মহরম রচনা [সঙ্গে PDF]

হিন্দুদের কাছে দুর্গাপূজা যেমন উৎসব আনন্দের পুজো, তেমনই মুসমানদের মহরম এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা করুন রসে সিক্ত। অশুভ শক্তিকে বিনষ্ট করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার এই পবিত্র অনুষ্ঠানকে নিয়েই আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় মহরম রচনা।

মহরম রচনা

ভূমিকা:

উৎসব সাধারণভাবে আনন্দ উদযাপনের বিষয় হলেও, কোনো উৎসবের প্রকৃত চরিত্র হলো মানুষের মিলন ও সেই মিলনের উদযাপন। ইসলাম ধর্মে এমন বেশ কয়েকটি উৎসবের প্রচলন রয়েছে। সেই উৎসবগুলির মধ্যেই অন্যতম একটি হলো মহরম। উল্লেখযোগ্য ভাবে মহরম কোন আনন্দ উদযাপন-এর উৎসব নয়।

বরং মহরম হলো বিশ্বজুড়ে সকল মুসলমানের মিলিত শোকউদযাপনের উৎসব। মহরম এর এই উৎসবের ধর্মীয় গুরুত্বের থেকেও বেশি রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। ঐতিহাসিক সেই গুরুত্বকে পাথেয় করেই মহরম এর নির্দিষ্ট দিনে বিশ্বজুড়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের সকল মানুষ এক পরম শোক পালনে ব্রতী হন। ইসলাম ধর্মের শোক পালনের এই উৎসব সম্পর্কে আলোকপাত করার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

মহরম মাস:

মহরম হলো ইসলামিক বর্ষপঞ্জির সর্বপ্রথম মাস। ইসলামিক রীতি অনুযায়ী কোরআনে বর্ণিত মুসলিমদের চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি অন্যতম। প্রাচীনকাল থেকেই এই মাসটিকে বিশেষ সম্মান ও গুরুত্বের সঙ্গে শ্রদ্ধা সহকারে পালন করা হয়ে থাকে। এই মাসের ১০ তারিখ হল সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন দিন।

এই তারিখটিকে কেন্দ্র করেই সকল ঘটনা আবর্তিত হয়। এই দিনটিকে আশুরা বলা হয়ে থাকে। এই মাসটি ইসলামে বিশেষ ঘটনাবলীর সাক্ষী। পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক উভয় দিক থেকেই এই মাস বিশেষ তাৎপর্য লাভের অধিকারী।

ইসলামিক লোককথায় মহরম:

মহরম মাসের দশ তারিখকে কেন্দ্র করে ইসলামিক লোককথায় বিভিন্ন ঘটনার কথা বর্ণিত রয়েছে। কোরআন অনুসারে এই দিনটি হলো আল্লাহর জগৎ সৃষ্টির দিন; আবার এই দিনেই নেমে আসবে কেয়ামত। এই দিনেই নাকি প্রথম মানব আদমকে সৃষ্টি করেন আল্লাহ। আবার এই দিনেই জান্নাতে স্থান দেওয়া হয় আদি পিতা আদমকে।

কথিত আছে নূহ-এর সময় কালে এই মাসের ১০ তারিখেই নাকি বিশ্বে মহাপ্লাবন আসে। আবার এই দিনেই প্রচলিত লোকগাথা অনুসারে ইব্রাহিম জন্ম নেন এবং মুসা ও তার সাথীরা ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পান। আল্লাহ এই দিনেই ফেরাউন ও তার সৈন্যদেরকে নীলনদের পানিতে ডুবিয়ে মেরেছিলেন বলে জানা যায়।

অন্যদিকে ইসলাম ধর্ম অনুসারে খ্রিস্টধর্মের যীশু বা নবী ঈসা জন্ম নিয়েছিলেন এই দিনেই। এই সকল ঘটনা দ্বারা পূর্ণ হওয়ার কারণেই মহরম মাসের ১০ তারিখে আশুরার এই দিনটিকে পরম পবিত্র একটি দিন বলে গণ্য করা হয়। 

ইতিহাসে শোকের মহরম:

কুরআনে বর্ণিত রয়েছে ইরাকে ইয়াজিদ নামে এক নিষ্ঠুর বাদশা ছিলেন। ইসলামিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি ছিলেন মানবতার শত্রু। তার অভিসন্ধি ছিল মহানবী মুহাম্মদ-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসেন যেন সদলবলে ইয়াজিদের পক্ষে যোগদান করেন। কিন্তু হুসেন ইয়াজিদের এই প্রস্তাবে রাজি হননি।

অন্যদিকে অত্যাচারী ইয়াজিদের প্রজারা হুসেনকে সেই অত্যাচারের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য অনুরোধ করে। এমতাবস্থায় হুসেন ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তবে মহরম মাসের ১০ তারিখে প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে হিংসা ও রক্তপাত নিষিদ্ধ ছিল। আল্লাহর প্রবল বিশ্বাসী হুসেন এই ১০ মহরমের সকালে ইরানের রাজধানী বাগদাদ থেকে একশো কুড়ি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কারবালার প্রান্তরে নামাজে বসেন।

সেই সময়ই ইয়াজিদের সেনারা তার দিকে তির ছুড়তে থাকে। হুসেনের সকল সঙ্গীরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে হুসেনের গায়ে তীরের আঘাত লাগার আগে তার সঙ্গীরা শহীদ হন। এই সকল শহীদদের মধ্যে হুসেনের ৬ মাসের ছেলে আলী অসগর এবং ১৮ বছর বয়সী আলী আকবরও ছিল।

সবার শেষে ৭২ জন সঙ্গী মারা যাবার পর মহানবীর দৌহিত্র হুসেন শহীদ হন। কারবালার প্রান্তরে এই হত্যালীলায় হুসেনের পুত্র জয়নাল আবেদীন ছাড়া পুরো পরিবার শহীদ হয়েছিল। মুসলমানদের কাছে পরম শোকের এই ঘটনাটিকে পালন করার উৎসবের নামই মহরম।

মহরম পালনের রূপ:

মহরম কোন আনন্দের উৎসব নয়। মহরমের দিন শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানরা কালো পোশাক পড়ে হুসেন ও তার পরিবারের শাহাদাতকে স্মরণ করেন। ধর্মপ্রেমী বেশিরভাগ মুসলিমরা এই দিন রোজা পালন করেন, নামাজ পড়েন, কোরান পাঠ করেন, দীন দুঃখী ও দরিদ্রদের দান এর মাধ্যমে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

প্রতিবছর নানান রূপে নানানভাবে মহরম পালিত হয়। নানান জারি গান শোনার প্রথা মহরমের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।। এই গান যুগ যুগ ধরে এর করুন সুরের বন্ধনে মধ্যপ্রাচ্য–বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গকে একই শক্তিতে বাঁধতে সক্ষম হয়েছে। মহরম শেষের আগের দিন সারারাত ধরে এই জারি গান শোনেন সকল ইসলামীরা।

পাড়ায় পাড়ায় হুসেনের কবরের প্রতীকী কফিন নিয়ে সুসজ্জিত তাজিয়া সহকারে বেরোয় মহরমের মিছিল। নিজেদের আঘাত করে তারা অনুভব করতে চায় হুসেনের মৃত্যু যন্ত্রণা। ইসলামে কথিত আছে মহরমের একদিনের মূল্য মোট ৩০ দিন।

মহরম-এর সামাজিক গুরুত্ব:

পৃথিবীর যেকোন অন্যান্য উৎসব এর মতই মহরমের বিশেষ সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে একই দিনে শোক পালনের মতন অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয় নিয়ে একটি গোটা উৎসব পালনের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব বোধ গড়ে ওঠে।

বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা এই উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে আরো দৃঢ় হয়। তাছাড়া এই দিনটি পালনের মাধ্যমে মুসলিমরা নিজেদের একটি কলঙ্কিত ইতিহাসকে বারবার স্মরণ করে। কথায় আছে ইতিহাসকে মনে না রাখলে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলা যায় না। মহরম পালনের মাধ্যমে ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের সঙ্গে সমগ্র মুসলিম সমাজের যোগসুত্র স্থাপিত হয়। এই যোগসূত্রের মাধ্যমে আদপে মুসলমান সমাজই উন্নতির ফল লাভ করে।

মহরম-এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব:

সামাজিক গুরুত্বের পাশাপাশি মহরম উৎসবের বিশেষ অর্থনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে। মহরম উৎসবকে কেন্দ্র করে একই জায়গায় অসংখ্য মানুষের জনসমাগম হওয়ার ফলে মানুষে মানুষে পারস্পারিক বন্ধনের যেমন উন্নতি ঘটে, তেমনি পারিপার্শ্বিক অর্থনৈতিক চরিত্রের ক্ষেত্রেও উন্নতি সাধিত হয়।

মহরমের বিখ্যাত তাজিয়া তৈরীর জন্য অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান ঘটে। এছাড়া যে সমস্ত ইসলামিক দেশগুলিতে মহরম আরো বেশি ঘটা করে পালন করা হয় সেই সব দেশে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ব্যবসার ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে থাকে।

মহরম এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব:

সামাজিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি মহরমের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব সম্ভবত সর্বাধিক। মহরমকে কেন্দ্র করে যে তাজিয়া বার হয়, তা তৈরি বর্তমানে একটি বিশেষ শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। তাছাড়া মহরমের উৎসব উপলক্ষে প্রচলিত জারি গান বর্তমানে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও সম্মানিত হয়েছে।

এছাড়া একটি দিনে একজন মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে সকল মুসলমানের এই শোক পালন উপলক্ষে একত্রিত হওয়ার প্রথা এই উৎসবকে একটি নিজস্ব স্বকীয় সাংস্কৃতিক চরিত্র দান করে। 

উপসংহার:

মুসলিমদের ইতিহাসে একটি সুন্দর নিরব প্রতিরোধের মিলন উৎসব রূপে মহরম পালিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই উৎসবে শহীদ হুসেনের উদ্দেশ্যে সহমর্মিতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে নিরব শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বিশ্বনবী মুহাম্মদের অনুগামীরা। মহরম শব্দের অর্থ পবিত্র বা সম্মানিত।

সত্যিকারের একজন মুসলিম মনে করেন কারবালার প্রান্তরে সেই দিন যে ঘটনা ঘটেছিল তার ফলে আসলে মহানবীর দৌহিত্র হুসেন পবিত্র জান্নাতে স্থান পেয়েছেন। কিন্তু তবুও তার অনুগামীরা এই দিনে এই নৃশংস ঘটনার শোকে বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের শরীরে আঘাত করে থাকে। তবে কোনরকম শক্তি প্রদর্শন বা কারোর মনে ভয়ের উদ্রেক করা এই দিনের লক্ষ্য নয়। শুধুমাত্র নীরব ভাবে একাত্ম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করাই মহরম উৎসবের একমাত্র উদ্দেশ্য।


মহরম রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান। আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম আমাদের কমেন্ট করে জানান। দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো। সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন