বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা রচনা [সঙ্গে PDF]

বিদ্যালয় জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার। তবে আধুনিক সমাজে গ্রন্থ পাঠের প্রচলন ক্রমশ কমে আসায় বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। তাই আজকের প্রবন্ধ আলোচিত হবে একটি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা ঠিক কি। তাছাড়া কিভাবে একটি বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়ের উপরও সাধ্যমত আলোকপাত করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই প্রবন্ধের উপস্থাপনা।

বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

একটি গ্রন্থাগার হলো গ্রন্থের আগার; অর্থাৎ গ্রন্থ যে পরম আশ্রয়ে বন্দি হয়ে থাকে। আর আমরা সবাই জানি গ্রন্থের পাতায় পাতায় ছত্রে ছত্রে শব্দের বন্ধনীতে বাধা পড়ে থাকে জ্ঞান। সেই জ্ঞান গ্রন্থের মাধ্যমে পাঠকের চিন্তায় মুক্তি লাভ করে। অন্যদিকে বিদ্যালয় হল বিদ্যার আলয় বা যে গৃহ একান্তই বিদ্যার আশ্রয়ের জন্য নিবেদিত। এখন জ্ঞানের সাথে বিদ্যার যোগাযোগ অত্যন্ত নিবিড়।

গ্রন্থের পাতায় বাঁধা পড়া জ্ঞান মনের অন্তঃস্থলে সার্থকভাবে উপবেশন করলে প্রকৃত বিদ্যা লাভ হয়। সে কারণেই বিদ্যার দেবী সরস্বতীর চরণে আমরা জ্ঞানের আধাররূপে গ্রন্থ গুলি নিবেদন করে থাকি। সেই বিদ্যার একান্ত স্থান যে গৃহে, সেখানে জ্ঞানের আধার রুপে গ্রন্থের সমাবেশ হওয়া পরম বাঞ্ছনীয়। আর এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা।

গ্রন্থাগারের গুরুত্ব:

বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় প্রবেশ করবার পূর্বে গ্রন্থাগারের সার্বিক গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবগত হওয়া প্রয়োজন। ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে গ্রন্থাগার হলো গ্রন্থের আগার। একটি সমাজে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যে কোন চিন্তাশীল মানুষ তার সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায় গ্রন্থের পাতায়। একটি গ্রন্থাগার মানুষকে তার জীবনের দিকনির্দেশনায় সাহায্য করে। ব্যক্তি মানুষের প্রতি এই সাহায্য বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে সামাজিক মানোন্নয়নের রূপ পায়। গ্রন্থাগার হল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলিল।

এইখানে মানুষের চিন্তা, দর্শন, গবেষণা, ইতিহাস একত্রে স্থান পায়। প্রতিটি গ্রন্থাগার ফিরে আসা যুগের মানুষের জীবন দর্শনের সাক্ষ্য বহন করে। সেই সকল দর্শন, ইতিহাস তথা গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই মানুষ এক সুন্দর বর্তমানকে নির্মাণের পথে অগ্রসর হয়। অতীতকে বিস্তৃত হলে বর্তমান সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে পারে না। গ্রন্থাগার সেই অতীতের সাথে বর্তমানের একটি সুষম সেতু রচনা করে। ফলে রক্ষিত হয় মানুষের ঐতিহ্য, সভ্যতার ইতিহাস, ঐতিহাসিক চিন্তাসমূহ এবং গড়ে ওঠে বর্তমান ও ভবিষ্যতের নতুন মুক্ত ভাবনা।

বিদ্যালয় ও গ্রন্থাগার:

বিদ্যালয়ের সঙ্গে গ্রন্থাগার এর সম্পর্ক সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে। মানুষ যখন বিদ্যার প্রসারের নিমিত্ত বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল তখন সে বিদ্যালয় এর পাশাপাশি গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেছিল। এই উপলব্ধি থেকেই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গ্রন্থাগারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। ইতিহাসে অসংখ্য উদাহরণ দেখা যায়। প্রাচীন ভারতবর্ষের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাব যে সকল বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সমকালীন ভারত বর্ষ তথা সমগ্র বিশ্বের উন্নত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল সেই সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছিল নির্দিষ্ট গ্রন্থাগার।

সেই সকল গ্রন্থাগারগুলি সমৃদ্ধ ছিল বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখিত নানা পুঁথি দ্বারা। এ প্রসঙ্গে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। এরপর আধুনিক যুগে স্বাধীন ভারতবর্ষে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গ্রন্থাগার তৈরীর জন্য সরকারের তরফে বিশেষ উদ্যোগ গৃহীত হয়। ফলে দেশজুড়ে প্রায় সকল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই গড়ে ওঠে ছোট-বড় গ্রন্থাগার।

বিদ্যালয় গ্রন্থাগার; ইতিহাসের সংগ্রহশালা:

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গ্রন্থাগারগুলি সময়ের সাথে সাথে হয়ে উঠেছে জীবন্ত ইতিহাসের সংগ্রহশালা। প্রাচীন বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সেই সুদূর অতীতকাল থেকে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য গবেষণা তথা চিন্তার অনুশীলন হয়ে আসছে। এই সকল স্থান থেকেই উঠে এসেছেন উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন চিন্তাবিদেরা। তাদের লিখিত গবেষণাপত্র কিংবা চিন্তার দলিলগুলি সাধারণত সংরক্ষিত হয়ে থাকে এই সকল বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গ্রন্থাগারেই।

এছাড়াও বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে নানা মূল্যবান এবং কখনো কখনো দুষ্প্রাপ্য বিভিন্ন গ্রন্থ সংগ্রহ করে বিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সেগুলিকে স্থান দেয়। এই সকল গ্রন্থগুলিতে অতীত অমর হয়ে থাকে, বাধা পড়ে থাকে সময়। তাই গ্রন্থাগারগুলির দরজা খুলে এই সকল গ্রন্থের পাতা উল্টালে ইতিহাস পাঠকের কাছে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়।

পঠন পাঠন ও সহায়ক:

বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় হল জ্ঞানচর্চার মন্দির স্বরূপ। পঠন-পাঠনই এখানে পূজার মন্ত্র। বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলি এই পঠন-পাঠনে শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রী উভয়কেই সহায়তা করে থাকে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ক্ষেত্রে তারা যদি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের সময় কোন প্রকার প্রশ্ন কিংবা অসুবিধার সম্মুখীন হন তাহলে তারা সাহায্য নিয়ে থাকেন বিদ্যালয় গ্রন্থাগারের। তাছাড়া প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে শিক্ষাদানের জন্য প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকা সমকালীন বিশ্ব, আধুনিক গবেষণা তথা চিন্তাবলীর সাথে পরিচিত থাকতে হয়।

এক্ষেত্রেও ঐতিহ্যগতভাবে বিদ্যালয় গ্রন্থাগারই তাদের সাহায্য করে থাকে। আবার অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও পঠন পাঠনের সময় কোন নির্দিষ্ট গ্রন্থের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলে তারা গ্রন্থাগারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। এছাড়া বিদ্যালয় কিম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে গুলো প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের বিষয় অনুযায়ী নির্দিষ্ট গ্রন্থ দ্বারা সহায়তার জন্য প্রস্তুত থাকে। এই ভাবেই বিদ্যালয় গ্রন্থাগার তার শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পঠন পাঠনে সহায়তা করে চলে।

ছাত্র-শিক্ষকদের বিদ্যালয় বিনোদন:

বর্তমান যুগে সকলের বিনোদনের উপাদান হিসেবে উঠে এসেছে বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যম। কিন্তু ইতিপূর্বে যখন সমাজে এই সকল আধুনিক ডিজিটাল বিনোদনের প্রচলন ঘটেনি, তখন নানা বিষয়ের উপর লিখিত আকর্ষণীয় গ্রন্থাদিই ছিল মানুষের প্রধান বিনোদনের উপাদান। সেই সময় ছাত্র কিংবা শিক্ষকেরা বিদ্যালয় গ্রন্থাগার থেকে বিভিন্ন প্রকার বিনোদনমূলক গ্রন্থ সংগ্রহ করে পড়তেন।

সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে এখনো বিদ্যালয় গ্রন্থাগারগুলি বিভিন্ন প্রকার গল্পের বই, কবিতার বই, ভ্রমণ কাহিনী কিংবা উপন্যাসের ডালি সাজিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে উপস্থাপন করে থাকে। যদিও গল্পের বই পড়ার পড়ার প্রচলন বর্তমান যুগে ক্ষীণ হয়ে এসেছে, তবুও বিদ্যালয় গ্রন্থাগার থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন মজার মজার গ্রন্থের মাধ্যমে বিনোদনের মাধুর্য এতটুকুও ক্ষীন হয়নি।

মানসিক উন্নতির সহায়ক:

একটি বিদ্যালয় গ্রন্থাগার তার ছাত্রছাত্রী তথা শিক্ষকদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ের উপর অসংখ্য গ্রন্থের ডালি সাজিয়ে নিয়ে বসে। এই সকল গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জ্ঞান লাভ হয়; আর আমরা সবাই জানি জ্ঞান মানুষের মনকে পরিণতির শিখরে নিয়ে যায়। তাই একটি বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার একইসঙ্গে বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞানের আলোকে যথাসম্ভব সার্থকভাবে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে।

সে কারণে কোন বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার যত বেশি সমৃদ্ধ, সেই বিদ্যালয়ের জ্ঞানের ভান্ডার ততই বেশি সমৃদ্ধ। সর্বোপরি একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার সম্পন্ন বিদ্যালয় সর্বদা একটি উন্নত মানসিকতা সম্পন্ন ছাত্রসমাজ ও শিক্ষকমন্ডলীর স্বাক্ষর বহন করে। সে কারণে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বিদ্যালয় গ্রন্থাগার গুলি একই সঙ্গে অনেক মানুষের মানসিক উন্নতিতে সহায়তা করে থাকে।

উপসংহার:

পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্রমবর্ধমানতার যুগে বিদ্যালয় গ্রন্থাগারের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল বিপ্লবের কালেও গ্রন্থাগারের প্রাসঙ্গিকতাকে তাই কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। মানুষের জীবন গঠনকারী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো জ্ঞান। সেই জ্ঞানের আকর হল গ্রন্থ। আর অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা হল আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎ।

সেই ভবিষ্যতকে যদি আমরা জ্ঞানের আকর থেকে দূরে সরিয়ে রাখি তাহলে একটি প্রগতিশীল সমাজ কোন দিন গড়ে উঠতে পারবে না। কারণ গ্রন্থাগার হলো মহামানবের পবিত্র মিলনতীর্থ, যেখানে জ্ঞান, তথ্য ও মানুষের অন্তরাত্মার অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রন্থাগার সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন-

“এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃংখলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।”


বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উপরিউক্ত এই প্রবন্ধে একটি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে বিতর্ক গুলিকে মাথায় রেখে যুক্তি সম্মতভাবে বিভিন্ন দিককে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হলো।

 আশা করি এই প্রতিবেদনটি আপনাদের ভাল লেগেছে। উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন