পতাকা কোনো গোষ্ঠী, জাতি, সংগঠন, দেশ বা দলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সমস্ত স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকা হল সেই দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতীক। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের ভারতবর্ষেরও জাতীয় পতাকা আমাদের এই দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে প্রকাশ করে। আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় আমাদের জাতীয় পতাকা/ভারতের জাতীয় পতাকা-রচনা।

সূচি তালিকা
ভূমিকা:
কোন একটি দেশের জাতীয় পতাকা হল সমগ্র পৃথিবীর কাছে সেই দেশটির মর্যাদার প্রতীক। কোন একটি জাতীয় পতাকাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একবার দেখা মাত্র সংশ্লিষ্ট দেশটি সম্পর্কে প্রাথমিক পরিচিতি বা ধারণা জন্মায়। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরেও জাতীয় পতাকা এক মহান আবেগের পরিচায়ক। এই আবেগ হলো জাতীয়তার আবেগ।
কোন একটি জাতির একটি জাতীয় পতাকার একই নিশান তলে একত্রে সমবেত হওয়া সমাজে ঐক্যতার বার্তা বহন করে। সেজন্যেই প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন রাজা মহারাজারা নিজেদের অধিকৃত অঞ্চলে একটি পতাকার এক নিশানের স্থাপনা করতেন। সময়ের সাথে সাথে সেই পতাকাই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভবের পর জাতীয় পতাকা হয়ে দাঁড়ায়।
আমার দেশের জাতীয় পতাকা:
আমার দেশ ভারতবর্ষ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র। এই সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের জাতীয় পতাকাটি পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম সুন্দর এবং গভীর অর্থপূর্ণ একটি জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এই পতাকাটি আন্তর্জাতিক বিশ্বে ভারতবর্ষের গৌরব তথা মর্যাদার প্রতীক। ভারতের জাতীয় পতাকার তিনটি রং। ওপরে গাঢ় গৈরিক বর্ণ, মাঝে সাদা, নীচে আছে সবুজ রং।
সাদা রং -এর মাঝখানে বর্তমান ঘন নীল রঙের চব্বিশটি দণ্ডযুক্ত এক “অশোকচক্র”। জাতীয় পতাকার প্রত্যেকটি রং এবং চিহ্ন ভারতবর্ষের এক একটি প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ভাবধারার প্রতীক। পতাকার উপর থেকে শুরু করে প্রথমে গৈরিক বর্ণ ত্যাগ, বৈরাগ্য ও সাহসিকতার প্রতীক। মাঝে সাদা রং শান্তি ও সত্যের প্রতীক। সবুজ রং বিশ্বাস ও প্রাণ তথা প্রাচুর্যের ইঙ্গিত বহন করে।
সাদা রং -এর মাঝখানে ঘন নীল রঙের চব্বিশটি দণ্ডযুক্ত “অশোকচক্র” হল ন্যায়, ধর্ম ও প্রগতির প্রতীক । ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই স্বাধীন ভারতবর্ষের আত্মপ্রকাশের অব্যবহিত পূর্বে ভারতীয় গণপরিষদ কর্তৃক ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা অনুমোদিত হয় ।
ভারতের জাতীয় পতাকার ইতিহাস:
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারত ছিল ব্রিটিশ শাসকের অধীনতার নাগপাশে বন্দি। সেই সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে সাধারণভাবে বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের শাসকেরা প্রাচীন প্রথা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন নকশার একাধিক পতাকা ব্যবহার করতেন। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে ভারত প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে এলে ভারতের তদনীন্তন ব্রিটিশ শাসকবর্গ একক ভারতীয় পতাকার ধারণাটি প্রথম উত্থাপন করেন।
পাশ্চাত্য হেরাল্ডিক আদর্শে নির্মিত স্টার অফ ইন্ডিয়া ছিল কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া সহ অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশের পতাকাগুলির সমরূপীয়। ব্লু ও রেড এনসাইন পতাকাদুটির ঊর্ধ্ব-বাম কোয়াড্র্যান্টে থাকত ইউনিয়ন ফ্ল্যাগ এবং দক্ষিণার্ধ্বের মধ্যভাগে রাজমুকুট-বেষ্টিত একটি “স্টার অফ ইন্ডিয়া”।
স্টারটি যে “ভারতীয়ত্ব”-এর প্রকাশক, তা বোঝাতে রানি ভিক্টোরিয়া তাঁর ভারতীয় প্রজাবর্গের প্রতিনিধিস্বরূপ সাম্রাজ্যের জন্যে “নাইট কম্যান্ডার অফ দি অর্ডার অফ দ্য স্টার অফ ইন্ডিয়া” নামে একটি পদ সৃষ্টি করেছিলেন। এরপর সকল দেশীয় রাজ্য বিকৃত রেড এনসাইন উড্ডীয়নের অধিকার সহ ইউরোপীয় হেরাল্ডিক মাপকাঠি-সম্মত প্রতীকসহ পতাকা লাভ করে।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ভারতের পতাকা:
পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন দেশের মত ভারতবর্ষের একটি জাতীয় পতাকা আছে। ভারতে প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন বাহাদুর শাহ জাফর। ১৮৫৭ সালে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি এই পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পতাকাটি ছিল সবুজ রঙের। তার উপরে ছিল সোনালি রঙের পদ্ম। এরপর ভগিনী নিবেদিতা ১৯০৫ সালে লাল রঙের উপর পতাকা নক্সা তৈরি করেছিলেন।
পতাকার চারিধারে ১০৮ টি শিখা ছিল। মাঝখানে ছিল হলুদ রঙের বজ্র। বজ্রের বামদিকে বাংলাতে লেখা ছিল ‘বন্দে’ আর ডানদিকে লেখা ছিল ‘মাতরম’। এরপর ১৯০৭ সালে মাডাম ভিকাজি রুস্তম কামা বিদেশের মাটিতে প্রথম ভারতের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলে। ১৯১৭ সালে শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত এবং বাল গঙ্গাধর তিলক একটি নতুন পতাকার কথা ভেবেছিলেন।
এরপর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজী কংগ্রেসের সম্মেলনে সর্বপ্রথম একটি সর্বভারতীয় পতাকা তৈরি কথা বলেন। এরপরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে যে পতাকাটি তৈরি হয় সেটির উপর দিক থেকে তিনটি রঙ আড়াআড়ি ভাবে তিনটি সমান ভাগে ভাগ করা ছিল। রঙ গুলি ছিল সাদা, সবুজ, লাল। এর মাঝখানে রেখা আঁকা ছিল।
আজকের জাতীয় পতাকা:
ভারতের বর্তমান তিরঙ্গা জাতীয় পতাকাটির নকশাকার আসলে কে তা নিয়ে ইতিহাসে বিতর্ক রয়েছে। ১৯২১ সালে কংগ্রেস সম্মেলনে গান্ধীজীর প্রস্তাবের পর একটি সর্বভারতীয় পতাকা তৈরীর উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। যতটুকু জানা যায় তা হল সেই কমিটিতে থাকা অন্ধ্র অঞ্চলের কংগ্রেস কর্মী পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া ভারতের বর্তমান জাতীয় পতাকাটির বাহ্যিক নকশাটি তৈরি করেন।
এই নকশা অনুযায়ী পতাকাটি রঙে, আকারে ও আয়তনে বর্তমান ভারতের জাতীয় পতাকার মতো হলেও এর মাঝে আজকের অশোক চক্রের বদলে ছিল চরকা। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দলীয় পতাকা ছিল এটিই। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি জহরলাল নেহেরু অধুনা পাকিস্তানের লাহোরে রবি নদীর তীরে সর্বপ্রথম এই তেরঙা পতাকা উত্তোলন করেন।
জাতীয় পতাকা এবং স্বাধীনতা:
এরপর ১৯৪৬ সাল নাগাদ ব্রিটিশরা ভারতকে স্বাধীনতা দেবার কথা ঘোষণা করলে স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্র তৈরীর উদ্দেশ্যে গণপরিষদ নামে এক অস্থায়ী কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির কাছে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে এক অধিবেশনে জহরলাল নেহেরু প্রস্তাব রাখেন পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়ার নকশাকৃত ওই তেরঙ্গা পতাকাটিকে সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে ভারতের জাতীয় পতাকা রূপে গ্রহণ করা হোক।
এই জাতীয় পতাকার মাঝখানে চরকার বদলে থাকবে অশোক স্তম্ভে থাকা চব্বিশটি দন্ড যুক্ত অশোক চক্র। ওই মাসেরই ২২ তারিখ গণপরিষদে জহরলাল নেহেরুর এই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাত্রে ভারতের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকাটি সর্বপ্রথম উত্তোলন করেন।
জাতীয় পতাকার ঐতিহ্য:
প্রত্যেকটি দেশের জাতীয় পতাকা সেই দেশের ইতিহাসের ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে চলে। স্বভাবতই ভারতের জাতীয় পতাকাও তার ব্যাতিক্রম নয়। ভারতের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় পতাকা ভারতীয় জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে’।
এছাড়াও ভারতের যে বীর সেনানীরা স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রামে তাদের জীবন বলি দিয়েছেন তাদের প্রতি চূড়ান্ত সম্মান প্রদর্শন করে আমাদের এই জাতীয় পতাকা। তাছাড়া বর্তমানে এই জাতীয় পতাকা হল আন্তর্জাতিক বিশ্বে ভারতের মহান প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রধান পরিচায়ক। তদুপরি ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণের জীবনাদর্শের ঐতিহ্যকেও বহন করে নিয়ে চলে এই তেরঙ্গা।
আমাদের জীবনে জাতীয় পতাকা:
ভারতবর্ষের প্রতিটি নাগরিকের জীবনে এই জাতীয় পতাকার এক বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। ছোটবেলায় শিশুরা যখন দেশ প্রকৃত মর্মার্থ বোঝেনা, তখন তাদের কাছে এই জাতীয় পতাকাই দেশের পরিচায়ক হয়ে ওঠে। প্রত্যেক বছর ১৫ ই আগস্ট দেশের স্বাধীনতা দিবসে এবং ২৬শে জানুয়ারি দেশের প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি স্কুলে এই পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দেশপ্রেমের সঙ্গীত ধ্বনিত হয়।
এরই সাথে যখন ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত “জন গন মন” গাওয়া হয়ে থাকে তখন গায়ে কাঁটা দিয়ে চোখে জল আসতে বাধ্য। ভারতের এই ত্রিরঙ্গা জাতীয় পতাকা, যে কোন ভারতবাসীর জন্য জীবনের চেয়েও অধিক মূল্যবান। ভারতের এই জাতীয় পতাকাকে ভিত্তি করেই দেশেবিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে।
উপসংহার:
স্বাধীন ভারতবর্ষের গৌরবজ্বল উপাখ্যানের অন্যতম ধারক ও বাহক গণতান্ত্রিক ভারতের জাতীয় পতাকা। জাতীয় পতাকার মধ্যে লুকিয়ে থাকে দেশ তথা জাতির জন্য অগণিত ভারতবাসীর অপরিমেয় আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনী। ভারতের সার্বভৌমত্ব, গৌরব, জাতীয়তা আর মহান আত্মত্যাগ মিশে রয়েছে তিরঙ্গা জাতীয় পতাকায়।
ভারতীয় সংবিধান অনুসারে জাতীয় পতাকার ব্যবহার সর্বদা “মর্যাদা, আনুগত্য ও সম্মান” সহকারে হওয়া উচিত। এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের কর্তব্য হলো জাতীয় পতাকা তথা দেশের মর্যাদা নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও রক্ষা করা।
আমাদের জাতীয় পতাকা/ ভারতের জাতীয় পতাকা রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন:
আমাদের দেশ (ভারতবর্ষ)
খুবই ভালো লাগল।
খুবই ভালো লাগল।