সর্বনাম পদ কাকে বলে? সর্বনাম পদ কয় প্রকার ও কি কি? সংজ্ঞা ও উদাহরণ সহযোগে বিস্তারিত আলোচনা। [সঙ্গে PDF]

আজ আমাদের আলোচনার বিষয় হল সর্বনাম পদ। সর্বনাম পদ কাকে বলে? সর্বনাম পদের শ্রেণীবিভাগ, প্রত্যেক প্রকার সর্বনাম পদের যথাযথ সংজ্ঞা ও একাধিক উদাহরণসহ সহজ ভাষায় নীচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

সর্বনাম পদ বৈশিষ্ট্য-চিত্র

সর্বনাম পদ কাকে বলে?

সর্বনাম শব্দের অর্থ সকল নাম। অর্থাৎ সব রকম নামের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় যে পদ, তাকে সর্বনাম পদ বলা হয়।

যেমন: মোটা মহিলা দুজন, যাদের মধ্যে একজনের নাম ছানু মাসি আর অন্যজনের নাম বেনু মাসি, তারা ড্যাবড্যাব করে শোন তোর কথা শুনছিলেন। 

উপরের বাক্যটিতে ‘যাদের’ ও ‘তারা’ এই দুটি শব্দ বিশেষ্য পদের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। এই বাক্যে ওই নির্দিষ্ট পদ দুটি সর্বনাম পদ। সুতরাং বিশেষ্য পদ এর পরিবর্তে যে পথ ব্যবহৃত হয় তাকেই বলা হয় সর্বনাম। 

দ্রষ্টব্য: এ প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত সর্বনাম পদ কেবল পদ এর পরিবর্তে বসেনা, বাক্য বা বাক্যাংশের পরিবর্তেও বসে। যেমন- ‘রাজা, ওই বালক সুকুমার নহে, ইহা অবগত হইয়া তাপসীকে জিজ্ঞাসিলেন।’ ওই বালক সুকুমার নহে এই বাক্যাংশের পরিবর্তে উপরিউক্ত বাক্যটিতে ‘ইহা’ সর্বনাম পদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সর্বনাম পদ একই শব্দের বারংবার ব্যবহারের একঘেয়েমি দূর করে ভাষাকে শ্রুতিমধুর ও প্রাণবন্ত করে তোলে। 

সর্বনাম পদের প্রকারভেদ:

সংস্কৃত সর্বনাম পদ থেকে বহু বাংলা সর্বনাম পদের উৎপত্তি হয়েছে। এইসকল সর্বনাম পদের উৎপত্তিগত উৎসের উপর ভিত্তি করে সর্বনাম পদকে বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা: ব্যক্তিবাচক সর্বনাম, সম্বন্ধ বাচক সর্বনাম, আত্মবাচক সর্বনাম, সমষ্টিবাচক সর্বনাম, প্রশ্নবোধক সর্বনাম এবং নির্দেশক সর্বনাম। এই সকল বাংলা সর্বনামের দৃষ্টান্তগুলির অধিকাংশরই উদ্ভব সংস্কৃত সর্বনাম থেকে। ব্যবহারের ক্ষেত্রে এদের সম্ভ্রমার্থক ও তুচ্ছার্থক রূপ লক্ষণীয়। 

সর্বনামের প্রকারসংস্কৃত সর্বনামবাংলা সর্বনামসম্ভ্রমার্থক সম্বোধনতুচ্ছার্থক সম্বোধন
ব্যক্তিবাচক তদ্
যুষ্মদ্
অস্মদ্
সে, তিনি, তাহা, তা, তাঁহাতুমি, তোমা, আপনি, তুইআমি, আমা, মুইতিনি, তাঁহা
তুমি, তোমা, আপনিআমি, আমা
সে, তাহা, তা
তুই
মুই
সম্বন্ধ বাচকযদ্যে, যিনি, যাহাযিনিযে, যাহা
আত্মবাচকআত্মন্আপনি, নিজ, স্বয়ংআপনি, স্বয়ংনিজ
সমষ্টিবাচকসর্বসব, সকল

বিভিন্ন প্রকার সর্বনামের সংজ্ঞা ও উদাহরণ সহকারে ব্যাখ্যা:

১) ব্যক্তিবাচক: 

সে, তাহার, তাহাকে, তিনি, তাঁহার, তাঁহাকে, তাহারা, তাহাদের, তাহাদিগকে, তাঁহারা, তুমি, তোমরা, তোমাকে, তোমার, আপনি, তুই, আপনাকে, আমি, আমাকে, আমার, আমরা, মোর, মোরা, মুই, ইত্যাদি হল ব্যক্তিবাচক সর্বনামের উদাহরণ।

প্রধানত যে সর্বনাম পদের দ্বারা ব্যক্তি বা পুরুষকে বোঝানো হয় তাকেই ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক সর্বনাম বলে।

উদাহরণ: 

  • ‘বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন। এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি সদর কেউ ছিলনা।’
  • ‘একজন বাকি টাকাটা ধার দিতে স্বীকার করিয়াছিল, কিন্তু সময়কালে সে উপস্থিত হইল না।’
  • ‘চাষিরা গরিব, তারা দিতে তো পারবেই না।’

উপরিউক্ত উদাহরণ গুলিতে বিদ্যাসাগর-এর পরিবর্তে তাঁহার, একজনের পরিবর্তে সে, চাষী-দের পরিবর্তে তারা ব্যক্তিবাচক সর্বনাম পদ বসেছে। অর্থাৎ দেখা গেল ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক বিশেষ্যর পরিবর্তে ব্যক্তিবাচক বা পুরুষ বাচক সর্বনাম বসছে।

এখন পুরুষভেদে ব্যক্তিবাচক সর্বনামকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

ক) উত্তম পুরুষের সর্বনাম: বাক্যে যেসকল সর্বনাম দ্বারা বক্তা নিজেকে বুঝিয়ে থাকেন, সেই সকল সর্বনামগুলিকে উত্তম পুরুষের সর্বনাম বলা হয়।

 যেমন:

  • সে আমার রাজলক্ষ্মী হারাইলো বনে।’ 
  • আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’
  • মম চিত্তে নিতি নিত্তে কে যে নাচে।’

বাক্যগুলিতে সে, আমার কিংবা মম- এই সর্বনাম পদ গুলির দ্বারা বক্তা নিজেকে বোঝাতে চেয়েছেন কাজেই এগুলি উত্তম পুরুষের সর্বনাম।

খ) মধ্যম পুরুষের সর্বনাম: যে সর্বনাম পদগুলি দ্বারা বাক্যে যার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে তাকে বোঝানো হয়, তাকে মধ্যম পুরুষের সর্বনাম বলা হয়। 

যেমন:

  • আপনি এখন কোথায় যাবেন।’ 
  • তোমায় একটি ভালো খেলনা দেব।’
  • তুই হলি আমার প্রিয় বন্ধু।’

উপরিউক্ত উদাহরণ গুলিতে আপনি, তোমায়, তুই এই সর্বনাম পদগুলি দ্বারা যার সঙ্গে কথা বলা হয় তাকে বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ এগুলি মধ্যম পুরুষের সর্বনাম।

গ) প্রথম পুরুষের সর্বনাম: উত্তম মধ্যম পুরুষ বাদে যা কিছু, সবই প্রথম পুরুষের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রথম পুরুষ বোঝাতে যে সর্বনাম পদ ব্যবহৃত হয় তাকে বলা হয় প্রথম পুরুষের সর্বনাম। 

যেমন:

  • সে, তাহার তাহাদের, তাহাদিগকে, উহারা ইত্যাদি।

) সম্বন্ধ বাচক বা সংযোগমূলক সর্বনাম:

দুই বা তার বেশি বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে সম্বন্ধ বা সংযোগ বোঝানো হয়, এমন সর্বনাম পদকে বলা হয় সম্বন্ধ বাচক বা সংযোগমূলক সর্বনাম। যেমন: যাহা, যাহাকে, যে, যিনি, যেটি, যেটা, যেগুলি, যেসব ইত্যাদি।

উদাহরণ:

  • এমন কোনো মা নেই, যে সন্তানকে স্নেহ করে না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কখনো কখনো একজোড়া সর্বনাম পদ পরস্পরের মধ্যে নিত্য সম্বন্ধযুক্ত হয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হয়। এরকম সর্বনামকেও সম্বন্ধ বাচক বা সংযোগমূলক সর্বনাম বলা হয়। 

প্রয়োগ:

  • “যে সহে, সে রহে।”

৩) আত্মবাচক সর্বনাম:

নিজস্ব বা আত্মভাব প্রকাশক সর্বনামকে বলা হয় আত্মবাচক সর্বনাম। এই ধরনের সর্বনাম প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন উদ্দেশ্য সাধনে কারো সাহায্য না নিয়ে নিজের ওপর পুরোপুরি জোর দেওয়া হয়। যেমন- স্বয়ং, আপনি, নিজে-নিজে, নিজে, নিজেকে, নিজেরে ইত্যাদি।

প্রয়োগ:

  • ‘রাষ্ট্রপতি স্বয়ং এই মহৎ কাজের দৃষ্টান্ত রেখেছেন।’
  • ‘রাজা আপনি চলেন শিকারে।’
  • ‘পথিক রাত্রির আশ্রয় পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলো।’

৪) নির্দেশক সর্বনাম:

কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে যে সর্বনাম পদের দ্বারা নির্দেশ করা হয়, তাকে নির্দেশক বা নির্ণয়সূচক বা উল্লেখসূচক সর্বনাম বলে। যথা: যারা, এই, ওই, ওটা, এটা, উনি, উনি, উহা, এগুলা, এগুলো, এগুলি ইত্যাদি। 

নির্দেশক সর্বনামকে দুইটি প্রকারে ভাগ করা যায়। যথা:

  • প্রত্যক্ষ নির্দেশক: নিকটস্থ কোনো ব্যক্তি বা বস্তু নির্দেশক সর্বনামকে বলা হয় প্রত্যক্ষ নির্দেশক সর্বনাম। যেমন; এই, ইহা, ইহারা, এটা, ইনি, এগুলি ইত্যাদি। প্রয়োগ- ‘ যে বড় বিস্ময়।’
  • পরোক্ষ নির্দেশক:ওই আসে, ওই অতি ভৈরব হরষে।’ ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?- ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? 

উপরিউক্ত বাক্য গুলিতে ওই সর্বনামটি দূরবর্তী বস্তু বা ব্যক্তিকে নির্দেশ করছে। অর্থাৎ, যে সর্বনাম পদের দ্বারা দূরবর্তী কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করা হয়, তাকে পরোক্ষ নির্দেশক সর্বনাম বলে।

৫) প্রশ্নবোধক সর্বনাম:

কোন কিছু জানার ইচ্ছা যে সর্বনাম পদের দ্বারা প্রকাশ করা হয়, তাকে বলে প্রশ্নবোধক সর্বনাম পদ। যেমন: কে, কাহার, কাহারা, কাহাকে, কি, কোনটা, কোনটি ইত্যাদি।

উদাহরণ:

  • কাহারা খবর দিতেছে?’

একের বেশি ব্যক্তি বা বস্তু কে পৃথক করে বোঝাতে প্রশ্নবোধক সর্বনামের দ্বিত্ব ব্যবহৃত হয়। 

উদাহরণ:

  • ‘ছেলেদের মধ্যে কে কে শ্রেণিকক্ষে হাজির ছিল?’
  • কোন কোন বই তোমার পছন্দ?’

৬) অনির্দেশক সর্বনাম:

কোন নির্দিষ্ট বস্তু, ব্যক্তি বা ভাব বোঝাতে যে সর্বনাম ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় অনির্দেশক সর্বনাম। যেমন: কেহ, কাহারো, কাহারাও ইত্যাদি।

বাক্যে প্রয়োগ:

  • “কেহ বলে, ‘আহা কি শ্রী’।”
  • কাহারো হাতে বর্ষা, কাহারো হাতে বন্দুক।’

উপরিউক্ত উদাহরণ গুলিতে কেহ এবং কাহারো সর্বনাম দুটি দ্বারা অনির্দিষ্ট বস্তু, ব্যক্তি কিংবা ভাব বোঝানো হয়েছে।

৭) ব্যবহারিক সর্বনাম:

অপরের সাহায্য ছাড়া স্বেচ্ছায় বা পারস্পরিক সম্বন্ধ বোঝাতে যে সর্বনাম ব্যবহার করা হয়, তাকে বলা হয় ব্যবহারিক বা পারস্পরিক সর্বনাম। যথা- আপনা-আপনি, নিজে-নিজে ইত্যাদি।

বাক্যে প্রয়োগ:

  • ‘ছাদের উপর থেকে বৃষ্টির জল আপনা-আপনি নিজে ঝরে পড়ছে।’

৭) সাফল্যবাচক সর্বনাম:

বস্তু, ব্যক্তি বা ভাবের সমষ্টির পরিবর্তে ব্যবহার করা সর্বনামকে বলা হয় সাফল্যবাচক সর্বনাম। যেমন: সকল, সর্ব, সবাই, সবে, সবার, উভয় ইত্যাদি।

বাক্যে প্রয়োগ:

  • ‘সবে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ।’
  • ‘দৃপ্ত শাখা মেলে দেবো সবার সম্মুখে।’

বিশেষণ ও ক্রিয়া বিশেষণ রূপে সর্বনামের প্রয়োগ:

ক) বিশেষণ রূপে প্রয়োগ: 

সে, সেই, যে, কি, কোন প্রভৃতি সর্বনাম পদের সঙ্গে বিশেষ্য পদ কিংবা বহুবচনের অর্থ বোঝাতে সব, সকল, সমস্ত- যোগ করে উল্লেখিত সর্বনাম পদগুলিকে বিশেষণ রূপে ব্যবহার করা হয়।

উদাহরণ:

  • সেই সব ঘটনা, কি সব কাজ, যে সকল লোক ইত্যাদি।

খ) বিশেষণ ও ক্রিয়া বিশেষণ রূপে প্রয়োগ:

পরিমাণ, স্থান, কাল ও সাদৃশ্য বোঝাতে সর্বনামের মূল অংশের উত্তর বিভিন্ন প্রত্যয় যোগে বিশেষণ ও ক্রিয়া বিশেষণ গঠিত হয়। 

১) পরিমাণবাচক: 

এত, যত, তত, কত প্রভৃতি। 

উদাহরণ:

  • ‘যত মত তত পথ।’
  • ‘এত বড় দেশে কত শত ভাষা।’

২) স্থান বাচক:

যেখান, যেখানে, সেখান, সেখানে, কোথায়, কোথাও, এখান, হেথা, কোথায়, যেথায় প্রভৃতি।

উদাহরণ:

  • যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়।’
  • ‘তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে করছে চাষা চাষ।’
  • ‘পদ্ম দীঘি কোথায় পাব- পদ্ম নাইকো মোটে।’

৩) কালবাচক:

এখন, তখন, তখনও, যখন, কখন, কখনো ইত্যাদি।

উদাহরণ:

  • কুঞ্জে তখনও গ্রহণ করেনি কেহই অন্নজল।’
  • এখন শুভ্র শরত্কাল।’

৪) সাদৃশ্য বাচক:

যেমন, যেমত, তেমন, এমত, কেমন, অমন ইত্যাদি। 

উদাহরণ:

  • যেমন কর্ম, তেমন ফল।’
  • ‘রঘুনাথ এমত চিন্তিয়া মনে মনে।’

সর্বনাম পদ নিয়ে এখনও কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানান। সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন