দুর্নীতি ও তার প্রতিকার রচনা [PDF]

বর্তমানে উন্নয়নের পথে এক বিরাট বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি।আমাদের ভবিষ্যতকে সুন্দর করতে ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে দুর্নীতি প্রতিকার করা খুব দরকার। এ নিয়েই আজকের বিষয় প্রবন্ধ রচনা দুর্নীতি ও তার প্রতিকার

দুর্নীতি ও তার প্রতিকার রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

পৃথিবীতে মানব সভ্যতার মূলধারায় যে কয়েকটি বিশেষ ত্রুটি বা সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো দুর্নীতি। সেই প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সমাজে নীতির পাশাপাশি দুর্নীতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। এই দুর্নীতি সভ্যতার অগ্রগতির পথে প্রতিকূল স্রোতের কাজ করে থাকে।

সমাজের এই অন্যতম ত্রুটিটি মানুষের স্বাভাবিক মূল্যবোধ বিকশিত হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কোনো একটি দেশের দুর্নীতির মাত্রা যত কম, সেই দেশ সমস্ত দিক থেকে সার্বিকভাবে ততটাই উন্নত। তবে এই দুর্নীতি কোন সংকীর্ণ গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। এর মাত্রা মাকড়সার জালের মতই ব্যাপক ও বিস্তৃত।

সভ্যতার অগ্রগতির কথা মাথায় রেখে একটি মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ তৈরি করার ক্ষেত্রে দুর্নীতির দূরীকরণ একান্ত আবশ্যক। তবে সমাজের নিম্নতর স্তর থেকে উচ্চতম স্তর অবধি দুর্নীতির আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। তাই সমাজ থেকে দুর্নীতিকে নির্মূল করতে গেলে এর প্রতিটি স্তর থেকে দুর্নীতির প্রতিকার ঘটাতে হবে। প্রতিদিনকার আমাদের চারপাশের এই জ্বলন্ত সমস্যা নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন।

দুর্নীতির উৎস:

সমাজে দুর্নীতির উৎসকে চিহ্নিত করা একটি অত্যন্ত কঠিন বা দুরূহ কাজ। কারণ দুর্নীতির শাখা-প্রশাখার ব্যাপক বিস্তারের মতন এর উৎসটিও বহুমুখী। তবে দুর্নীতির কোন সম্ভাব্য প্রতিকার খুঁজে সমাজ থেকে এই জ্বলন্ত মূর্তিমান সমস্যাটি নির্মূল করতে গেলে সর্বপ্রথম এর উৎস বা কারণ অনুসন্ধান করা অবশ্য প্রয়োজনীয়।

আধুনিক যুগে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীরা দুর্নীতির উৎস হিসেবে সভ্যতা তথা ব্যক্তিমানুষের কিছু বিশেষ প্রবৃত্তিকে চিহ্নিত করেছেন। সর্বপ্রথম মানুষের মনে দুর্নীতির প্রাথমিক উৎস হিসেবে কাজ করে যে বিশেষ প্রবৃত্তি, তা হল লোভ। সহজে অধিক ভোগের প্রতি আকাঙ্ক্ষা বা লালসা প্রাথমিক স্তরে ব্যক্তিমানুষের মধ্যে দুর্নীতিকে ত্বরান্বিত করে।

তাছাড়া বহু ক্ষেত্রে যথাযথ প্রাপ্তির অভাবকেও দুর্নীতির কারণ হিসেবে সমাজবিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করে থাকেন। অর্থাৎ অনেক সময় মানুষ নিজের যোগ্যতা অনুসারে মর্যাদা না পেলে দুর্নীতিতে লিপ্ত হতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে বাহ্যিক কারণ যাই হোক না কেন, সমাজে দুর্নীতিকে ত্বরান্বিত করার পেছনে মুখ্য ভূমিকা হল মানুষের মূল্যবোধহীনতার। মানুষের মনের ক্ষীণ উৎকর্ষতাই আদপে লোভের মত প্রবৃত্তিকে ডেকে আনে।

ইতিহাসে দুর্নীতি:

মানব সভ্যতার ইতিহাসে দুর্নীতি কোন নবোত্থিত বিষয় নয়। সম্ভবত সভ্যতার আদিম লগ্ন থেকেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির আনাগোনা পরিলক্ষিত হতে থাকে। ইতিহাসের পাতাতেও এর বহু নিদর্শন পাওয়া যায়। সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন দুর্নীতির নিদর্শন পাওয়া যায় আদি মিশরীয় সভ্যতার হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে। মিশরের পিরামিডের দেওয়ালে খোদাই করা লিপি চিত্র থেকে জানা যায় প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় দুর্নীতি করলে কঠোরতম শাস্তি দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল।

অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সভ্যতার আকর গ্রন্থ বেদ ও পুরাণেও দুর্নীতি এবং সেই সংক্রান্ত দন্ডবিধি বিষয়ক কিছু আলোচনা রয়েছে। তাছাড়া প্রাচীন ভারতবর্ষে আমলাতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত গ্রন্থ অর্থশাস্ত্রেও দুর্নীতির প্রকারভেদ, অবনিরীক্ষণ, সংশ্লিষ্ট দন্ডবিধি এবং তার প্রতিকার সংক্রান্ত বিশদ আলোচনা লিপিবদ্ধ রয়েছে।

অন্যদিকে পৃথিবীর অন্য প্রধান অপ্রধান প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থতেই দুর্নীতির উল্লেখ এবং তার প্রতিকারের উপায় সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে আধুনিক যুগে দুর্নীতির পরিধি বহুমুখী রূপ ধারণ করলেও সমাজে এই সমস্যার উদ্ভব নতুন নয়।

দুর্নীতির প্রকারভেদ:

এই প্রতিবেদনটির সূচনালগ্ন থেকেই দুর্নীতির বহুমুখী চরিত্র সম্পর্কে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। এই বহুমুখী চরিত্র বলতে বোঝানো হয় দুর্নীতির বিভিন্ন শাখা প্রশাখা বা প্রকারগুলিকে। সমাজ থেকে দুর্নীতিকে নির্মূল করতে গেলে সর্বপ্রথম দুর্নীতির বহুমুখী প্রকার সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন।

দুর্নীতির বহুমুখি প্রকল্পে জানতে গেলে তারও পূর্বে জানা প্রয়োজন দুর্নীতির প্রকৃত সংজ্ঞা কি! সরল ভাষায় বলতে গেলে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জীবনে অনুষ্ঠিত সামাজিক নীতি থেকে বিচ্যুত হওয়ার নামই হলো দুর্নীতি। এখন এই নীতি বিচ্যুতি বিভিন্ন ভাবে হতে পারে। যেমন আর্থিক দুর্নীতি, সামাজিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্নীতি ইত্যাদি।

এগুলির মধ্যে বর্তমান সমাজে দুর্নীতির যে প্রকারটি প্রকট ভাবে চোখে পড়ে তা হলো আর্থিক দুর্নীতি। ইতিহাসে আর্থিক দুর্নীতির উদাহরণ সম্পর্কে ইতিপূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া সময় যত এগোচ্ছে, বিজ্ঞানের যত উন্নতি হচ্ছে ততোই পাল্লা দিয়ে উদ্ভূত হচ্ছে অভিনব সব দুর্নীতির পন্থা। নিত্যনতুন পন্থায় আধুনিক সমাজে দুর্নীতির মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

আধুনিক দুর্নীতির ব্যপ্তি:

ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে আধুনিক বিজ্ঞানের নিত্যনতুন অগ্রগতির সাথে সাথে দুর্নীতির উপায়গুলিতেও যুগান্তকারী সব উন্নতি ঘটে চলেছে। ফলে বর্তমানকালে দুর্নীতি কেবলমাত্র সরলীকৃত মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নেই। তা অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে চূড়ান্ত নিরাপত্তা বেষ্টনীর অন্তঃস্থলেও।

একটি ছোট্ট উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে উদ্ভূত সাইবার দুর্নীতির কথা। এই প্রকার দুর্নীতির মাধ্যমে একদিকে যেমন মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ মুহুর্তের মধ্যে লোপাট হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমন মানুষের ব্যক্তিগত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথা সংবেদনশীল তথ্যাদি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে।

তাছাড়া দুর্নীতির সাবেকি বিভিন্ন প্রকার যেমন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বরাদ্দ অর্থ তছরুপ, ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতা দখল বা মর্যাদা অর্জনের উদ্দেশ্যে অসাধু উপায় অবলম্বন ইত্যাদি তো রয়েইছে। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক দুর্নীতির বিস্তার একেবারে মাকড়সার জালের অনুরূপ। এর বিভিন্ন প্রকারকে আলাদা আলাদা করে আলোচনা করলেও দুর্নীতির প্রতিটি শাখা অপর একটির সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত। 

দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব:

সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্র তথা সমগ্র পৃথিবীর উপর দুর্নীতির প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং সুদুরপ্রসারি। সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন, দুর্নীতি কোন একটি সমাজকে দীর্ঘকালের জন্য পঙ্গু করে দেয়। আর ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি সেই সমাজের চির স্থবিরতা এবং পশ্চাদগামীতার ইঙ্গিত বহন করে।

এগুলি হল বিস্তৃত ও ব্যাপক সামাজিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতির সার্বিক ক্ষতিকর প্রভাব। এগুলো ছাড়াও ব্যক্তি মানুষের জীবনে দুর্নীতির সমূহ কুপ্রভাব রয়েছে। দুর্নীতি কোন মানুষকে তার স্বাভাবিক প্রাপ্তি থেকে যেমন বঞ্চিত করতে পারে, অন্যদিকে কোন মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ মুহূর্তে ছিনিয়ে নিতে পারে।

তাছাড়া দুর্নীতির ফলে সমাজে বৃদ্ধি পেতে পারে অসাম্য, অনাহার, দারিদ্র ইত্যাদি। দুর্নীতি হলো এক চোরাবালির মতোন। দুর্নীতিতে কোন ভাবে জড়িয়ে যাওয়া মানুষ নিজেকে নাগপাশ থেকে শত চেষ্টাতেও মুক্ত করতে পারে না। এর ফলে একটি সমাজের স্বাভাবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানসিকতা ধাক্কা খায়। ফলে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন অচিরেই ব্যর্থ হয়ে যায়।

দুর্নীতি প্রতিকারের উপায়:

একটি সুন্দর, মুক্তমনা ও মূল্যবোধসমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে গেলে সেই সমাজ থেকে অন্যান্য সকল সমস্যা দূরীকরণ এর পাশাপাশি সর্বপ্রথম প্রয়োজন দুর্নীতির সম্পূর্ণ দূরীকরণ। দুর্নীতিযুক্ত সমাজ কখনোই মুক্তমনা এবং সুন্দর হতে পারেনা। তাই এক্ষেত্রে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূরীকরণের জন্য সমাজ বিজ্ঞানীগণ তথা বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থাদি থেকে বিভিন্ন উপযোগী নির্দেশ পাওয়া যায়। সেই নির্দেশগুলিকে যথাযথ ও প্রাসঙ্গিকভাবে পালনের মাধ্যমেই সমাজ থেকে দুর্নীতি দূরীকরণ সম্ভব হতে পারে। তেমনি কয়েকটি উপায় এর কথা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

  • আর্থিক দুর্নীতি রোধ করতে গেলে সর্বপ্রথম উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের যথেষ্ট বেতন দানের মাধ্যমে যাবতীয় অভাব যাবতীয় অভাব দূর করতে হবে।
  • দুর্নীতি দূরীকরণের উদ্দেশ্যে গঠন করতে হবে বিশেষ দুর্নীতি মোকাবিলা ব্যুরো।
  • দুর্নীতি মোকাবিলার উদ্দেশ্যে উচ্চস্তর থেকে নিম্নতম স্তর পর্যন্ত বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে।
  • রাষ্ট্রের তরফ থেকে পাশ করতে হবে বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি মোকাবিলা আইন।
  • শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র ছাত্রীদের ছোটবেলা থেকেই নীতি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
  • সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতার প্রসার ঘটাতে হবে।
  • অন্যান্য সকল প্রকার দুর্নীতি রোধে সমগ্র সমাজে ব্যাপক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে।

উপসংহার:

দুর্নীতি হলো আমাদের সমাজ জীবনে পরিলক্ষিত হওয়া অগণিত সমস্যাবলির মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি। সমাজের এই সমস্যাকে দূর করতে না পারলে মহাপুরুষদের দেখানো সর্বাত্মক মানব মুক্তির স্বপ্ন চিরতরে অধরাই থেকে যাবে।

তাই আমাদের জীবনের মূল আদর্শ হোক প্রাচীন ভারতীয় মহান মৌর্য সম্রাট অশোকের শিলালেখর সেই তিন মহামন্ত্র: সত্য, ধর্ম, মান। এই তিন মহান আদর্শকে ভিত্তি করে জীবনযাপন এর মাধ্যমে আমাদের সমাজ দুর্নীতির মতন সকল কলুষতা থেকে মুক্তি পেয়ে হয়ে উঠতে পারে সত্যম-শিবম-সুন্দরম এর সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। সভ্যতা তার আপন গতিতে সকল রুদ্ধতাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারে পরিপূর্ণ বিকাশের পথে।


দুর্নীতি ও তার প্রতিকার রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। বানান ভুল থাকলে কমেন্ট করে জানাবেন। সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন:

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার
Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন