সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই ভাবসম্প্রসারণ

মানুষের কথা বলা কিংবা লেখালেখির উদ্দেশ্যই হলো মনের অন্তস্থিত ভাবের প্রকাশ করা। মনের ভাব প্রকাশ করার উদ্দেশ্যেই মানুষ ভাষার অবতারণা করে। সে কারণেই কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে স্থানভেদে ভাষা পৃথক হলেও, ভাবের তেমনপরিবর্তন ঘটে না। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাষা প্রয়োগের সময় আমরা বিভিন্ন অলংকার, উপমা, অন্তমিল শব্দবন্ধ ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে থাকি।

যে কোন ভাষা ব্যাকরণের এইসকল অনুঘটকগুলি ভাষার সৌন্দর্য এবং দৃঢ়তা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে থাকে। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এইভাবে অপূর্ব শব্দচয়ন দ্বারা কোন একটি কঠিন কিংবা জটিল বিষয় কে অতি সহজেই সরল ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া যায়। সীমিত সেই সকল শব্দবন্ধ দ্বারা গঠিত বাক্যাংশের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ব্যাপকধর্মী ভাবের ব্যঞ্জনা। সেই সকল বাক্যাংশস্থিত শব্দাবলীর জট ছাড়িয়ে তার মূলভাবকে সম্প্রসারিত করা বা তুলে ধরার নামই হলো ভাব সম্প্রসারণ।

ভাব সম্প্রসারণ বাংলা ভাষা বিজ্ঞানের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভাব সম্প্রসারণ সম্বন্ধিত সার্থক জ্ঞান ছাড়া বাংলা ভাষা, বিশেষ করে সাহিত্য শিক্ষা সম্পূর্ণ হতে পারে না। তবে ভাব সম্প্রসারণ বিষয়ে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেই কিছু বিভ্রান্তি এবং যথাযথ উৎসাহের অভাব লক্ষ্য করা যায়। সেই সকল বিভ্রান্তি এবং অনীহা দূরীকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে, আজ বাংলা ভাষার তেমনি একটি সুপ্রচলিত বাক্যাংশ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ -এর ভাব সম্প্রসারণ এর নিমিত্ত আমরা এই প্রতিবেদনটির উপস্থাপনা করতে চলেছি।

ভাবসম্প্রসারণ-১

বাংলা সংস্কৃতির এই অতীব জনপ্রিয় ভাবটির স্রষ্টা হলেন মধ্যযুগের বাঙালি কবি বড়ু চন্ডীদাস। সমগ্র বিশ্বসমাজের অবিরাম অস্থিরতার প্রাক্কালে বড়ু চন্ডীদাসের সৃষ্ট এই বাণীটি মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী হিসেবে পরিচিত। এই বাণীটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সৃষ্টির দুটি অন্যতম উপাদানের দ্যোতনা: মানুষ এবং সত্য। একটি জৈবিক, অন্যটি দৈবিক। সৃষ্টির আদি লগ্নে মানুষ যখন প্রথম পৃথিবীর আলো দেখলো, তখন তার কাছে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। তারপর সময়ের বিবর্তনে মানুষ গড়ে তুলল উন্নত সভ্যতা, উন্নতির সাথে সাথে মানুষ হাতে পেল অফুরান সময় আর সুযোগ।

মানুষের বাসনা হল প্রতিমুহূর্তে নিজেদেরকেই বারবার অতিক্রম করে যাওয়ার। সেই বাসনা থেকে মানুষ নিজেকে করে তুলল নিজেরই প্রতিপক্ষ। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই আত্মবিরোধিতা থেকেই জন্ম নিল বৈষম্য, ভেদাভেদ, হিংসা ও হানাহানি। সময়ের সাথে সাথে সমাজের এই সকল বিভেদকামী শক্তিগুলি আরো দৃঢ় হয়েছে। মানুষের চরিত্রের সাধারণ গুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিযোগী মানসিকতা ও অবিশ্বাস।

প্রতিমুহূর্তে মানুষ ব্যস্ত নিজেকে অন্যের থেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে। তার কাছে আজ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ধনসম্পত্তি, জাতপাত, লিঙ্গ, ধর্ম ইত্যাদি অতি তুচ্ছ বাহ্যিক বিষয়গুলি। এগুলির ভিত্তিতে প্রতিনিয়ত মানুষ বুনে চলেছে বিভেদের বীজ। কিন্তু এই সুবিশাল সৃষ্টির বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখতে গেলে মানুষ অতি তুচ্ছ এক জীব, যারা অন্যদের মতোই জীবনধারণের জন্য প্রতিমুহূর্তে সংগ্রাম করে চলেছে।

সেই সংগ্রামের পথে পড়ে রয়েছে অসংখ্য বাধা ও বিপদ। কিন্তু মানুষ নিজের ব্যাপকতার স্বার্থরক্ষার কথা ভুলে মেতে রয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায়। কিন্তু জীবনের শেষে এই সকল প্রতিযোগিতাই পর্যবসিত হয় সৃষ্টির মহাশক্তির সাথে আত্মশক্তির মিলনে। তাই কবিতার এই উক্তিটির মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন সকল প্রকার বিভেদ, হিংসা ও হানাহানির ঊর্ধ্বে উঠে একমাত্র সত্য বলে যদি কিছু থাকে তাহলো কেবলমাত্র মানুষ; মানুষের ঊর্ধ্বে আর বড় সত্য কিছু নেই।


ভাবসম্প্রসারণ-২

এই মহা সৃষ্টি হল অনন্ত শক্তির অপার ভান্ডার। আমরা সেই শক্তির ভান্ডার থেকেই কণামাত্র শক্তি আহরণ করে জীবন ধারণ করে থাকি। জীবনের শেষে আমাদের এই মর্মর দেহ থেকে সেই কণামাত্র শক্তি নিঃসরিত হয়ে মহাশক্তির সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়। তাই মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিজেরে এই কণামাত্র শক্তির সাহায্যে মহাশক্তির উপলব্ধির প্রচেষ্টা করা। প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য এই প্রচেষ্টাকে অভিহিত করা হয়েছে ধর্ম বলে এবং তার বিপরীতে সকল কিছুই অধর্মের নামান্তর। ভারতীয় ঐতিহ্য মতে এই ধর্মই হলো সত্য, আর যা সত্য তাইই শাশ্বত ও সুন্দর।

এই ধর্ম জীবন্ত হয়ে ওঠে মানুষের মধ্যে থাকা অবিনশ্বর কণামাত্র শক্তির মাধ্যমেই। তাই ধর্ম যদি সত্য হয় তাহলে মানুষও সত্য। কিংবা পক্ষান্তরে বলা যায় কেবলমাত্র মানুষই সত্য, বাকি সকল কিছু মিথ্যা, বা মায়া। আধুনিক যুগে মানুষের জীবনচর্যার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হলেও জীবনের এই প্রাথমিক চরিত্রে কোন পরিবর্তন ঘটতে পারে না: বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতে কখনোই নয়। তাই জীবনে মানুষ নিজের উন্নত বুদ্ধিমত্তা দ্বারা যা কিছুই আহরণ করুক না কেন, মানুষের জীবনের সার্থকতা সৃষ্টির অনন্ত শক্তির উপলব্ধিতেই।

কিন্তু আজ মানুষ নিজের জীবনের সার্থক উদ্দেশ্য থেকে বিস্মৃত হয়েছে বাহ্যিক উদযাপনের আড়ম্বরে। যেখানে সৃষ্টির এই মহাশক্তির কাছে সকল কিছুই তুচ্ছ হয়ে যায়, সেখানে মূর্খ মানুষের কাছে প্রধান হয়ে দাঁড়ায় ধনসম্পত্তি, জাতপাত, লিঙ্গ, উঁচু-নিচু ইত্যাদির বিভেদ। এ প্রসঙ্গে মানুষের মনে রাখা দরকার সৃষ্টির এই কালসমুদ্রে কোন কিছুই স্থায়ী নয়, স্থায়ী হলো কেবলমাত্র মানুষ এবং অনন্ত ধর্ম। তাই মানুষের সেই সব কিছুকে পরিত্যাগ করা দরকার যা সৃষ্টির অনন্ত সত্য থেকে তাকে দূরে নিয়ে যায়। পক্ষান্তরে ধারণ করা দরকার সেই সত্যকে, যা মহাসত্যের উপলব্ধির পথে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তবেই সমাজ হয়ে উঠবে সত্যের বাহক, শাশ্বত ও সুন্দর।


“সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”– কবি বড়ু চন্ডীদাসের  উক্তিটি সম্বন্ধে এই ছিল আমাদের উপস্থাপিত ভাব সম্প্রসারণ। আলোচ্য উপরিউক্ত ভাব-সম্প্রসারণ দুটিতে আমরা দুটি সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে উক্তিটির ভাব সম্প্রসারণ এর চেষ্টা করেছি। আশা করি আমাদের এই উপস্থাপনা আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রদত্ত উক্তিটি সম্বন্ধে এই ভাবসম্প্রসারণ দুটি আপনাদের সকল কৌতুহল নিরসন করতে সক্ষম হবে।

আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন