারে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং জাতীয় স্তরে আত্মনির্ভরতা বা স্বাবলম্বন অর্জনের দ্বারা।

কোন একটি জাতি তথা এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যদি স্বাবলম্বনের আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে তাহলে আর কোন কিছুই সভ্যতার ব্যাপক অগ্রগতির পথে বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়াতে পারবেনা। একটি জাতি যদি সার্বিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, সেই জাতির যে ব্যাপক মাত্রায় উন্নতি সাধিত হতে পারে তা কল্পনাতীত। সুতরাং জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে স্বাবলম্বনের গুরুত্ব যে অপরিসীম সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।

উপসংহার:

স্বাবলম্বন বা আত্মনির্ভরতা হল একটি পরিণত মানবচরিত্রের সর্বোৎকৃষ্ট গুন। এই গুণকে সার্বিকভাবে আহরণের জন্য সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে পৃথিবীর সকল সুধীজনরা জীবনব্যাপী কর্মের তপস্যায় লিপ্ত হয়েছেন। সেই তপস্যার অমোঘ ফলরূপে এসেছে তাদের আত্মনির্ভরতা।

সেই মহা মূল্যবান স্বাবলম্বনের রাস্তা ধরেই একদিন ভগবান বুদ্ধ পেয়েছিলেন পরম মুক্তির স্বাদ, মহাবীর জৈন পথ দেখিয়েছিলেন অসংখ্য দিকভ্রষ্ট মানুষকে, ভারতবর্ষের প্রাচীন মুনি-ঋষিরা রচনা করেছিলেন জীবনাদর্শের সর্বোৎকৃষ্ট নিয়মাবলী। তারা তাদের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন নিষ্ঠাবান কর্ম ছাড়া জীবনের এই মহামূল্যবান সম্পদের পরম প্রাপ্তি সম্ভব নয়।


স্বাবলম্বনের মূল্য রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান। আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম আমাদের কমেন্ট করে জানান। দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো। সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন