শ্রমের মর্যাদা রচনা [With PDF]

আমাদের প্রত্যেকের এক মধ্যে বর্তমান আশ্চর্য নিহিত শক্তি হল শ্রম। সকল সাফল্য অর্জন করা সম্ভব শ্রমের বিনিময়ে। আমরা আমাদের চারিদিকে যা কিছু দেখি তার পেছনে রয়েছে কোনো না কোনো মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম। জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে সঠিক সময় ও শ্রমের মর্যাদা করা অত্যাবশ্যক। এ নিয়েই আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় শ্রমের মর্যাদা রচনা।

শ্রমের মর্যাদা রচনা

ভূমিকা:

আজ থেকে দেড়শ বছরেরও বেশি সময় আগে বিবর্তনবাদের প্রবক্তা চার্লস ডারউইন ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন। তার এই তত্ত্ব একান্তভাবেই প্রকৃতির বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মের ক্ষেত্রে লাগু হলেও মানব সভ্যতার উত্থান-পতনের ইতিহাসও এই তত্ত্বের নিয়ম অনুসারেই আবর্তন করে।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে যত বেশি যোগ্য তার মর্যাদাও ততটাই বেশি।  সভ্যতার নিয়মে এই যোগ্যতা নির্ধারিত হয় শ্রমের মাপকাঠি দ্বারা। বেঁচে থাকার জীবন যুদ্ধে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প হয়না। কথায় বলে ‘যে সয় সেই রয়’। সেই রওয়া বা টিকে থাকা তথা জীবনের সাফল্য এবং উন্নতির প্রধান চাবিকাঠিই হল শ্রম। 

শ্রম- পৃথিবীর প্রধান চালিকাশক্তি:

ব্যক্তিগত জীবন হোক কিংবা সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাস: শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম সর্বত্রই। বর্তমান মানবসভ্যতার বিকাশের এই বহুমুখী ব্যাপকতার মূলে রয়েছে যুগ যুগান্তরের লক্ষ কোটি মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম। যুগে যুগে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে পৃথিবী জুড়ে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত পরিশ্রমই সার্বিক রূপে এই সমগ্র পৃথিবীর চালিকা শক্তি রূপে সমাজের চাকাকে সচল রাখে। এবং এই নিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজ পরিশ্রমের চাকায় ভর করে সভ্যতা কে এগিয়ে নিয়ে যায়। গড়ে ওঠে ইতিহাস।

জন্মের পর থেকে ব্যবহৃত সব কিছু, দৃশ্যমান বাড়ি ঘর, রাস্তাঘাট,খাদ্য, পোশাক সবকিছুই অর্জিত হয় শ্রমের বিনিময়ে। শ্রম ব্যতীত এই পৃথিবীতে সকলি গরল ভেল। কোন সমাজ তথা সভ্যতার ভবিষ্যতের রুপ কেমন হবে তা নির্ভর করে বর্তমানে সেই সমাজের মানুষের প্রদত্ত শ্রমের ওপর।

কোন সমাজের মানুষ যদি পরিশ্রমী না হয়, তাহলে কোন দিনই সেই সমাজের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে না। কথায় বলে ‘মানুষ নিজের ভাগ্য নিজে তৈরি করে’। সেই ভাগ্য তৈরীর প্রধান কারিগরই হলো শ্রম। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে শ্রমই হল আমাদের সৌভাগ্যের জননী – “Industry is the mother of good luck”।

শ্রমের প্রকারভেদ:

শ্রম প্রধানত দুই ধরনের।

১) শারীরিক শ্রম
২) মানসিক শ্রম

বেঁচে থাকার জীবন যুদ্ধে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় এই দুধরনের শ্রমই অপরিহার্য। গায়ে গতরে খাটনি করে কাজ করা হল শারীরিক শ্রম। এই ধরনের শ্রমের মাধ্যমে মানুষ তার শারীরিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কর্ম সম্পাদন করে। কমবেশি প্রত্যেকটি মানুষকেই জীবনে শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়।

আর অন্যদিকে মাথার বুদ্ধি খাটিয়ে কর্ম সম্পাদনের নাম হল মানসিক শ্রম। আদিম যুগে মানুষ যখন জঙ্গলে, গুহায় বসবাস করতো তখন প্রধানত শারীরিক শ্রমের উপর নির্ভর করে মিটতো মানুষের সাধারণ জৈবিক চাহিদা। তবে একথাও সত্য যে শারীরিক শ্রমের পাশাপাশি গুহাবাসী মানুষকেও তার প্রতিদিনের জীবন ও জীবিকা নির্বাহে মানসিক শ্রম এর প্রয়োগও করতে হতো।

যদিও তখন অন্যান্য সব বন্য প্রাণীর মতো আত্মরক্ষা আর খাদ্য সংগ্রহ করাই ছিল মানুষের প্রধান কাজ। এজন্যই সেসময় মানুষের কাছে শারীরিক শ্রমের গুরুত্ব ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে কালের বিবর্তনে মানুষ নিজের জীবনে এনেছে যান্ত্রিক পরিবর্তন, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে উন্নতির পথে।

সভ্যতার এই অগ্রগতির পথে মানুষের কাছে ধীরে ধীরে শারীরিক শ্রমের তুলনায় মানসিক শ্রমই হয়ে উঠল প্রধান। দর্শন, সাহিত্য, শিল্প, জ্ঞান বিজ্ঞান তথা প্রযুক্তিতে মানসিক শ্রমের বিশেষ প্রয়োগে মানুষ একের পর এক নজির স্থাপন করতে থাকলো। যদিও তাতে কখনই শারীরিক শ্রমের গুরুত্ব কমে যায়নি। আজও মানুষকে নিজের জীবনে বেঁচে থাকার সবচেয়ে প্রাথমিক উপাদান অর্জনে শারীরিক শ্রমেরই সাহায্য নিতে হয়।

শ্রমের গুরুত্ব:

সেই আদিম কাল থেকে আজ আধুনিক সভ্যতার এই চরম বিকাশের মুলে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম। প্রতিটি যুগে একটু একটু করে সভ্যতাকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে মানুষ। দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান যাই হোক না কেন, আজকের এই উন্নতি কোনো একদিনে অর্জিত হয়নি।

সভ্যতার আবর্তনের প্রতিটি পর্যায়ে মানুষের সফলতা ব্যর্থ পরিশ্রমের হল আজকের এই উন্নতি। মানব সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে আজ অবধি প্রত্যেক স্তরে রয়েছে শ্রমের অবদান। কারন আমরা জানি সমাজ তথা সভ্যতা কোন দুর্বল অলস ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানসিক তথা শারীরিক উভয় ধরনের শ্রমই এই ভিত্তিকে মজবুত করতে সাহায্য করেছে।

বিশাল এই পৃথিবীতে মানুষ প্রতিনিয়ত শ্রম দান করে চলেছে। এই শ্রমই হল মানুষের ভাগ্যের প্রধান নিয়ন্তা। নিয়ত পরিশ্রমের মাধ্যমেই মানুষ তার নিজের ভাগ্যকে গড়ে তোলে; ভবিষ্যতকে করে সুরক্ষিত। তাছাড়া নিরন্তর শ্রমের মধ্যে দিয়েই বিকশিত হয় মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভা। সমগ্র সমাজের মানুষের এই সমূহ প্রতিভাময় সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই সমাজ তথা সভ্যতা ও উন্নতির পথে এগিয়ে যায়। সেজন্যেই মানব সভ্যতা আজ এতো উন্নত।

শ্রমের মর্যাদায় সাম্য:

সমাজে সব ধরনের শ্রমের সমান গুরুত্ব থাকা আবশ্যক। আমাদের চারপাশে বিভিন্ন বৃত্তির মানুষ বিভিন্ন কাজে রত। প্রত্যেকটি মানুষই নিজের জীবিকা নির্বাহ হেতু জীবনে শ্রমের প্রয়োগ করে চলেছেন। সেই শ্রম শারীরিক বা মানসিক উভয় ধরনের হতে পারে। কেউ চাষ করে খাদ্যের জোগান দেন, কেউ নির্মাণ করেন বসবাসের বাড়ি, রাস্তাঘাট, কেউ চিকিৎসা করে জীবনদান করেন, কেউ পরিবহনের জন্য গাড়ি চালান, ইত্যাদি।

এই সকল প্রকারের শ্রমই সমাজকে সচল রাখার জন্য আবশ্যক। এবং এর কোন একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি পূর্ণমাত্রায় ফলপ্রসূ হতে পারে না। জীবনযুদ্ধে আমরা প্রত্যেকেই এক একজন শ্রমিক ভিন্ন অন্য কিছু নই। সেজন্য প্রত্যেক শ্রমিককেই আমাদের সমান গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতে শিখতে হবে। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে দৈনন্দিন জীবনে সকল প্রকারের শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম।

শ্রম বিমুখতা:

আলস্য আনে দারিদ্রতা,
পাপে আনে দুঃখ।
পরিশ্রমে ধন আনে,
পুণ্যে আনে সুখ।”

উপরের এই লাইনগুলি হয়তো জীবন দর্শনের সবচেয়ে বড় সত্য আপ্তবাক্য। এই আপ্তবাক্যের অনুধাবন করতে কেউ যদি ব্যর্থ হয় তার সম্পূর্ণ জীবন জুড়ে ব্যর্থতার গ্লানি অবশ্যম্ভাবী। শ্রমের মূল্য ও মর্যাদা বুঝতে শিখেও এমন কিছু অপরিণামদর্শী মানুষ রয়েছে যারা অলস, শ্রম বিমুখ, অদৃষ্টবাদী।

এই অলসতাই তাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ব্যর্থতাকে ডেকে আনে। এবং মানুষের এই ব্যক্তিগত ব্যর্থতা সমাজের ক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রতিকূলতা রূপে দেখা দেয়। কোন মানুষের ব্যক্তিগত সাফল্য যেমন সমগ্র সমাজের অগ্রগতির সূচক হিসেবে কাজ করে, ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত ব্যর্থতাও সমাজের দুর্গতির সূচক। তাই অলস শ্রমবিমুখ মানুষ শুধুমাত্র তার নিজের জীবনই নয় এমনকি সমাজের পক্ষে ও অভিশাপ।

পরিশ্রম এবং সাফল্য পরস্পর সমানুপাতিক সম্পর্কে কাজ করে। শিকার যেমন শিকারির কাছে নিজে থেকে আসেনা ঠিক সেভাবেই পরিশ্রম ছাড়া কখনও সাফল্য অর্জন করা যায়না। পরিশ্রম ব্যতীত সাফল্যের কল্পনাও অলসতার পরিচায়ক। তাই সমাজের প্রতি তথা নিজেদের প্রতি এই নির্মম প্রবনতার পরিচয় যেন আমরা কখনো না দেই সেই বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকতে হবে।

আমাদের সকলকে একথা মনে রাখতে হবে যে অদৃষ্ট কারো হাতে কোন অমূল্য সম্পদ তুলে দেয় না। সম্পদ হোক বা সাফল্য তা কখনও নিজের থেকে এসে উপস্থিত হয়না। অদম্য ইচ্ছা, নিরলস পরিশ্রম আর সংগ্রামের মাধ্যমে তাকে অর্জন করতে হয়। কথিত আছে কোন কর্ম করলে তার ফলের ভোগ আবশ্যক। তেমনভাবেই পরিশ্রমও ফলরূপে সাফল্যকে নিজে থেকেই ডেকে আনে। 

এই ধরিত্রীর বুকে চলমান সভ্যতার পথে কর্ম শক্তিকে হাতিয়ার করে যতক্ষণ পা চলবে, ততক্ষণ প্রতি পদক্ষেপে ফুটবে ফুল। আর তা নাহলে ভাগ্যকে দোষারোপ করে দুঃখে কষ্টেই দিন যাপন করতে হবে। কারণ অলস ব্যক্তি সর্বদাই নিজের নিজের ব্যর্থতাকে আড়াল করবার জন্য ভাগ্যের প্রতিকূলতা তত্ত্বের অবতারণা করে। কিন্তু পরিশ্রমই যে ভাগ্যের সর্বোচ্চ নিয়ামক, এই অমোঘ সত্য সেই শ্রমবিমুখ মানুষের কাছে অধরা থেকে যায়।

উপসংহার:

শ্রম সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন, তা বিশ্বসংসারে এর গুরুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট নয়। তাই মানব জীবনে ব্যক্তিগত শ্রমের গুরুত্ব সম্পর্কিত আলোচনাই তুলনামূলকভাবে সহজতর। শ্রম আমাদের ভেতরকার সুপ্ত প্রতিভা ও সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। সেই সম্ভাবনাকে সম্বল করেই মানুষ সভ্যতা তথা সমাজকে কাঁধে নিয়ে যুগের বৈতরণী পার হয়।

মানব সভ্যতা হোক কিংবা বিজ্ঞান প্রযুক্তি, অথবা শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতিই, সবই হলো নিরলস শ্রমজাত। অক্লান্ত শ্রম তথা সুদীর্ঘ অধ্যবসায় মানুষকে সভ্যতার ফসল রূপে উন্নতি উপহার দেয়। সেজন্য কর্মবীর মানুষই জীবনে চূড়ান্ত সাফল্যের অধিকারী হয়। সর্বোপরি যুগে যুগে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কর্মবীরতাই আজ মানুষকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব রূপে বরণ করে নিয়েছে। 

দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতার দ্বারা মানুষ সার্বিক রূপে উপলব্ধি করেছে শ্রমের মূল্য ও মর্যাদা। এই মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে ভাগ্য লক্ষ্মীকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে মানুষ মানবসভ্যতা আজ সার্থক রূপ লাভ করেছে।


শ্রমের মর্যাদা রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার।
এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন:

সময়ের মূল্য রচনা
Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন