এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে দেশ হল জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল একটি জায়গা। মানুষ নিজের দেশের প্রতি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। সে কারণে প্রত্যেকটি মানুষের নিজের দেশ সম্পর্কে পৃথক পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা একজন শিক্ষার্থীর দৃষ্টিকোণ থেকে নিজের দেশের প্রতি তার আবেগকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করব।

সূচি তালিকা
ভূমিকা:
মানুষ একটি আদ্যোপান্ত সামাজিক জীব। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। একজন মানুষ যে সমাজে জন্মায় এবং বড় হয়ে ওঠে সেই মানুষটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজের আনন্দ-বিষাদ, আবেগ-উৎকণ্ঠা সকল কিছুই জড়িয়ে যায়। আর বর্তমান যুগে সামাজিক মানসিকতারই পরিণত হল জাতীয়তাবোধ ও জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর বুকে পরিণতি পায় একটি পূর্ণাঙ্গ দেশ হিসাবে। সমাজের সাথে যেমন মানুষের আবেগ ও উৎকণ্ঠা জড়িয়ে থাকে তেমনি দেশের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে মানুষের দুঃখ-ভালোবাসা, উৎকণ্ঠা ও আবেগ।
সে কারণেই মানুষ জন্মের পর থেকে বড় হয়ে ওঠার পথে নিজের পরিবারের ঠিক পরে কিংবা কখনো কখনো আগে যাকে ভালোবাসতে শেখে, সে হলো নিজের দেশ। সময়ের আবর্তে আপন দেশের সাথে মানুষ জড়িয়ে যায় আত্মার বন্ধনে। দেশের প্রতি এই সীমাহীন ভালোবাসা থেকে নিজের দেশের ভালোর জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও সে পিছপা হয় না। দেশের সঙ্গে আবেগের সাধারণ বন্ধনে জড়িয়ে থাকলেও নিজের দেশের প্রতি প্রতিটি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি হয় আলাদা আলাদা। এই প্রবন্ধে আমি আমার দেশকে কি চোখে দেখি সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের চেষ্টা করব।
আমার চোখে দেশ কি:
আমার চোখে আমার দেশ ঠিক কিরকম সে সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে আমি দেশ বলতে ঠিক কী বুঝি সে সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি আমার কাছে দেশ হল মানুষের জাতীয়তাবোধের পরিণত রূপ। আরো সহজ করে বলতে গেলে মানুষের জীবনের প্রাথমিক একক হল তার পরিবার। জীবনের প্রাথমিক একক এই পরিবারে মানুষ জন্মায় এবং বড় হয়ে ওঠে। এরকমই অসংখ্য পরিবার নিয়ে গঠিত হয় একটি সমাজ।
একটি সাধারন ভূমিতে বিরাজমান সাধারন স্বার্থ তথা মানসিকতাসম্পন্ন অনেকগুলি সমাজ নিয়ে গড়ে ওঠে একটি সাধারণ সামাজিক ব্যবস্থা। প্রাচীন যুগ থেকে এই সামাজিক ব্যবস্থাগুলি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সাধারণ স্বার্থের বিবর্তন তথা মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে জাতির জন্ম দেয়। এই জাতির সূচনা থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয় জাতীয়তাবোধ, যার পরিণত হল আজকের দেশ।
আমার দেশ ও তার চারপাশ:
আমি ভারতের নাগরিক। ভারত আমার দেশ তথা মাতৃভূমি। শুধুমাত্র নিজের দেশ বলে নয়, এই পৃথিবীতে ভারত ভূমি এক অদ্ভুত ও আশ্চর্য ভূখণ্ড। পৃথিবীর এই ভূখন্ডটিকে প্রকৃতি তার অকৃত্রিম দানে একরকম পূর্ণ করে রেখেছে। প্রাচীনকালে বিভিন্ন ধর্মে যে স্বর্গের বর্ণনা পাওয়া যায় তার সঙ্গে আশ্চর্য মিল রয়েছে আমার এই ভারতভূমির। তাছাড়া ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে দেখতে গেলেও ভারতবর্ষে পৃথিবীর প্রায় সকল প্রকার ভূমিরূপই বর্তমান।
একদিকে যেমন ভারতের উত্তর রয়েছে কারাকোরাম ও হিমালয় মহাপর্বতের প্রাচীর, তেমনই আবার ভারতের দক্ষিণে মিলেছে সাগর ও মহাসাগর। ভারতবর্ষের এই পুণ্যভূমিতে রয়েছে অসংখ্য নদনদী যা এই ভূমিকে পৃথিবীর অন্যতম উর্বর কৃষিজমির মর্যাদা দান করেছে। আবার সেই সাথে বিরাজমান থরের মতন মরুভূমি, দাক্ষিণাত্যের মালভূমি, অন্যদিকে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ একাধিক আগ্নেয়গিরি একসাথে মিলেমিশে ভারতকে অনন্যতা দান করেছে। এ কারণেই কখনো কখনো ভারতবর্ষকে সমগ্র বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ বলেও অভিহিত করা হয়।
আমার দেশের ইতিহাস:
অনন্য এই দেশটির ইতিহাসের সূচনাও অতি প্রাচীনকাল থেকে। আজ থেকে প্রায় ১০ কিংবা ১২ হাজার বছর আগে ভারত ভূমির দক্ষিনে অবস্থিত নর্মদা নদীর উপকূলে মানুষ প্রথম সভ্য সমাজ জীবন যাপন করতে শেখে। সেই সূচনালগ্ন থেকে ভারত দেখেছে হরপ্পার মতন উচ্চমানের নগর সভ্যতা, আবার দেখেছে মহান জ্ঞানতত্ত্ব কেন্দ্রিক বৈদিক সভ্যতা এবং অবশেষে বিখ্যাত ষোড়শ মহাজনপদের মাধ্যমে রাজতান্ত্রিক ভারতবর্ষের উত্থান। ভারতবর্ষ ইতিহাসের অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী থেকেছে বারবার।
সেই প্রাচীন মৌর্য যুগে ভারতে এসেই শেষ হয়েছিল গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারের অভিযান। আবার পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বারবার বিভিন্ন বহিরাগত বৈদেশিক শক্তি ভারতের অফুরান ধন সম্পদের লোভে এই দেশকে আক্রমণ করেছে। কিন্তু অবশেষে এই দেশের নিভৃত শীতল ছায়ায় আশ্রয় দিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি সেই আক্রমনকারীকেও আপন করে নিয়েছে। ভারতবর্ষ মৌর্য, কুশান, পাল, গুপ্ত ইত্যাদি অসংখ্য বংশের শাসন যেমন দেখেছে, যেমনি দেখেছে সুলতানি, ও মুঘল তথা ব্রিটিশ শাসন। এই দীর্ঘ পথ চলার মধ্যে দিয়ে আদপে সমৃদ্ধ হয়েছে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
আমার দেশের সংস্কৃতি:
ভারতবর্ষকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ শব্দবন্ধটি ফিরে ফিরে আসে বারবার। এর প্রধান কারণ হলো ভারতবর্ষের ভূ-প্রকৃতির মতন এ দেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একই রকম অঞ্চলভিত্তিক বৈচিত্র্য দেখা যায়। তবে এই বৈচিত্র্য একটি সংস্কৃতিকে আলাদা করে না, বরং ভারতবর্ষের প্রতিটি সংস্কৃতি তার নিজস্ব মহিমা দ্বারা অন্য ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে ভারতীয়ত্বের যোগসুত্র রচনা করে।
উত্তর ভারতে আমরা এক প্রকার সংস্কৃতি দেখতে পাই, দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতিতে পাই আরেক প্রকার অনন্যতার ছোঁয়া। আবার পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতের সংস্কৃতি একেবারে অন্যরকম অন্যদিকে মধ্য ও পশ্চিম ভারতের সংস্কৃতির সাথে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির কিছু মিল থাকলেও সেগুলি তাদের স্বকীয় মহিমায় মহিমান্বিত। আবার উপরোল্লিখিত প্রতি প্রকারের সংস্কৃতির মধ্যেও আঞ্চলিক প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। তবে এই প্রতিটি সংস্কৃতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো তারা এক ভারতীয় যোগসূত্রে গাঁথা। এর কোন একটিকেও বাদ দিলে ভারতীয় সংস্কৃতির জপমালাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
আমার দেশের মানুষ ও মাটি:
ভূ প্রকৃতি এবং সংস্কৃতি যেমন অঞ্চল ভেদে ভারতবর্ষে আলাদা আলাদা, তেমনি এই ভূমির মানুষ অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। কিন্তু প্রকৃতির মতোই মানুষের মধ্যেও অঞ্চল ভিত্তিক পরিচয় ব্রাত্য হয়ে ফুটে ওঠে সামগ্রিক ভারতীয়ত্ব। এখানে সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির সার্থকতা। এই ভারতীয় সংস্কৃতি সমগ্র ভারতবর্ষের সমাজকে একটি সূত্রে গেঁথে রেখেছে। তাইতো যুগে যুগে আমার দেশের বুকে আবির্ভাব ঘটেছে একের পর এক মহাপুরুষদের। আর এই ভূমির উর্বর মৃত্তিকা, মনোরম প্রকৃতি নিজেরে সকল রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে তার সন্তানদের সাদরে লালন পালন করেছে।
বিশ্বপটে আমার দেশ:
ইতিহাসে একটা সময় ছিল যখন বিশ্বের দরবারে ‘সোনার পাখি’ নামে পরিচিতি ছিল ভারতের। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারত ভূমি সবদিক থেকে এত সমৃদ্ধ যে বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের আসল লাভের জন্য তাকে এতটুকুও কসরত করতে হয়নি। সমগ্র পৃথিবী থেকে নানা জাতি, নানা ধর্ম, নানা বর্ণের মানুষ এসেছে ভারতের এই অপার সমৃদ্ধির টানে। তবে ইতিহাসের কোন এক সন্ধিক্ষণে সাম্রাজ্যবাদ আর ঔপনিবেশিকতায় জর্জরিত হয়ে ভারতবর্ষের মর্যাদা বিশ্বপটে অবনমিত হয়েছিল।
তবে স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে আবার ভারত জগত সভায় মর্যাদাপূর্ণ স্থানের অধিকারী হয়ে উঠছে। ভারতকে এখন আর কোন দেশই অবহেলা করতে পারে না। একজন সার্থক ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমি আশা রাখি অতি শীঘ্র আবার আমার প্রিয় দেশ “জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।”
উপসংহার:
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে আবেগের অপর নাম হল দেশ। একজন সার্থক দেশবাসী নিজের দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতেও পিছুপা হয়না। প্রতিটি দেশবাসীর সমগ্র জীবন দেশের উন্নতির জন্য উৎসর্গীকৃত থাকা উচিত। যে দেশের মাটি থেকে আমাদের জন্ম হয়, যে দেশের প্রকৃতি থেকে জীবনরস আহরণ করে আমরা মানুষ হয়ে উঠি; সেই দেশ মাতৃসম। আর মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্যের শেষ থাকতে নেই। তেমনি আমিও দেশের প্রতি আমার জীবনকে পূর্ণরূপে উৎসর্গ করতে চাই। আমি চাই জগত সভায় আমার প্রানের এই দেশ যখন আবার শ্রেষ্ঠ আসন লবে, তখন যেন আমিও সেই অহংকারের একজন অংশীদার হতে পারি।
আলোচ্য উপরিউক্ত ‘তোমার চোখে তোমার দেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে একজন শিক্ষার্থী দৃষ্টিকোণ থেকে মোটামুটি সবকটি দিক সম্পর্কে আমরা যথাযথ আলোচনার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে এই উপস্থাপনায় নির্দিষ্ট শব্দ সীমা বজায় রাখারও চেষ্টা করা হয়েছে। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।
উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।