শঙ্খ ঘোষ রচনা [সঙ্গে PDF]

বাঙালি সংস্কৃতিতে কবি কিংবা সাহিত্যিক জগত অসংখ্য উল্লেখযোগ্য প্রতিভা দ্বারা যুগে যুগে অলংকৃত হয়েছে। এই সকল অলংকারের মধ্যে অন্যতম হলেন আধুনিক যুগের বাঙালি কবি তথা সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষ। কবি শঙ্খ ঘোষ কাব্য ও সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি প্রবন্ধ রচনা এবং রবীন্দ্র গবেষণার সঙ্গেও বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। তার সমতুল্য আরেকটি প্রতিভা সমকালীন বাংলার বুকে বিরল। তার সুমহান জীবনের ওপর বিন্দুমাত্র আলোকপাতের প্রয়াস নিয়ে আমরা আজকের প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করতে চলেছি।

শঙ্খ ঘোষ রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

বাঙালি সংস্কৃতি বরাবরই সৃজনশীল শিল্পীসত্তার সমাদর করে এসেছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির ডালি থেকে কাব্য কিংবা সাহিত্য চর্চা বাদ পড়বে এমনটা ভাবাই যায়না। বাঙালি সমাজে প্রতিটি যুগে এমন  অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কবি এবং সাহিত্যিকরা বাংলা কাব্য এবং সাহিত্য জগতে অসামান্য অবদান রেখে গিয়েছেন।

তবে একথা সত্য যে আধুনিক যুগে বাঙালি সংস্কৃতি কিছুটা হলেও কবি কিংবা সাহিত্যিকের অভাবে ভুগেছে। কিন্তু বাঙালির কাব্য কিংবা সাহিত্যচর্চা যে রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ দাশের সাথেই শেষ হয়ে যায়নি সেকথাও আজকের এই উত্তর আধুনিক যুগের বারবার বিভিন্ন সাহিত্যিক কিংবা কবিরা প্রমাণ করে দিয়েছেন। উত্তরাধুনিক কালের সেই সকল উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর শিল্পী সত্তাকে জীবনানন্দ দাশ কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরসূরি হিসেবে অভিহিত করলেও কিছুমাত্র বাতুলতা হবে না। শঙ্খ ঘোষ ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক তথা একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। 

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন:

শঙ্খ ঘোষ নামটি কবির আসল নাম নয়। তার পোশাকি পিতৃদত্ত নামটি হল চিত্তপ্রিয় ঘোষ। শঙ্খ নামটি ছিল তার ডাকনাম। সাহিত্যিক এবং কবি জীবনে এই নামেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন। কবি শঙ্খ ঘোষের জন্ম ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে অধুনা বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ববঙ্গের চাঁদপুর জেলায়। তবে বংশানুক্রমিকভাবে তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারীপাড়া গ্রামে।

এই সকল তথ্য পরবর্তীকালে কবির নিজের মুখ থেকেই জানতে পারা যায়। তার পিতা মনীন্দ্র কুমার ঘোষ পেশায় ছিলেন একজন অধ্যাপক। তাছাড়া সেই সময় বাংলা ভাষার একজন স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিলেন। মনীন্দ্র কুমার ঘোষ রচিত ‘বাংলা বানান’ গ্রন্থটি সেই সময় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। কবির মাতার নাম ছিল অমলাবালা দেবী। পিতা চাকরিসূত্রে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের পাবনাতে কর্মরত থাকায় জীবনের প্রাথমিক পর্যায়গুলি কবি সেখানেই কাটান। 

শিক্ষাজীবন:

শঙ্খ ঘোষের শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল ছেলেবেলায় বাংলাদেশের পাবনায় চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ নামক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয় থেকেই তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এরপর শঙ্খ ঘোষ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে কলকাতার বুকে পাড়ি জমান। কলকাতায় এসে তিনি ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় কলা বিভাগে সসম্মানে তিনি স্নাতক স্তরের পড়াশোনা সম্পন্ন করেন।

সেখান থেকে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে শঙ্খ ঘোষ ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশেষত এই সময়ে থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার লেখাপত্র প্রকাশিত হতে শুরু করে। দু’বছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় তাঁর স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা শেষ হয়। 

কর্মজীবনে শঙ্খ ঘোষ:

পিতার মতন শঙ্খ ঘোষও তার কর্মজীবনের শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। সমগ্র কর্মজীবনে তিনি বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। এছাড়া তিনি দিল্লি এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘকাল। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইটার্স ওয়ার্কশপেও তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। তাছাড়া শিক্ষকতা করেছেন সিমলায় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ এডভান্স স্টাডিজ এবং আরো বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে। অবশেষে ১৯৯২ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শঙ্খ ঘোষ তাঁর শিক্ষকতা জীবন সমাপ্ত করেন। 

সাহিত্যচর্চা:

শঙ্খ ঘোষের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হল তার কাব্য ও সাহিত্য চর্চা। বাঙালি তাকে মূলত কবি হিসেবে চিনলেও, তিনি বিপুল সংখ্যায় গদ্যও রচনা করেছিলেন। এছাড়া একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল। অন্যদিকে শঙ্খ ঘোষের কাব্য রচনায় আলাদা করে কোন ভূমিকার প্রয়োজন হয় না। বাংলা কবিতার জগতে তাঁর অবদান অপরিসীম। তার রচিত ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’, ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ গুলি বাঙালি কবিতা প্রেমীদের মনের অন্দরমহলে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।

শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবি প্রতিভার দ্বিমুখী চরিত্রে কবি জগতে লাভ করেছেন এক অদ্ভুত অনন্যতা। একদিকে তার কলমে দৃপ্ত শব্দে উঠে এসেছে কঠোর সামাজিক তথা রাজনৈতিক বাস্তব, সমাজের নিচু তলার মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা; আবার অন্যদিকে কোন কোন কবিতায় এই মানুষটিই ডুব দিয়ে হারিয়ে যেতে চেয়েছেন মনের অবচেতনে। তাছাড়া অতি সরল কথ্য ভাষায় অসামান্য কবিতাগুলির সংযোজন তাকে পাঠকদের হৃদয়ের আরো নিকটবর্তী করে তুলেছে।

কবি ও সাহিত্যিকের পাশাপাশি একজন প্রাবন্ধিক হিসেবেও তার প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল। শঙ্খ ঘোষের লিখিত ‘উর্বশীর হাসি’, ‘শব্দ আর সত্য’, ইত্যাদি প্রবন্ধ গুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার রচিত ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক গ্রন্থ। 

রাজনৈতিক দর্শন:

শঙ্খ ঘোষ রাজনৈতিক মতাদর্শগত দিক থেকে কোনদিনই সুবিধাবাদী দলভুক্ত ছিলেন না। তার মতাদর্শে কখনোই আদর্শগত কঠোরতা কিংবা তাত্ত্বিকতার আড়ম্বর চোখে পড়েনি। যখন যে জিনিসকে তিনি ঠিক বলে মনে করেছেন, তাকেই তিনি সমর্থন করেছেন মুক্তকণ্ঠে। তার কলম যেমন রাজনৈতিক মানবপ্রেমের স্তুতি করেছে, তেমনি মুখর হয়েছে কখনো সুবিধাবাদী, কখনো জনবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধেও। তাঁর সাহিত্য সাধনা থেকে শুরু করে সমগ্র জীবন যাপনের মধ্যে বারবার প্রকাশ পেয়েছে সচেতন রাজনৈতিক সত্তা। এই প্রসঙ্গে তার রাজনৈতিক কবিতা কিংবা প্রবন্ধ গুলি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।

প্রসঙ্গত শঙ্খ ঘোষের রচিত ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’ রাজনৈতিক কাব্যগ্রন্থটির উল্লেখ করা যায়। এই কাব্যগ্রন্থকে কবি অলংকৃত করেছিলেন বিস্ফোরক সব রাজনৈতিক কবিতা দ্বারা। অন্যদিকে জীবনের অন্তিম পর্ব পৌঁছেও সমকালীন রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। ২০১৯ সালেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে তিনি নিজের মত করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। 

প্রাপ্ত সম্মাননা ও পুরস্কার সমূহ:

চিত্তপ্রিয় শঙ্খ ঘোষের সমগ্র জীবনটাই অসামান্য সব কর্ম দ্বারা অলংকৃত। তার এই সকল অপূর্ব সৃষ্টিগুলির জন্য তিনি সমগ্র জীবনে অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৭৭ সালে ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন বিখ্যাত সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ধুম লেগেছে হৃদয় কমলে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার পান।

১৯৯৯ সালে ‘রক্তকল্যান’ শীর্ষক একটি অনুবাদের জন্য আবার তাকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার দ্বারা ভূষিত করা হয়। ওই একই বছরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দেশিকোত্তম পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত করে। ২০১১ সালে ভারত সরকার তাকে ভারতবর্ষের তৃতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করে। আবার ২০১৬ সাল নাগাদ তিনি লাভ করেন স্বনামধন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। 

উপসংহার:

২০২১ সালের করোনা মহামারী বাঙালির হৃদয় থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে শঙ্খ ঘোষের মতন প্রবাদপ্রতিম প্রতিভাকেও। এই বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতেই সর্দি কাশির কারণে তার করোনা পরীক্ষা করা হলে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তবে কবি এই মহামারীর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হতে না চাওয়ায় বাড়িতেই নির্জন একাকীত্বে তার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু এপ্রিল মাসের ২১ তারিখে করোনার সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধে কবি শঙ্খ ঘোষের পরাজয় ঘটে।

তাঁর প্রয়াণে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, কবি জয় গোস্বামী প্রমুখরা শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। তবে জীবন থাকলে মৃত্যুও অনিবার্য। কিন্তু মৃত্যুতে কবি শঙ্খ ঘোষের মতন প্রতিভার সমাপ্তি ঘটে না। সমগ্র জীবন দিয়ে তিনি যে অমর সৃষ্টিগুলি রচনা করে গিয়েছেন, সেগুলি চিরকাল তাকে বাঙালি পাঠকদের হৃদয়ে অমর করে রাখবে।


কবি শঙ্খ ঘোষের জীবন সম্পর্কে আলোচিত এই প্রতিবেদন ছিল তাঁর মহান কর্মময় জীবনের একটি অতি সংক্ষিপ্ত সারাংশ মাত্র। আমাদের এই প্রবন্ধ দ্বারা আমরা তার জীবনের মহত্বটুকুকে সামান্য ছুঁয়ে অনুভব করার প্রচেষ্টা করলাম। কবির জীবনের সবকটি উল্লেখযোগ্য দিক সম্বন্ধে আমরা উপরিউক্ত আলোচ্য প্রবন্ধে যথাযথ আলোচনার চেষ্টা করেছি।

আশা করি আমাদের আজকের এই প্রতিবেদন আপনাকে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে যথাযথরূপে অবগত করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের এই দুঃসাহসিক প্রয়াস আপনাদের কেমন লাগলো নিচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের অবশ্যই জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। 

ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন