বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালি রচনা [PDF]

বাঙালি জাতির মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষার প্রবণতা সেই সুদূর অতীতকাল থেকেই তুলনামূলকভাবে অধিক। এই শিক্ষিত বাঙালি জাতির মধ্যে অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত নিয়োজিত রয়েছেন বিজ্ঞান সাধনায়। তারা নিজেদের বিজ্ঞান চেতনা দ্বারা পৃথিবীকে বৈজ্ঞানিক দিক থেকে যেমন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তেমনি সমাজকে সমৃদ্ধ করছেন নিজেদের বৈজ্ঞানিক চেতনা দ্বারা। বিজ্ঞান সাধনায় বাঙ্গালীদের অবদানের কথা স্মরণ করার উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের আজকের এই প্রতিবেদনের উপস্থাপনা।

বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালি রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা…

সে দেশ আমার প্রাণের প্রিয় জন্মভূমি মহান ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষ যুগে যুগে সমগ্র বিশ্বকে নানা নতুন পথের দিশা দেখিয়েছে, দিয়েছে বিজ্ঞানের নানা অমৃত রূপের সন্ধান। ভারতবর্ষের বুকেই যুগে যুগে বিকশিত হয়েছে শত জ্ঞান পুষ্প, জ্বলে উঠেছে জ্ঞানচর্চার সহস্র আলোকবর্তিকা। এই ভারতবর্ষেরই বুকে একই সাথে একই জাতীয় আবেগের অনুবর্তী অসংখ্য জাতি তথা ততোধিক সংস্কৃতি পাশাপাশি বিরাজমান। এই সকল জাতির মিলিত চেতনার ভারতবর্ষ একসময় জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করেছিল।

বিশ্ব সমাজের কাছে ভারতবর্ষের এই অবদান আজও অক্ষুন্ন। আর যে সকল জাতির কাঁধে ভর করে ভারতবর্ষ বিশ্বের দরবারে এই মর্যাদা লাভ করেছে তাদের মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতি চিরকাল সকল প্রকারের জ্ঞানচর্চায় সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে অগ্রণী হয়ে থেকেছে। আজ এই প্রবন্ধে আমরা বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালি জাতির অবদান সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করব।

বাঙালির শিক্ষা চেতনা ও বিজ্ঞান:

বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা নিয়ে আলোচনার পূর্বে বিজ্ঞান সাধনায় প্রাথমিক শর্ত বাঙালি জাতির সামগ্রিক শিক্ষা চেতনা নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন। সাধারণভাবে সমগ্র পৃথিবী জুড়েই অলস, তর্কবাগীশ, এবং অর্থবিমুখ বলে বাঙালির বদনাম আছে। তবে এই অলস বাঙালি নিজের জীবনে যে জিনিসটিকে বরাবর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে তা নিঃসন্দেহে হলো নিজের শিক্ষা এবং সেই শিক্ষা থেকে উদ্ভূত চেতনা। বিজ্ঞান সাধনার প্রাথমিক পূর্বশর্তই হলো সুশিক্ষার দ্বারা আলোকিত সচেতন মন।

বাঙালি জাতি জন্মের পর মুহূর্ত থেকে নিজেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তোলার চেষ্টা করে। সে কারণেই হয়তো বৈষয়িক সম্পদের মূল্য বাঙালির কাছে গৌণ, বরং শিক্ষার আত্মিক সম্পদই মুখ্য। এই সামগ্রিক শিক্ষা চেতনাই বাঙালির মনকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলেছে। শুধুমাত্র এই চেতনাকে সম্বল করেই যুগে যুগে অসংখ্য বাঙালি নিজেদের ডুবিয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞান সাধনায়।

ইতিহাসে বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা:

ভারতবর্ষে বাঙালি জাতির বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাস একেবারেই নতুন নয়। সেই অতীতকালে যখন সবেমাত্র বাঙালি সংস্কৃতি পৃথিবীর আলো দেখতে শুরু করেছে তখন থেকেই বিখ্যাত চর্যাপদের পদকর্তারা জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। তবে দ্বাদশ শতাব্দীর পরে বাঙালির জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষত রাজনৈতিক কারণে এক অন্ধকারময় যুগ নেমে আসে। এই সময়ে বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা

 সংক্রান্ত নিদর্শন পাওয়া যায় না বললেই চলে। তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যুগে ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র হওয়ার কারণে বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে জোয়ার আসে। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষা সরকারি ভাবে প্রচলিত হলে মানুষ ইউরোপে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলির ব্যাপারে অবগত হয়। সেই সকল পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সঙ্গে সনাতন ভারতীয় জীবনবোধের মিশেলে সৃষ্টি হয় স্বকীয় ঐতিহ্য সম্পন্ন বাঙালি বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি। 

জীব এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণায় বাঙালি:

 বাঙ্গালীদের জীব বিদ্যা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণার আলোচনায় সন্দেহাতীতভাবে সর্বপ্রথম যে নামটি উঠে আসে জগদীশচন্দ্র বসু। এই কৃতি সন্তান বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তারমধ্যে একটি হল জীববিদ্যা। জগদীশ বসুর গবেষণার মুখ্য বিষয় ছিল উদ্ভিদবিজ্ঞান। পদার্থবিজ্ঞানে তার অসামান্য দক্ষতা থেকে ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করে সেই যন্ত্র দ্বারা তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে উদ্ভিদ উত্তেজনায় সাড়া দিতে পারে। এছাড়াও ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলার বুকে জীব বিদ্যা সংক্রান্ত অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বাঙালি বিজ্ঞানীরা একের পর এক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছেন।

সমাজের সকল নিষেধ অগ্রাহ্য করে ভারতবর্ষের প্রথম শবদেহ ব্যবচ্ছেদ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছিল একজন বাঙালি বিজ্ঞানীর হাত ধরেই। এছাড়া বাঙালি বিজ্ঞানীরাই বিভিন্ন ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক আমলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। বর্তমানেও অসংখ্য বাঙালি চিকিৎসক তথা জীববিদ্যা বিশারদরা সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য গবেষণা কার্যে নিয়োজিত আছেন।

পদার্থবিজ্ঞানে বাঙালি:

ভারতবর্ষে পদার্থ বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রেও বাঙালি বৈজ্ঞানিকদের অবদান অনস্বীকার্য। পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে বিশেষভাবে গবেষণা করা বাঙ্গালীদের কথা উল্লেখ করতে গেলে প্রাথমিকভাবে উঠে আসে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখদের নাম। বাংলার উজ্জ্বল পদার্থ বৈজ্ঞানিকদের আকাশে এনারা হলেন সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর গবেষণার কথা সমগ্র বিশ্ব বিদিত। পদার্থবিজ্ঞানে বিশ্বের দরবারে বৈজ্ঞানিক মহলে তার তুলনা করা হয় বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে।

এই দুই প্রবাদপ্রতিম বৈজ্ঞানিকের দেওয়া বোস-আইনস্টাইন থিওরির উপর ভিত্তি করে বর্তমানেও অসংখ্য পদার্থ বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা আবর্তিত হয়। অন্যদিকে নভোবস্তুবিদ্যায় ভারতবর্ষের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী হলেন মেঘনাদ সাহা। তার আবিষ্কৃত আয়োনাইজেশন সমীকরণ নক্ষত্রের রাসায়নিক উপাদানের ব্যাখ্যা দান করতে বিশ্বব্যাপী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাহায্য করেছে। এছাড়াও বাংলার বুক থেকে উঠে এসেছে লীলাবতী ভট্টাচার্য, অর্চনা ভট্টাচার্য, বিভা চৌধুরী, তনুশ্রী সাহা মহিলা পদার্থবিজ্ঞানীদের নাম। এরা ছাড়াও নাম না জানা অসংখ্য বাঙালি বিজ্ঞানীরা সমগ্র পৃথিবী জুড়ে পদার্থবিজ্ঞানের সেবায় নিয়োজিত আছেন।

রসায়নবিদ্যা ও বাঙালি:

রসায়ন সংক্রান্ত গবেষণায় বাঙালির অবদানের কথা বলতে গেলেই সর্বপ্রথম উঠে আসে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় -এর নাম। তিনি সম্ভবত ভারতবর্ষে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রসায়নবিদের মধ্যে অন্যতম। সমগ্র জীবন ব্যাপী রসায়নের বিভিন্ন শাখায় বিস্তারিত গবেষণা ছাড়াও আচার্য রায় বিজ্ঞানকে কিভাবে সমাজসেবার কাজে লাগানো যায় সে ব্যাপারে অসংখ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে গিয়েছেন। কার কাছে বিজ্ঞান ছিল সমাজসেবার যন্ত্র স্বরূপ। তার হাত ধরেই স্থাপিত হয়েছিল বাংলার গর্ব বেঙ্গল কেমিক্যাল। তিনি ভারতবর্ষে রসায়ন বিদ্যার জনক নামে পরিচিত।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছাড়াও বাংলার একজন অপর গুরুত্বপূর্ণ রসায়নবিদ হলেন স্যার জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। বাংলায় রসায়ন বিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণার বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা করা, শিল্প ও প্রযুক্তিগত উন্নতি সংক্রান্ত রসায়ন গবেষণা ইত্যাদির কারণে বাংলা তাকে চিরকাল মনে রাখবে। বাংলার অন্য কয়েকজন উল্লেখযোগ্য রসায়নবিদ হলেন চারুসিতা চক্রবর্তী, সরলা রায়, চিত্রা মন্ডল প্রমূখ। 

বাঙালির প্রযুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি:

সাধারণভাবে প্রচলিত বিজ্ঞানের শাখা গুলি ছাড়া প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাঙালি বৈজ্ঞানিকদের অবদানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এ প্রসঙ্গে কোন একটি নাম যথেষ্ট হবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বর্তমানে পৃথিবীতে কর্মরত প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে একটি বিরাট সংখ্যক বাঙালিরা রয়েছেন। তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাঙ্গালীদের আগ্রহ তো পৃথিবীতে সর্বজনবিদিত। ভারতের সিলিকন ভ্যালি নামে পরিচিত ব্যাঙ্গালোরে কর্মরত মানুষদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন বাঙালি। অন্যদিকে এই বাংলায় পৃথিবীর নামজাদা বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা গুলির উচ্চপদে গুরু দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত আছেন। 

উপসংহার:

বিজ্ঞানের প্রতি এই আগ্রহ এবং ভালোবাসাই বাঙ্গালীদের সকল দোষের ঊর্ধ্বে তুলে একটি বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি দান করেছে। দীর্ঘদিনের চর্চা এবং শিক্ষার ফলে বিজ্ঞান শুধু বাঙালির কর্মেই নয়, স্থান পেয়েছে মননেও। এই বৈজ্ঞানিক মনন শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে দান করেছে একটি স্বকীয় অনন্যতা। এই অনন্যতাতেই বাঙালি জাতির কাছে বৈষয়িক সম্পদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শিক্ষার সম্পদ তথা জ্ঞান। বিজ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত মানুষেরা তাই বাঙ্গালী সমাজে পূজিত হন বিজ্ঞানের মহর্ষি রূপে।।


উপরিউক্ত ‘বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালি’ শীর্ষক প্রবন্ধে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সবকটি দিক সম্পর্কে যথাসম্ভব সুসংবদ্ধ ভাবে আলোচনার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া পরীক্ষার প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে উক্ত প্রতিবেদনে নির্দিষ্ট একটি শব্দ সীমা বজায় রাখারও চেষ্টা করা হয়েছে। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।

উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন