শিষ্টাচার হল সভ্য মানুষের চরিত্রের প্রাথমিক গুন স্বরূপ। শিষ্টাচার ছাড়া সামাজিক ব্যবস্থা অরাজকতারই নামান্তর হয়ে ওঠে। সেই দিক থেকে শিষ্টাচার সমাজের একটি কাঙ্খিত এবং আদর্শ গুনও বটে। এই কারণে সমাজের ভিত্তি ও ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবনের শুরু থেকে শিষ্টাচার সম্বন্ধিত গুণাবলীর বিকাশ ঘটা একান্ত প্রয়োজন। আজকের প্রবন্ধে আমরা শিষ্টাচার ও ছাত্রসমাজ সম্পর্কে একটি বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করতে চলেছি।

সূচি তালিকা
ভূমিকা:
এই পৃথিবীর বুকে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মানুষ তৈরি করেছিল সমাজ। সেই সমাজে সুন্দর ভাবে বাঁচতে গেলে মানুষের চরিত্রে কিছু গুণের সমাহার থাকা আবশ্যক। এসকল গুন্ডারা মানুষ সমাজের মধ্যে নিজের জীবনকে যেমন সুন্দর করে তোলে, তেমনি সার্বিকভাবে সমাজ জীবনও সুন্দর তথা আদর্শ হয়ে ওঠে। মানুষের চরিত্রের সেই সকল অত্যাবশ্যকীয় গুণ গুলির মধ্যে অন্যতম হলো শিষ্টাচার। বলা হয়, যে সমাজে শিষ্টাচার সুষ্ঠুভাবে বিরাজমান, সেই সমাজ কখনো বিপথগামী হতে পারেনা।
পক্ষান্তরে, একটি শিষ্টাচারহীন সমাজব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে অরাজকতারই নামান্তর। সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে শিষ্টাচারের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। আর সমাজ গঠনে শিষ্টাচারের সবথেকে বেশি ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় ছাত্রসমাজের মধ্যে। তাই শিষ্টাচারকে শিক্ষার্থীদের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গুণ হিসেবে পর্যালোচনা করতে হয়।
শিষ্টাচার কি:
শিষ্টাচার সম্পর্কীয় যেকোন আলোচনার ক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রথম প্রশ্ন আসে শিষ্টাচার আসলে ঠিক কি! এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো শিষ্টাচার মানবচরিত্রের কোন ঐকিক গুণ নয়, বরং বলা যায় শিষ্টাচার আদর্শ চরিত্রের একটি রূপমাত্র। চারিত্রিক এই আদর্শ রূপ গঠিত হয় কতকগুলি বিশেষ চারিত্রিক গুণাবলির সমন্বয়ে। এই সকল গুণাবলী সমাজে সুন্দর ভাবে বাঁচতে গেলে এবং জীবনে উন্নতি করতে গেলে একান্ত আবশ্যক। এই গুন গুলি হল নম্রতা, ভদ্রতা, মৃদুভাষীতা তথা সুরুচিবোধ।
মানবচরিত্রে এইসকল গুনগুলির যৌক্তিক সমন্বয় ঘটলে তবেই পাকে শিষ্টাচার বলে অভিহিত করা যায়। আদপে, শিষ্টাচার হল মানুষেরই মনের অন্ধকার দিক গুলিতে লুকিয়ে থাকা ‘কু’ গুলিকে পরিত্যাগ করে সকল ‘সু’-এর প্রতিষ্ঠা। জন্মের অব্যবহিত পর থেকে ধীরে ধীরে সু-অভ্যাসগুলির লালন এবং কার্যক্ষেত্রে যথাযথ পালনের মধ্যে দিয়েই শিষ্টাচার গড়ে ওঠে।
ছাত্রসমাজে শিষ্টাচারের গুরুত্ব:
ইতিপূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে, সমাজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিষ্টাচারের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তার কারণ হলো, জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠার পথে শিক্ষার্থী অবস্থায় মানুষের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় বিকাশ লাভ করে। সে কারণে যেকোনো ধরনের চারিত্রিক গুণাবলিকে আয়ত্ত করার ক্ষমতাও এই সময়েই বেশি থাকে। তাই শিষ্টাচার সম্বন্ধিত সকল গুণাবলীর নিয়মিত লালন তথা পালনের মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতের আদর্শ মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব।
তাছাড়া শিষ্টাচার ভিন্ন একজন ছাত্রের জীবন সমুদ্রের দিকভ্রষ্ট তরী ছাড়া আর কিছুই নয়। শিক্ষার্থীর চরিত্রে শিষ্টাচারের সমাবেশ না ঘটলে তার শিক্ষাজীবন কখনই সার্থক হতে পারে না। সর্বোপরি, প্রথাগতভাবে শিক্ষা শেষ করলেও তার প্রকৃত শিক্ষা আদৌ সম্পন্ন হয় না। এই কারণে জীবনের সফলতা লাভ করার ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীকে প্রতিনিয়ত বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। এখানেই একজন শিক্ষার্থীর জীবনে শিষ্টাচারের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়।
ইতিহাসে শিষ্টাচার:
সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ছাত্রসমাজের ইতিহাসে শিষ্টাচারের বরাবর এক গুরুত্বপূর্ণ ফান ছিল। অতীতকালে যখন মানুষের জীবন বর্তমানের মতন ভোগসর্বস্বতা দ্বারা কলুষিত হয়নি, তখন মানুষের কাছে একটি সুন্দর সমাজের গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। আর সমাজকে সুন্দর রাখার প্রয়োজনে মানুষ শিষ্টাচারকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিত। প্রাচীন ইউরোপে গ্রিসের ইতিহাস পড়ার সময় আমরা দেখতে পাই সেখানে ছোট ছোট সমাজে জ্ঞানী গুণী মানুষদের ব্যাপক কদর ছিল। সেই সকল মানুষ তাদের ছাত্রদের প্রতিনিয়ত উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী তৈরির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার কথা বলতেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন মৃদুভাষী, যথেষ্ট নম্র এবং স্নেহবৎসল; যার সবকটিই শিষ্টাচারের অপরিহার্য অঙ্গ।
প্রসঙ্গত উদাহরণস্বরূপ সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টোটল প্রমূখ দার্শনিকের কথা উল্লেখ করা যায়। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের শিক্ষার্থী মহলেও শিষ্টাচারের অগণিত নিদর্শন রয়েছে। অন্যদিকে মধ্যযুগীয় ব্রিটিশ সভ্যতায় শিষ্টাচার এক অভিনব উচ্চতায় পৌঁছেছিল। সমকালীন সভ্যতায় নাইটদের আচার-আচরণে শিষ্টাচার ছিল প্রাথমিক গুণ। ইতিহাস এই গুণকে শিভ্যালরি নামে অভিহিত করে।
ভারতবর্ষে শিষ্টাচারের ঐতিহ্য:
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে শিষ্টাচার সর্বকালীন সমাজের একটি সাধারণ গুন হিসেবে মান্যতা পেয়ে এসেছে। ভারতবাসী আজ থেকে চার হাজার বৎসর পূর্বে বুঝতে পেরেছিল শিষ্টাচারহীন সমাজ অরাজকতার নামান্তর এবং সমাজে শিষ্টাচারকে সাধারণ আচরণবিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে শিক্ষাজীবন থেকে চরিত্রে এই সকল গুণাবলীর নিয়মিত লালন ও পালনের বিকল্প কিছু নেই। এই উপলব্ধিরই অনিবার্য ফল হিসেবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে ঋক বৈদিক যুগ থেকে গুরু-শিষ্য পরম্পরার নমুনা অবিচ্ছিন্নভাবে চোখে পড়ে। এই গুরু-শিষ্য পরম্পরার প্রাথমিক রূপই ছিল শিষ্টাচারসম্পন্ন চরিত্রের গঠন।
ভারতবাসী মনে করত চরিত্রই মানুষের প্রধান শিক্ষক। চরিত্র গঠন না হলে শিখনের প্রক্রিয়া ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সেজন্য বারবার গুরুকুলে কঠোর ব্রহ্মচর্যের মধ্যে দিয়ে সার্বিক চারিত্রিক শিখনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হতো। ভারতবর্ষীয় সমাজের এই সাধারন গুণের কারণে ভারতবর্ষে যতবারই রাজনৈতিক উত্থান-পতন হোক না কেন, সাধারণ সমাজ জীবনে তার ব্যাপক প্রভাব চোখে পড়েনি। এ কারণেই ভারতবর্ষীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী সমাজকে একটি কিন্তু চির প্রবহমান প্রাণোচ্ছল জলধারাপূর্ণ নদীর সাথে তুলনা করা যায়।
শিষ্টাচার ও আধুনিক পৃথিবী:
বর্তমান পৃথিবীতে ব্যক্তিগত ভোগবিলাসের উপাদান অনেক বেশি সহজলভ্য হয়ে ওঠার কারণে মানুষ সামাজিক বিনোদনের থেকে ব্যক্তিগত বিনোদনের প্রতিই অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। ফলে এই আধুনিক যুগে সভ্যতার সমাজ কেন্দ্রিকতা হ্রাস পেয়ে তা বহুগুণে হয়ে উঠেছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় সমাজবিমুখ মনোভাব। সমাজের প্রতি মানুষের এই তাচ্ছিল্য প্রভাব ফেলে তার চারিত্রিক গুণাবলির উপরেও।
মানুষ যখন ব্যক্তিসর্বস্ব ভোগবিলাস মূলক জীবন যাপন করে, তখন তার কাছে আত্মকেন্দ্রিক বাহ্যিক সুখই বড় হয়ে দাঁড়ায়, শিষ্টাচার সম্বন্ধিত গুণাবলী হয়ে ওঠে গৌণ। বর্তমান যুগের ছাত্রসমাজের সিংহভাগের মধ্যে এই প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। সে কারণেই ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী গুরু শিষ্য পরম্পরা মুখে গিয়ে বর্তমানে শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে আত্মিক বন্ধন পরিণত হয়েছে পেশাগত সম্পর্কে।
স্বাভাবিকভাবেই পারস্পারিক স্নেহ ও সম্মানের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে গৌণ। যার ফলস্বরূপ সমাজের উপর অভিশাপ হিসেবে নেমে আসছে অপসংস্কৃতি, কুরুচিবোধ, এবং ধৈর্যহীন, অস্থির একটি বাতাবরণ। এই বাতাবরণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ছাত্রজীবনকে আধুনিক যুগের মানুষেরা বেঁধে ফেলতে চাইছে লিপিবদ্ধ নিয়মের বন্ধনে। কিন্তু মননে যদি শিষ্টাচারের উন্মেষ না ঘটে, লিপিবদ্ধ নিয়ম তাহলে আদপে মহাকালের পরিহাস হয়ে দাঁড়ায়।
উপসংহার:
সমাজের উপর ছাত্রসমাজের শিষ্টাচারের ব্যাপক প্রভাব পড়ে থাকে। শিক্ষার্থীরা হল সমাজের ভবিষ্যৎ, আর এই ভিত্তি তথা ভবিষ্যৎ যদি জীবনের প্রারম্ভ কাল থেকে শিষ্টাচার সমন্বিত গুনগুলির অধিকারী হয়, তাহলে সমাজের উজ্জ্বল অগ্রগতির পথ সুগম হয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় সুখ, শান্তি তথা সমৃদ্ধির পরিবেশ। তাই আধুনিক যুগের সাথে দূরদর্শী সনাতন মানসিকতার মিলনেই উন্নত ভবিষ্যতের পথ রচনা হতে পারে।
সর্বোপরি আমাদের মনে রাখা দরকার, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। ভোগসর্বস্ব জীবন মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক বিনোদনে মাতিয়ে রাখতে পারলেও, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রাথমিক উপাদানগুলির সুষম বন্টন সম্ভব কেবল মাত্র সুন্দর সামাজিক ব্যবস্থাপনা দ্বারা। তাছাড়া কেবলমাত্র শিষ্টাচার দ্বারাই ছাত্রসমাজ ভবিষ্যৎ জীবনে সার্থক সাফল্যের দিশা পেতে পারে। তাই অবিলম্বে আমাদের জীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিষ্টাচার সম্বন্ধিত গুনগুলির লালন এবং পালনের দিকে পুনরায় নজর দেওয়া দরকার।
আলোচ্য উপরিউক্ত প্রবন্ধটিতে আমরা শিষ্টাচার ও ছাত্রসমাজ সম্পর্কে সম্ভাব্য সবকটি দিকের ওপর যথাযথরূপে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। এ প্রসঙ্গে শিষ্টাচারের স্বরূপ সহ প্রাচীন তথা আধুনিক যুগে তার রূপ তুলে ধরারও চেষ্টা করা হয়েছে। তবে পরীক্ষার প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে অনিবার্যভাবেই আমাদের এই উপস্থাপনায় নির্দিষ্ট শব্দসীমা বজায় রাখতে হয়েছে। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।
উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।