বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা [সঙ্গে PDF]

যে কোনো জাতির শিক্ষা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হল সেই জাতির কবি ও সাহিত্যিক। বাঙালি কবি, লেখক, বা সাহিত্যিক বললেই যাঁর নামটি প্রথমেই উঠে আসে তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা ভাষাকে তিনি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন তাই আজ তাঁর কথা স্মরণ করে আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি

ভূমিকা:

এই আশ্চর্য বিশ্বে কালের গর্ভ থেকে কখনো কখনো এমন কিছু অত্যাশ্চর্য, অভাবনীয় এবং বিরল প্রতিভার জন্ম হয় যারা তাদের কর্মে, ব্যক্তিত্বে ও মহত্বে সময়কেও ছাপিয়ে গিয়ে বিশ্বে চির অমর হয়ে থাকেন। মানবজাতির কাছে মহাকালের এমনই এক শ্রেষ্ঠ দান কবিগুরু তথা মহামানব শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনই এক দানবীয় প্রতিভা যিনি সর্বযুগে সর্বকালে চির প্রাসঙ্গিক, চির নবীন ও চিরন্তন রূপে শাশ্বত।

সাধারণ মানুষের চিন্তার ক্ষুদ্র পরিসরে রবীন্দ্রনাথকে আলোচনা করতে গেলে তা হবে সমগ্র মহাসিন্ধুর এক ক্ষুদ্র বিন্দুর ন্যায়। তবুও আমাদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে দিয়েই আমরা এই মহামানবকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনই এক বিরল প্রতিভা যার মধ্যে বিশ্বের প্রায় সকল প্রকার সাংস্কৃতিক তথা সামাজিক গুণাবলী বর্তমান ছিল।

জীবদ্দশায় তার অতিমানবিক মেধায় এবং অকৃত্রিম মহামানবিক দানে তিনি পূর্ণ করে দিয়ে গিয়েছেন এই পৃথিবীর সাংস্কৃতিক তথা সামাজিক চিন্তা জগতকে। নিজের অনন্য শাশ্বত চিন্তাধারায় তিনি ছাপিয়ে গিয়েছেন জাতি, দেশ, কালের সকল গন্ডি; এমনকি বারে বারে অতিক্রম করে গিয়েছেন নিজের ঐকান্তিক পরিচয়কেও। তাই মহর্ষির ন্যায় প্রজ্ঞা দৃষ্টিসম্পন্ন এই মহামুনির জীবনের মহাযজ্ঞকে কোন একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব।

বংশ পরিচয়:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করার পূর্বে আমাদের তার বংশ পরিচয় সম্পর্কে জেনে নেওয়া একান্ত জরুরী। মনে রাখা দরকার কোন মহান প্রতিভা বা ব্যক্তিত্বের শিকড় প্রোথিত থাকে তার বংশের ইতিহাসের মধ্যেই। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তৎকালীন কলিকাতা শহরের অন্যতম অভিজাত ঠাকুর পরিবারের সন্তান। এই ঠাকুরদের আদি পদবী কুশারী, আদি বাসস্থান কুশ নামক গ্রাম বা বর্তমান বর্ধমান জেলা।

এই বংশেরই এক সন্তান জগন্নাথ কুশারীর হাত ধরে কুশারীরা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এদেরই এক শাখা ইংরেজ বণিকদের হয়ে ভারতীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে মধ্যস্থতাকারীর কাজ করতো। কাজের সূত্রে বন্দর সংলগ্ন জেলেপাড়ায় কুশারীদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল।

কথিত আছে, জেলেরা তাদের সুন্দর চেহারার জন্যে ঠাকুর বলে ডাকা শুরু করলে কালক্রমে কুশারীরা ঠাকুর পদবীতেই পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ঠাকুর পরিবার পাথুরিয়াঘাটা এবং জোড়াসাঁকো এই দুইটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বংশের জোড়াসাঁকো শাখার সন্তান।

জন্ম ও পরিবার:

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়। তাঁর পিতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা শ্রীমতি সারদা দেবী। তিনি ছিলেন তার পিতামাতার চতুর্দশতম সন্তান। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তৎকালীন সময়ে সমাজের শীর্ষ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম বাঙালি ব্যবসায়ী যিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছিলেন।

তাদের পরিবারের ছিল নুনের ব্যবসা। যদিও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর ঠাকুর পরিবার বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বেশকিছু জমিদারি কিনে নেয়। তবে রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়-আশয়ের তুলনায় আধ্যাত্মিকতা সংস্কৃতি চর্চা এবং জনহিতৈষী কাজকর্মে অধিক মনোযোগী ও আগ্রহী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেবের সময় থেকেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার বাংলার আধুনিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান হয়ে ওঠে।

শৈশব ও বাল্যকাল:

কবিগুরুর বাল্যকাল তেমনি ঘটনাবহুল ছিলনা। নানা পারিবারিক অনুশাসন এবং নিয়মকানুনের মধ্যে কেটেছিল তার শৈশব। মাত্র ১৪ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে অন্যান্য সাধারণ সন্তানদের মতই অভিজ্ঞ পরিচারকদের কাছে রবীন্দ্রনাথ লালিত পালিত হন।

তথাকথিত পারিবারিক স্নেহ এবং আদর থেকে তার ছেলেবেলা ছিল বঞ্চিত। যদিও নিজের আত্মজীবনী জীবনস্মৃতিতে কবিগুরু উল্লেখ করেছেন এই তার কাছে “অনাদর ছিল এক মস্ত স্বাধীনতা”। এই আত্মজীবনীতেই তিনি তার ছেলেবেলা সম্পর্কে নানা বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার কাহিনী লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। 

শিক্ষাজীবন:

অন্যান্যদের মতন রবীন্দ্রনাথ কোন সাধারন শিশু ছিলেন না। তাই তার শিক্ষাজীবনও ছিল অন্যান্যদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। ছেলেবেলায় একজন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং কয়েকজন গৃহশিক্ষকের কাছে তার প্রাথমিক বিদ্যারম্ভ হয়। এরপর ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমী এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন শিক্ষালাভের পর বিদ্যালয়ের বাঁধাধরা নিয়ম ও বদ্ধ আবহাওয়া রবীন্দ্রনাথের মনঃপুত না হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়।

কলকাতার ব্যস্ত ও প্রকৃতিহীন জীবনের তুলনায় রবীন্দ্রনাথ স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন পানিহাটি কিংবা বোলপুরের বাড়িতে সময় কাটাতে। এই সকল সময়ে পিতার কাছ থেকে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ে বিবিধ জ্ঞানলাভ করেন। তাছাড়া পিতার সাথে সমগ্র দেশ জুড়ে ভ্রমণকালে সংস্কৃত ব্যাকরণ, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের মতন বিভিন্ন বিষয়ের সাথে তার পরিচিতি ঘটে।

১৮৭৮ সালে ঠাকুর পরিবারের তরফে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। সেখানে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের আইনবিদ্যা নিয়ে তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। যদিও মাত্র দেড় বছর পর পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই কোন ডিগ্রী না নিয়ে দেশে ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ।

বিবাহ ও ব্যক্তিগত জীবন:

১৮৭৩ সালে পিতার সাথে দেশভ্রমণে বেরোনোর পূর্বে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ছেলেবেলায় নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর সাথে কবিগুরুর গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান। তারপর ২২ বছর বয়সে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুরবাড়িরই এক অধঃস্তন কর্মচারী বেনীমাধব রায়চৌধুরীর একাদশ বর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর সাথে কবিগুরুর বিবাহ সম্পন্ন হয়।

বিবাহের পর তার স্ত্রী-এর নাম হয় মৃণালিনী দেবী। এই দম্পতির মোট পাঁচজন সন্তান হয়েছিল। তারা হলেন যথাক্রমে মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেনুকা, মীরা, এবং শমীন্দ্রনাথ। এদের মধ্যে রেনুকা এবং শমীন্দ্রনাথের খুব অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়।

কর্মজীবন:

প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের কর্মজীবন এতটাই বিস্তৃত যে তা নিয়েই এই ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তবে পারিবারিক সূত্রে তিনি পেশাগতভাবে জমিদারি সামলানো, খাজনা আদায় এবং মহাল পরিদর্শনের মত বৈষয়িক কাজে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় পরিভ্রমণ করেন। তাই চিন্তাবিদ রবীন্দ্রনাথের থেকে এক্ষেত্রে আমরা বৈষয়িক রবীন্দ্রনাথকে আলাদা করে আলোচনার চেষ্টা করব।

বিলেত থেকে দেশে ফিরে আসবার পর ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া জেলা, রাজশাহী, পাবনা তথা উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চলে পারিবারিক জমিদারিগুলি তদারকির কাজে রবীন্দ্রনাথ নিয়োজিত হন। নিজের পারিবারিক বজরায় চড়ে তিনি এই জমিদারিগুলির তদারকিতে যেতেন। প্রজাদের মধ্যেও ব্যাপক জনপ্রিয় কবিগুরুর সম্মানে গ্রামবাসীরা জমিদারের উপস্থিতিতে ভোজসভার আয়োজন করত।

কবি রবীন্দ্রনাথ:

সবকিছুর ঊর্ধ্বে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন কবি। তিনি তাঁর কাব্য সৃষ্টির দ্বারা বিভোর করে দিয়েছেন সমগ্র বিশ্বকে। মাত্র আট বছর বয়সে কবিগুরু কাব্য রচনা শুরু করেন। তার প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রথম জীবনে ছিলেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী দ্বারা অনুপ্রাণিত। অনুপ্রেরণার এই চাপ তার প্রথম দিককার কবিতাগুলিতে পাওয়া যায়।

অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বেশকিছু কবিতায় লালন ফকিরের বাউল গান, রামপ্রসাদী গান, উপনিষদের দর্শন তথা বৈষ্ণব পদাবলীর বিভিন্ন প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যদিও পরবর্তীতে কবিগুরু সম্পূর্ণ নিজস্ব ঘরানায় অজস্র কাব্য রচনা করেন। এসকল কাব্যে তার জীবনের বিভিন্ন গভীর দর্শন যেমন প্রেম, সৌন্দর্য, আধ্যাত্মিকতা, বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা, আনন্দ, বিষন্নতা ইত্যাদি ফুটে ওঠে।

কবিগুরু রচিত যে বইটি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত সেটি হল গীতাঞ্জলি। তাছাড়া সঞ্চিতা গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সকল কবিতা একত্রে সংকলিত রয়েছে। মৃত্যুর মাত্র আট দিন পূর্বে বিংশ শতাব্দীর এই মহামানব মৌখিকভাবে তার শেষ কবিতা ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ রচনা করেন।

সঙ্গীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ:

বিশ্বকবি যে ভূমির সন্তান, সেই বাংলার মানুষের কাছে তার পরিচয় কবির থেকেও বেশি একজন সঙ্গীতস্রষ্টা রূপে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনে মোট ১৯১৫টি গান রচনা করেছিলেন। প্রথমদিকে তার সংগীত রচনায় ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণা লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বকবি ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত পল্লী সংগীত এবং ইউরোপীয় সুরশৈলীর মিশ্রণে একটি নিজস্ব স্বকীয় সুরশৈলী নির্মাণ করেন।

তার প্রথম দিককার সঙ্গীত রচনায় বিভিন্ন প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও পরবর্তীতে নিজের বিভিন্ন কবিতাকে স্বকীয় নিজস্ব সুরের মূর্ছনায় তিনি গানে রূপান্তরিত করেন। তার গান গুলির মধ্যে সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনার প্রভাব স্পষ্ট। এই সমস্ত ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে কবিগুরুর ব্যক্তিগত দর্শন গান গুলির মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়। গানের সাথে সাথে নৃত্যকলাকেও রবীন্দ্রনাথ সমান গুরুত্বের সাথে দেখতেন। তিনি ইউরোপীয় অপেরার আদলে বাংলা নৃত্যনাট্যের সূচনা ঘটান।

সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ:

গান ও কবিতা ছাড়াও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনে রচনা করেছেন নানা অমর উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক প্রভৃতি। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার নামে পরিচিত। তার লেখা ছোটগল্প গুলি সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নামে বা ছদ্মনামে প্রকাশিত হতো। এগুলির মধ্যে ক্ষুধিত পাষাণ, মনিহারা, নষ্টনীড়, কাবুলিওয়ালা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

অন্যদিকে উপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ তার জীবনে মোট ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এই সকল উপন্যাসগুলিও সমকালীন নানা পত্র-পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তাঁর রচিত নাটক গুলি বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ সম্পদ। তাছাড়া বিভিন্ন সমকালীন আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করার উদ্দেশ্যে নানা পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ রচনা করেন। কবিগুরুর সকল রচনাতেই আমরা তার গভীর দর্শন চিন্তার পরিচয় পেয়ে থাকি। 

চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ:

চিত্রশিল্পে রবীন্দ্রনাথের কোন প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও তিনি তার চিত্রকলায় বহু ধরনের অংকনশৈলী রপ্ত করেছিলেন। নিয়মিতভাবে তার ছবি আঁকা শুরু প্রায় ৭০ বছর বয়সে।  খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার ছবি তিনি একেছিলেন। এর মধ্যে অধিকাংশই শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনের আর্ট গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে।

শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রনাথ:

কবিগুরু নিজে যেমন প্রথাগত পুঁথিগত বদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা অপছন্দ করতেন, তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তার অবদান অবিস্মরনীয়। জীবদ্দশায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তার ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। এই সকল দেশের ব্যাপক উন্নতির উদাহরণ এবং সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের একত্র মিশেলে তিনি এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করেন।

বোলপুরের শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর উদ্যোগে এই শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় বিশ্বভারতী আশ্রমিক বিশ্ববিদ্যালয়। এই আশ্রমে সনাতনী ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে কবিগুরু ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথার পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন। এখানকার শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এমন সব বিষয় যা তাদের বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্বচেতনার সাথে ভারতীয় মনকে একসূত্রে একীভূত করবে।

রাজনৈতিক মতাদর্শ ও চিন্তাধারা:

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন ছিল তুলনামূলক ভাবে জটিল। একদিকে যেমন তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থন করতেন, অন্যদিকে তিনি বিরোধিতা করতেন নৈরাজ্যমূলক বিপ্লবের। এই প্রসঙ্গে বলা যায় ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি যেমন নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন, আবার ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশী আন্দোলনকে ‘চরকা সংস্কৃতি’ বলে বিদ্রূপ করেন।

প্রকৃতপক্ষে তার মতাদর্শ ছিল জনসাধারণের আত্মিক এবং বৌদ্ধিক উন্নতির মাধ্যমে সর্বাত্বক মুক্তিলাভ। তবে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন সমাবেশে সশরীরে যোগদান করেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে করেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে রাখি বন্ধন উৎসব। তার রচিত বিভিন্ন গান ও কবিতা তৎকালীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

সম্মান:

জীবদ্দশায় তার নানা কীর্তির জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মানে ভূষিত হন। এগুলির মধ্যে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদিত গীতাঞ্জলি বই-এর জন্য প্রাপ্ত নোবেল পুরস্কারটি সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া সমকালীন ইংরেজ সরকার তাকে নাইটহুড সম্মানও ভূষিত করে।

উপসংহার:

ভারতের এই বিস্ময়কর প্রতিভার মহাপরিনির্বাণ ঘটে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট। তার অনন্য অমর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি সদা প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছেন বিশ্ববাসীর হৃদয়ে। সর্বোপরি বাঙালি জাতির সম্মান এবং গৌরবকে বিশ্ববাসীর কাছে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

যদিও সকল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি একজন সার্থক বিশ্ব নাগরিক: বাল্মিকী-কালিদাসের ন্যায় ছিল যার হৃদয়, আর টলস্টয়ের মতন গভীর সমাজ চেতনা। তাইতো রবীন্দ্রনাথ শুধু একক ব্যক্তি বিশেষে গুরুত্বপূর্ণ নন; তিনি হলেন সকল দেশের, সকল কালের তথা সকল মানবের পবিত্র তীর্থভূমি।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার।এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন