ভারতবর্ষের বুকে যুগে যুগে এমন অসংখ্য প্রতিভা জন্ম নিয়েছিলেন যারা এই দেশ তথা এই দেশের সমাজকে নিজেদের জীবন দিয়ে সুসংস্কারের আলোয় আলোকিত করে তোলার চেষ্টা করেছেন। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন আধুনিক যুগে ভারতের পদার্পণের প্রারম্ভিক লগ্নে বাংলার বুকে আবির্ভূত হওয়া এমনই একজন যুগান্তকারী ব্যক্তিত্ব।
তিনি সমকালীন বাঙালি সমাজের রাজনীতি, জনপ্রশাসন, দর্শন, ধর্মীয় এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে পেরেছিলেন। বাঙালি তথা সমগ্র ভারতীয় সমাজের পরমপূজ্য এই ব্যক্তিটির মহান জীবনের ওপর বিন্দুমাত্র আলোকপাতের দুঃসাহস এই প্রবন্ধ দ্বারা আজ আমরা করতে চলেছি।
সূচি তালিকা
ভূমিকা:
পরাধীন ভারতবর্ষে এই বাংলার বুকে এমন সব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের আবির্ভাব ঘটেছিল যারা তাদের সমগ্র জীবন ব্যাপী অসংখ্য কীর্তির দাঁড়া অঞ্চল তথা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীর বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন। উনবিংশ শতাব্দী বাংলায় এমনই সব যুগান্তকারী প্রতিভার জোয়ার আসে।
বাংলার এই অদ্ভুত মেধা এবং উন্নত সংস্কৃতি দ্বারা অভিভূত হয়ে গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন “What Bengal thinks today, India thinks tomorrow.” বাংলা তথা ভারতের বুকে আধুনিক যুগের আগমন এমনই যে সকল জ্যোতিষ্কদের হাত ধরে হয়েছিল তাদের মধ্যে একেবারে প্রথম দিকের এবং সম্ভবত সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তার হাত ধরেই বাংলা মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে আধুনিক যুগের আলোকোজ্জ্বল প্রাঙ্গণে পদার্পণ করে।
জন্ম ও পরিবার:
রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম হয় ১৭৭২ সালের ২২শে মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে। তিনি ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। তার তার প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত দিল্লির মোঘল বাদশা ফারুকশিয়ারের সময়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সুবেদারের আমিনের কাজ করতেন। এই কাজের সূত্রেই তাদের পরিবারে ‘রায়’ পদবীর প্রচলন বলে মনে করা হয়। প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠপুত্র ব্রজবিনোদ রায় ছিলেন রামমোহনের পিতামহ।
ব্রজবিনোদ রায়ের পুত্র রামকান্তের তিনটি বিবাহের মধ্যে মধ্যমা পত্নী তারিণীর এক কন্যা এবং দুই পুত্র: জগমোহন এবং রামমোহন। রামমোহনের পৈত্রিক বংশ বৈষ্ণব হলেও তার মায়ের বংশে তন্ত্রসাধনার ব্যাপক প্রচলন ছিল। রামমোহনের জন্মের কিছু পড় রামকান্ত রায় পৈত্রিক বাসস্থান ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লাঙ্গুল পাড়া গ্রামে সপরিবারে উঠে যান।
শিক্ষাজীবন:
সমকালীন সময়ের নিয়ম অনুসারে রামমোহনের শিক্ষা জীবনে ব্যাপক আড়ম্বরের সমারোহ ছিল না। তিনি মাত্র ১৫-১৬ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণকালে তিনি অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের থেকে বিভিন্ন প্রকার শিক্ষা আত্মস্থ করেন।
গৃহত্যাগী অবস্থায় তিনি কাশীতে এবং পাটনায় বেশকিছু কাল থেকে নেপালে যান। কাশীতে থাকাকালীন তন্ত্রশাস্ত্র বিশারদ সুপন্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার-এর সাথে রামমোহন রায়ের পরিচয় ঘটে। এই নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার পরবর্তীকালে হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কুলাবধূত নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার-এর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে রামমোহন সংস্কৃতি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
তার পাশাপাশি বেদান্ত সম্পর্কেও রামমোহন রায়ের অনুরাগ জন্মায়। পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম উপাসনালয়ে প্রতিষ্ঠায় গুরু হরিহরানন্দ স্বামীই রামমোহনের প্রধান সহায়ক হয়েছিলেন। তার কাছ থেকে কাশীতে সংস্কৃত শিক্ষার পর পাটনায় থাকাকালীন তিনি আরবি এবং ফারসি ভাষা শেখেন। পরবর্তীকালে রামমোহন ইংরেজি, গ্রিক এবং হিব্রু ভাষাতেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
কর্মজীবন:
দীর্ঘদিন গৃহত্যাগী অবস্থায় বসবাস করার পর ১৭৯৬ সাল নাগাদ কলকাতায় ফিরে তরুণ বয়সে রামমোহন রায় মহাজনের কাজ করতেন। এরপর ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে তিনি কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। এসময় তার কাজ ছিল ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসা নবাগত ব্রিটিশ অসমরিক কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাদের নানা দেশীয় কাজে সহায়তা করা।
এই কাজের সময় রামমোহনের ইংরেজি শিক্ষার ভিত্তি আরো দৃঢ় হয় এবং ব্রিটিশ সিভিলিয়ান মহলে তিনি একজন পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। সেই সিভিলিয়ানদের মধ্যেই একজন জন ডিগবির পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার রংপুরে তিনি দেওয়ান হিসেবে কাজ করেন। এই সিভিলিয়ান ব্রিটিশ অফিসারের সংসর্গে থেকেই তার মনে পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে জ্ঞান এবং কৌতুহল পরিপক্কতা লাভ করে।
সতীদাহ এবং রামমোহন:
ভারতের হিন্দু সমাজে মধ্যযুগে যে কয়েকটি কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস মূলক প্রথা প্রচলিত ছিল, সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সতীদাহ। এই প্রথা অনুসারে মৃত স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীকে সহমরণে যেতে হতো। রামমোহন রায় গোড়া থেকেই এই প্রথার তীব্র বিরোধী ছিলেন।
বেদান্ত চর্চা করবার সময় তিনি সতীদাহ কে বারবার অশাস্ত্রীয় বলে প্রমাণ করেছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে একাধিকবার তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের কাছে দরবার করেছিলেন। সমাজে রামমোহন রায়ের ব্যাপক সতীদাহ বিরোধী প্রচার ও প্রসারের ফলে এবং ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ১৮২৯ সালে আইন করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়।
তবুও সমাজের ধর্মভীরু মানুষব্রিটিশ সরকারকে বারবার এই আইনের পুনর্বিবেচনার জন্য প্রস্তাব জানাতে থাকে। তাদের এই প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে যৌক্তিক বক্তব্য পেশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে রামমোহন রায় ১৮৩০ সালে বিলেত যাত্রা করেন।
বিলেত যাত্রা:
খুব অল্প বয়স থেকেই পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি রামমোহন রায়ের অনুরাগ ছিল প্রবল। তবে একথা ভুললেও চলবে না যে তিনি তার দেশের উন্নতির জন্য সারা জীবন ব্যাপী ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন।
নিজের দেশেরই একটি কুপ্রথার বিরোধিতা সংক্রান্ত বক্তব্য পেশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৮৩০ সালের ১৯শে নভেম্বর তিনি কলকাতা থেকে বিলেতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি কিছুদিনের জন্য ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন।
ব্রাহ্মসমাজের গোড়াপত্তন:
বেদান্ত দর্শনের একান্ত অনুরাগী হওয়ার কারণে রামমোহন রায় ব্যক্তিগতভাবে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। হিন্দু ধর্মের মধ্যে নিয়ত বাড়তে থাকা কুসংস্কার এবং অন্ধ বিশ্বাস তাকে স্বভাবতই বিব্রত করেছিল। সে কারণে তিনি চেয়ে ছিলেন আদি বৈদিক সংস্কৃতির সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মতবাদটুকু নিয়ে একটি আধ্যাত্বিক কিন্তু কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসহীন সমাজ গড়ে তুলতে।
এই উদ্দেশ্যকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য উনবিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে কলকাতার কিছু সুধীজনদের নিয়ে গড়ে তোলেন ব্রহ্ম উপাসনা মূলক একটি সভা। এই সভাটি প্রাথমিক পর্যায়ে আত্মীয়সভা নামে পরিচিত ছিল। এরপর ১৮২৮ সাল নাগাদ কলকাতায় এই আত্মীয় সভা ব্রাহ্মসমাজ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতাকে বর্জন করে একেশ্বরবাদের আরাধনায় জোর দিয়েছিল।
এই সমাজের হাত ধরেই কলকাতার শিক্ষিত বাঙ্গালীদের মধ্যে ব্রাহ্মধর্ম প্রসার লাভ করে। রাজা রামমোহন রায়ের মত এই ব্রাহ্মসমাজও বিশ্বাস করত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত এই ব্রাহ্মসমাজ পরবর্তীকালে মোট চারটি কিংবা মতান্তরে পাঁচটি ভাগে ভাগ হয়ে গেলেও এই সমাজের বিভিন্ন শাখার বিভিন্ন সদস্যরা ভারতীয় সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গিয়েছিলেন।
লেখালেখি ও প্রকাশনা:
রাজা রামমোহন রায় তাঁর সমগ্র জীবনে অসংখ্য গ্রন্থ এবং পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় লেখা তুহফাতুল মুহাহহিদিন। এ বইটিতে একেশ্বরবাদের প্রতি রামমোহন রায়ের সমর্থনে লক্ষ্য করা যায়। এরপর একেশ্বরবাদ বা ব্রাহ্মবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি তিনি বাংলায় রচনা করে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সময়ে ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রামমোহন রায় বাংলায় সম্পাদনা করেছিলেন বেদান্ত গ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মান্ডুক্য উপনিষদ এবং মুণ্ডক উপনিষদ। তার প্রগতিশীল মতবাদের বিরোধিতা করে সমাজের রক্ষণশীল মানুষেরা প্রতিবাদী বিভিন্ন গ্রন্থে তার বিরোধিতা করলে, তিনি ভদ্র ভাষায় উত্তর গ্রন্থ রচনা করে প্রতিবাদীদের যুক্তি খন্ডন করে নিজের যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতেন।
এছাড়া সংস্কারমূলক গ্রন্থাদি ছাড়াও তিনি ব্রিটিশ সাহেবদের বাংলা শেখানোর জন্য বাংলা এবং ইংরেজিতে ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। সর্বোপরি তাঁর হাত ধরেই প্রকাশিত হয় বাংলার অন্যতম উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র যা ইতিহাসে সম্বাদ কৌমুদী নামে বিখ্যাত।
উপসংহার:
মুঘল শাসক দ্বিতীয় আকবর রামমোহন রায়কে রাজা উপাধি ভূষিত করে মুঘল সাম্রাজ্যের দূত হিসেবে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত করেন। সেখানেই ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ব্রিস্টলের কাছে স্টেপলটনে ভারতের এই নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃতের জীবনাবসান ঘটে।
ব্রাহ্ম ধর্ম অনুযায়ী ব্রিস্টলের আর্ণস্ট ভ্যাল সমাধিস্থলে তাকে কবর দিয়ে সমাধিস্থ করা হয়। সারা জীবন দেশের কুসংস্কার দূরীকরণ এবং সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে কাজ করে যাওয়া মানুষটির শেষ জীবন ছিল এতটাই সংক্ষিপ্ত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা রামমোহন রায়কে ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক মানুষ বলে অভিহিত করেছিলেন।
রাজা রামমোহন রায়ের জীবনের মোটামুটি সব ক’টি দিকের ওপর সংক্ষিপ্তভাবে যতখানি আলোকপাত করা সম্ভব, আমরা এই প্রবন্ধে ততখানি প্রয়াস চালিয়েছি। আশা করি আমাদের এই উপস্থাপনা আপনাদের ভাল লেগেছে। প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান।
আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।