নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা [সঙ্গে PDF]

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন খ্যাতনামা নোবেল জয়ী ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন অর্থনীতিবিদ। সম্প্রতি তার নাম আমাদের সকলের মুখে মুখে ঘুরেছে। ভারত যুগে যুগে এমনই সমস্ত বিরল প্রতিভা পৃথিবীকে দান করে এসেছে। ভারতের সন্তান এই যুগান্তকারী প্রতিভার জীবন সম্পর্কে সামান্য আলোকপাতের দুঃসাহস নিয়েই এই প্রতিবেদনটির উপস্থাপনা।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

আমাদের দেশ ভারতবর্ষ সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বজুড়ে বিরল এবং যুগান্তকারী সব প্রতিভার জন্ম দিয়ে এসেছে। ভারতের সন্তান সেইসকল প্রতিভাবান মানুষেরা সময়ের সাথে সাথে জীবনে খ্যাতি অর্জন করেছেন সমগ্র বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর বুকে ভারতের নাম হয়েছে উজ্জ্বল। বর্তমান যুগে আধুনিক বিশ্বেও ভারত তার এই ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রেখেছে।

ভারতের এই সকল প্রতিভাবান ব্যক্তিদের কাঁধে ভর করে জাতীয় গৌরবধ্বজা আজও উড়ে চলেছে স্বমহিমায়। ভারতবর্ষের এমনই অসংখ্য প্রতিভাবান মানুষদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন শ্রী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। নাগরিকত্ব সূত্রে বর্তমানে তিনি মার্কিনী হলেও তার জন্ম এবং শিক্ষাকালীন বিচরণ ক্ষেত্র ছিল এই ভারতবর্ষ। এক কথায় তার পরিচয় হলো তিনি অমর্ত্য সেনের পর অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া দ্বিতীয় বাঙালি।

জন্ম ও পরিবার:

ভারতের এই কৃতী সন্তানের জন্ম ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি মহারাষ্ট্রের মুম্বাই শহরে। তার পিতার নাম ছিল দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা ও মা দুজনেই ছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ। তার পিতা ছিলেন স্বাধীনতা উত্তর ভারতের একজন উল্লেখযোগ্য অর্থনীতিবিদ এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক তথা বিভাগীয় প্রধান।

অন্যদিকে মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতায় অবস্থিত সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশল সাইন্স -এর অর্থনীতি বিভাগের একজন প্রখ্যাত অধ্যাপিকা। ছেলেবেলা থেকেই নিজের পরিবারে অর্থনীতির ব্যাপক চর্চা থাকায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই অভিজিতের ঝোঁকও ছিল অর্থনীতির দিকে। পরবর্তীকালে গবেষণা সংক্রান্ত বিষয় বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি নিজের পরিবারের গবেষণামূলক ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন।

শিক্ষাজীবন:

ছেলেবেলায় জন্মস্থান মুম্বাই থেকে কলকাতা এসে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। সেখান থেকে স্কুলজীবনের পড়াশোনা শেষ করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকেই ১৯৮১ সালে তিনি অর্থনীতিতে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।

এরপর পরবর্তী পড়াশোনার উদ্দেশ্যে অভিজিৎ ভর্তি হন দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর পিএইচডির উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমান। সেইখানে পিএইচডিতে তার গবেষণার বিষয়টি ছিল “এসেস ইন ইনফর্মেশন ইকোনমিক্স”।

কর্মজীবন:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করার পর সেখানেই অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মজীবন শুরু হয়। মার্কিন মুলুকেই বর্তমানে তিনি ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধীনে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থনীতি বিভাগে আন্তর্জাতিক অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। যদিও তার কাজের মূল লক্ষ্য হলো বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন।

তিনি প্রথম এস্তের দুফ্লো, মাইকেল ক্রেমার, সেন্দিল মুলাইনাথান প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে অর্থনীতিতে কার্য সম্বন্ধীয় সম্পর্ক বিষয়ক পদ্ধতি উদ্ভাবনে ফিল্ড এক্সপেরিমেন্টের প্রস্তাব করেছিলেন। এছাড়া তিনি ২০১৩ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের তৎকালীন মহাসচিব বান-কি-মুন কর্তৃক সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বিশেষজ্ঞ প্যানেলে কাজের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এগুলো ছাড়াও সমগ্র জীবনে তিনি অসংখ্য গবেষণা করেছেন।

এছাড়া তৃণমূল স্তর থেকে অর্থনীতি সম্বন্ধীয় ফিল্ড রিসার্চ তার কর্মপদ্ধতির একটি বিশেষ অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে থেকেছে বরাবর। তিনি সাবেকি অর্থনৈতিক ধারণার তুলনায় সাবঅলটার্ন ইকোনমিক্সে বেশি বিশ্বাস করে থাকেন।

ব্যক্তিগত জীবন:

ভারতের কৃতিসন্তান শ্রী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবন আর পাঁচজন কৃতি মানুষের মতনই। ছেলেবেলা থেকে স্বাভাবিকভাবেই তার ধ্যান জ্ঞান ছিল পড়াশোনা। যদিও লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি খেলাধুলা বিশেষভাবে ভালোবাসতেন। এছাড়া ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ বরাবরের। একথা তিনি পরবর্তীতে তার অসংখ্য সাক্ষাৎকারে স্বীকার করে নিয়েছেন

তিনি একথা বলেছেন যে বন্ধুমহলে খেলাপাগল হিসেবে তার বিশেষ পরিচিতি ছিল। এছাড়া জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ক্যাম্পাস রাজনীতির সঙ্গেও তিনি অল্প সময়ের জন্য জড়িয়ে পড়েছিলেন।

এমনকি জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য পিএন শ্রীবাস্তবকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখানোর অপরাধে তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। সেই সময়ে তাকে তিহার জেলে বন্দী রাখা হয়। অল্প কিছুদিন পরই সেখান থেকে তিনি জামিনে মুক্তি পান এবং ছাত্রদের উপর থেকে সমস্ত অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়। 

বিবাহ:

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তার কর্মজীবনের শুরুতে এমআইটি সাহিত্য বিভাগের লেকচারার অরুন্ধতী তুলি বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। যদিও তাদের এই বিবাহ সুখের হয়নি। বেশ কিছুকাল পরে এই দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এই দম্পতির পুত্র সন্তান কবির বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৬ সালে কলকাতা শহরের বুকে একটি পথ দুর্ঘটনায় মারা যান।

প্রথম বহু বিবাহ বিচ্ছেদের বেশ কিছুকাল পর ২০১৫ সালে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ফরাসি অর্থনীতিবিদ এস্তের দুফ্লোকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ করেন। ১৯৯৯ সালে এস্থার এমআইটিতে অর্থনীতিতে পিএইচডি করার সময় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর যুগ্ম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। বর্তমানে অভিজিতের স্ত্রী এস্থার এমআইটির পোভার্টি এলিভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স বিভাগের একজন অধ্যাপিকা পদে কর্মরত আছেন।

প্রাপ্ত সম্মাননা এবং পুরস্কার সমূহ:

সমগ্র কর্মজীবনে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন। ২০০৪ সালে আমেরিকান অ্যাক্যাডেমি অফ আর্টস অন্ড সাইন্স -এর ফেলো হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি লাভ করেন অর্থনীতির সামাজিক বিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে ইনফোসিস পুরস্কার।

২০১২ সালে পুওর ইকনোমিকস বইয়ের জন্য অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্তের দুফ্লো যুগ্মভাবে জেরাল্ড লুয়েব অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০১৪ সালে কিইল ইনস্টিটিউট ফর দা ওয়ার্ল্ড ইকোনমি থেকে অভিজিৎ পান বার্নার্ড হামস পুরস্কার। সর্বোপরি ২০১৯ সালে বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখায় অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্তের দুফ্লো এবং মাইকেল ক্রেমার-এর সঙ্গে একযোগে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

রচিত গ্রন্থাবলী:

সমগ্র কর্ম এবং গবেষণার জীবনে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বহু গ্রন্থ এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তারই মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির নাম এখানে উল্লেখ করা হলো। তার রচিত ‘ভোটেলিটি অ্যান্ড গ্রোথ’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে। ওই বছরেই তার এককভাবে রচিত গ্রন্থ মেকিং এইড ওয়ার্ক ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমআইটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।

২০১১ সালে অভিজিৎ ব্যানার্জি এস্তের দুফ্লোর সঙ্গে যুগ্মভাবে পুওর ইকোনমিক্স গ্রন্থটি রচনা করেন। এর পুরো নাম হল পুওর ইকোনমিক্স: এ রাডিক্যাল থিনকিং অফ দ্যা ওয়ে টু ফাইট গ্লোবাল পভার্টি। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত এই গ্রন্থটি সবচেয়ে খ্যাতি লাভ করেছিল। এছাড়া প্রবাদপ্রতিম এই দুই অর্থনীতিবিদের জুটি যুগ্মভাবে দুটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছে। এখনো পর্যন্ত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত শেষ বইটির নাম এ শর্ট হিস্টরি অফ পোভার্টি মেজারমেন্ট, যেটি ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

উপসংহার:

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতবর্ষের একজন যুগান্তকারী প্রতিভা এবং সর্বোপরি বিশ্বের এক কালজয়ী অর্থনীতিবিদ। সাবেকি অর্থনীতির ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে কিভাবে গোড়া থেকে নতুন করে ভাবতে হয় অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় তা পৃথিবীকে শিখিয়ে দিয়েছেন।

তাছাড়া ব্যক্তিগত স্তরে তার উদার ব্যবহার, আপন মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তাকে বিশ্বজুড়ে সকলের প্রিয় করে তুলেছে। একজন সার্থক অর্থনীতিবিদের মতন খ্যাতি এবং অর্থের মোহকে তুচ্ছ করে বর্তমানে তিনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নতিকল্পে। তাই শুধুমাত্র ভারতবর্ষে নয় সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে তার নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।।


সংক্ষেপে এই ছিল অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন কাহিনী। উপরিউক্ত প্রবন্ধটিতে যথাসম্ভব ব্যাখ্যা সহকারে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় -এর জীবনের মোটামুটি সবকটি দিককে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া পরীক্ষার প্রয়োজন অনুযায়ী উক্ত প্রবন্ধটিতে আমরা একটি সাধারণ শব্দসীমা বজায় রাখারও যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি।

আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে। উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান।

আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন