শৈশবে ফেলে আসা দিনগুলি বা শৈশব স্মৃতি রচনা [PDF]

ছোটবেলার দিন গুলোর কথা মনে করলে আমরা এক পরম সুখ অনুভব করি ও তৃপ্তি পাই।কারণ আমাদের জীবনের একটা রঙিন অধ্যায় শৈশব।আমাদের সকলেরই খুব ইচ্ছে করে শৈশবের ফেলে আসা দিন গুলি ফিরে পেতে। এ নিয়ে আজকের বিষয় শৈশবে ফেলে আসা দিনগুলি বা শৈশব স্মৃতি রচনা।

শৈশব স্মৃতি রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

মানুষের জীবনের সবচেয়ে মধুর সময় যেটি, নিঃসন্দেহে তা হল আমাদের শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলি। শৈশবকালে যখন আমরা ছোট থাকি তখন মনে করি বড় হলে না জানি কতই সুখ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। কিন্তু একবার যখন বড় হই, তখন আমরা সকলে প্রতিমুহূর্তে বারবার ফিরে যেতে চাই আমাদের সেই শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলিতে।

ফিরে পেতে চাই ছেলেবেলার সেই সারল্য আর মাধুর্য করে দিনযাপনের কালকে। শৈশবকালে মাথায় চেপে বসে থাকে না কোনো চিন্তাভাবনা; শুধুমাত্র খুশি আনন্দ আর হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে সমগ্র ছোটবেলা কখন অতিবাহিত হয়ে কৈশোর পেরিয়ে আমরা যৌবনে প্রবেশ করি তা বুঝতেও পারিনা। বুঝতে যখন পারি তখন সেই সারল্য মাখা দিন গুলো হারিয়ে গেছে মহাকালের গভীরে। এরপর সারা জীবন কাটে মাথার ওপর চেপে বসে নানা দুশ্চিন্তায়, আর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণায়।

ছেলেবেলার রোজনামচা:

আমার কাছে এখনকার দিনের থেকে ছেলেবেলার রোজনামচা অনেক বেশি বর্ণময় ছিল। তখন আমি মা-বাবার মাঝখানে শুয়ে ঘুমাতাম। খুব সকালে স্কুল থাকত বলে মা আমায় ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলে দিত। তারপর স্নান খাওয়া সেরে বই পত্র গুছিয়ে নিয়ে আমি স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হতাম। এরপর স্কুল থেকে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন প্রায় দুপুর হয়ে যেত।

বাড়ি ফিরে আবার মায়ের হাতে খাওয়া-দাওয়া করে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ব্যাট বল হাতে করে পৌঁছে যেতাম খেলার মাঠে। সারা বিকালটা কাটতেও খেলার মাঠে হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে। সন্ধ্যেবেলা যখন বাড়ির অঙ্গন থেকে শঙ্খ ধ্বনি শুনতে পেতাম, তখন খেলার মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে বইপত্র নিয়ে বুঝতাম বাড়ির পড়া করতে।

মা তখন প্রতিদিন আমায় পড়াশোনায় সাহায্য করত। রাত নটায় পড়াশোনা শেষ করে বাবার পাশে বসে টিভি দেখতে দেখতে রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতাম। এরপর আবার মা-বাবার মাঝখানে পরম আশ্রয় শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম।

সকাল-বিকেল মাঠে গিয়ে হুল্লোড়:

এখন দেখি আজকালকার শিশুরা খেলাধুলার প্রতি তুলনামূলকভাবে অনাগ্রহী হয়ে পড়ছে। তবে আমাদের ছেলেবেলায় প্রত্যেকদিন স্কুল থেকে ফিরে বিকালে, ছুটির দিনে সকালে বিকালে দুবেলাই আমরা খেলার মাঠে হৈ-হুল্লোড় করতাম দল বেঁধে। মাঠে গিয়ে সে কত রকম খেলা ছিল আমাদের। কখনো গুলি ডান্ডা, কখনো ক্রিকেট, আর বর্ষাকালে ফুটবল।

বর্ষাকালে মাঠভরা কাদার মধ্যে দাপাদাপি করে ফুটবল খেলার আনন্দ ইহজীবনে কোনদিন ভুলবার নয়। নিজেদের খেলার মত করে আমরা সবাই নিজেদের নিয়ম বানিয়ে নিতাম। পৃথিবীর প্রচলিত চিরাচরিত নিয়ম তখন আমাদের খেলায় খাটে না। যে নিয়মে প্রতিদিন সকালে বিকালে মাঠের মধ্যে পরম আনন্দের পরিবেশ রচিত হয় তা একান্তই আমাদের।

শৈশবে উৎসবের দিনগুলি:

শৈশবকালে আমাদের সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল বছরের উৎসবের দিন গুলি। সেই উৎসবের দিনগুলিকে উপলক্ষ করে আমাদের গায়ে উঠত নতুন নতুন জামা প্যান্ট। মা-বাবার সাথে হইহই করে জামা কাপড় কিনতে যেতাম। এ প্রসঙ্গে ছেলেবেলায় কাটানো দুর্গাপূজার কথা খুব মনে পড়ে। প্রতিবছর ছেলেবেলা দুর্গা পুজোর দিনে আমরা সপরিবারে যেতাম গ্রামের বাড়িতে। সেইখানে বাড়ির পুজো সকল ভাই বোনদের সাথে একসাথে হয়ে পুজো কাটানোর যে আনন্দ, তা কখনো ভোলার নয়।

পুজোর দিন গুলো আমাদের কাটতো বাড়ির মন্ডপ ঠাকুরের কাজ করে, আর হয়তো মাঠে কিংবা নদীর ধারে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে। এছাড়া স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে ছেলেবেলার নববর্ষের দিনগুলির কথা। প্রতিবছর নববর্ষের দিনে নতুন জামা কাপড় পড়ে বাবা মার সাথে হাত ধরে আমরা নানা পরিচিত দোকানের হালখাতা করতে যেতাম। সকল দোকানদার কাকু আমায় ভালোবেসে নিজের হাতে মিষ্টি খাইয়ে দিতেন। সেই হুল্লোড় আর নিখাদ আনন্দের দিনগুলি আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।

আমার শৈশবের বিদ্যালয়:

আমার ছেলেবেলায় সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল সম্ভবত তা হল আমার বিদ্যালয়। আসলে বিদ্যালয়ের এত বন্ধু বান্ধব, বন্ধুসম শিক্ষক, বড় খোলা মাঠ আর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আমি খুঁজে পেতাম আমার পূর্ণ স্বাধীনতার পরিবেশ। এখানে যেন আমায় বাধা দেওয়া কিংবা বারণ করার কেউ নেই। আমি এখানে মুক্ত বিহঙ্গ, যে নিজের ডানা মেলে অবাধে ভেসে চলে শান্তিময় স্বাধীনতার নিরাপদ পরিসরে।

প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। মনে আছে বর্ষাকালে কোন দিন খুব বৃষ্টি হলেও বিদ্যালয় আমি কামাই করতাম না। বিদ্যালয়ে পৌঁছে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলাধুলা, শিক্ষকদের কাছে অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে কোন বিষয় বুঝে নেওয়া, আর ছোটখাটো দুষ্টুমিতে শিক্ষকদের বকা ভোলার নয় কোনদিন। 

ছেলেবেলায় মা বাবার শাসন:

ছেলেবেলার দিনগুলিতে আমাদের সবচেয়ে অপছন্দ যে বিষয়টি হয়, নিঃসন্দেহে তা হল সবকিছুতে মা বাবার শাসন। এটা করবে না, এখানে যাবে না, সেটা খাবে না, ওখানে হাত দেবেনা- এই প্রকার শাসন বাক্যগুলি ছেলেবেলায় মা বাবার কাছ থেকে শোনেনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। ছেলেবেলার দিনগুলিতে মনে হয় কখন বড় হব, আর রেহাই পাব মা-বাবার এই সকল শাসন বাক্য থেকে।

কিন্তু বড় হবার পর বুঝতে পারি, প্রকৃতপক্ষে এই সকল শাসন বাক্য ছিল আমাদের প্রতি মা-বাবার অগাধ ভালবাসার অস্ফুট প্রকাশ। তখন মনে হয় কেন আর সেই আগের মতো করে মা-বাবা আমাদের শাসন করে না! কেন আর বিধি-নিষেধ আরোপ করে না আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্যার বিশৃঙ্খলায়!

আমার পাড়ার বন্ধুরা:

আমার কাছে ছেলেবেলায় আমার সকল বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল আমার পাড়ার বন্ধুরা। বিদ্যালয়ের দিনে বিকেল বেলায়, আর ছুটির দিনে সকাল বিকেল দুবেলাই আমি আমার পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলতে যেতাম। মাঠে-ঘাটে কিংবা পাড়ার রাস্তায় আমাদের সেই খেলার মধ্যে না ছিল কোন লিঙ্গ বৈষম্য, না ছিল কোন ভেদাভেদ।

ছেলেবেলায় আমাদের পাড়ার বান্ধবীদের সাথে একসাথে মিলে আমরা যেমন রান্নাবাটি খেলতাম, খেলতাম লুকোচুরি, কুমিরডাঙ্গা; তেমনি সেই সকল বান্ধবীরাও আমাদের সাথে কদাচিৎ ক্রিকেট কিংবা ব্যাডমিন্টন খেলায় অংশগ্রহণ করত। কতবার বিকেলে খেলতে গিয়ে হাতে পায়ে চোট পেয়েছি, আর পাড়ার বন্ধুরা ধরে ধরে বাড়িতে এনে পৌঁছে দিয়ে গেছে তার হিসেব নেই। 

একটি স্মরণীয় ঘটনা:

ছেলেবেলায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা আজও স্পষ্ট আমার মনে রয়েছে। সেদিন ছিল শীতকাল; কোন একটি ছুটির দিন। তবে আমি রোজকার মতন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসেছি। হঠাৎ মনে হল আমার চেয়ার এবং টেবিল যেন নড়ে উঠলো। আমাদের বাড়ি দোতালায় হওয়ায় মা রান্না ঘর থেকে দৌড়ে এসে আমায় নিয়ে নিচে নেমে গেলেন।

বাড়ির সামনে পুকুরের ধারে পৌঁছে দেখতে পেলাম পুকুরের জল পুকুরপাড় ছাপিয়ে রাস্তায় এসে পড়ছে। আর আশেপাশের বাড়িগুলোকে মাঝেমধ্যেই দেখলাম কেমন একটা ভাবে নড়ে উঠতে। মা বললেন, একে ভূমিকম্প বলা হয়। পরে জানতে পেরেছিলাম ওই ভূমিকম্প আসলে ২০০৪ সালে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর সুনামির আঞ্চলিক রূপ।

বাবার পাশে বসে সেই দিন রাতে টিভির পর্দায় দেখেছিলাম সুনামি বিধ্বস্ত এলাকার মানুষের দুর্দশার চিত্র। সেই দিনের পর প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে আমার মনে অত্যন্ত ভয় ঢুকে গিয়েছিল।

আমার শৈশবের স্বপ্ন:

প্রতিটি ছেলে মেয়ের মতন আমার জীবনেও শৈশবের কিছু নির্দিষ্ট স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নগুলি বাস্তব জীবনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূরণ না হলেও শৈশবকালের স্মৃতিপটে এই সকল স্বপ্ন শৈশবের অমর অংশ হয়ে থেকে যায়। আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। আমার শৈশবে অদম্য ইচ্ছা ছিল আমি একজন ডাক্তার হব।

ডাক্তার হয়ে দুস্থ মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করব। কিন্তু এই মহাকাল বড়ই বর্ণময়। সে মানুষের জীবনকে কোন পথে চালনা করে নিয়ে যায় তা মানুষ বুঝতেও পারেনা। হয়তো এই কারণেই যে আমি একদিন একজন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চাইতাম, সেই আমিই একজন বিজ্ঞানী হিসেবে বড় হতে চাই। মানুষ বদলে যায়, স্বপ্ন পাল্টে যায়, শৈশবও চিরস্থায়ী হয় না: শুধুমাত্র স্মৃতি অমর হয়ে থাকে।

উপসংহার:

আমাদের শৈশবের ফেলে আসা দিন গুলি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন কখনোই যথেষ্ট হতে পারে না। তবে এই ক্ষুদ্র পরিসরেও আমি চেষ্টা করেছি আমার শৈশবের মূল দিকগুলির সার্থক স্মৃতিচারণার। এই স্মৃতিচারণায় যে কি সুখ আছে, তা প্রতিমুহূর্তে শৈশবের অতীতকালের দিনগুলিকে হাতড়ে দেখার সময় অনুভব করছিলাম।

পৃথিবী বহুমুখী হতে পারে, মানুষের জীবন বর্ণময় হতে পারে: কিন্তু একজন মানুষের কাছে তার শৈশবের থেকে প্রিয় পৃথিবীর অন্য কিছুই হতে পারে না। শৈশবের সেই অনাবিল সারল্যকে নিখাদ স্মৃতিচারণার মাধ্যমে নিজেদের অন্তরে বাঁচিয়ে রাখার মধ্যেই হয়তো জীবনের প্রকৃত সার্থকতা লুকিয়ে আছে।


শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলি বা শৈশব স্মৃতি প্রবন্ধ রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার।

এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

“শৈশবে ফেলে আসা দিনগুলি বা শৈশব স্মৃতি রচনা [PDF]”-এ 1-টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন