ছাত্রদের সামাজিক দায়িত্ব রচনা [সঙ্গে PDF]

ছাত্ররা হল সমাজের অবিচ্ছেদ্য তথা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ স্বরূপ। বর্তমান যুগের ছাত্ররাই ভবিষ্যৎ সমাজের পথপ্রদর্শক বা নাবিক। সেজন্য ছাত্রাবস্থা থেকেই সমাজের বিভিন্ন দিকের ব্যাপারে ছাত্রদের নানাবিধ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। সমাজের সেই সকল দিক এবং সেগুলোর প্রতি ছাত্রদের যথাযথ দায়িত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করার উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের আজকের এই প্রবন্ধের উপস্থাপনা।

ছাত্রদের সামাজিক দায়িত্ব রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

মানুষ একটি আদ্যোপান্ত সামাজিক জীব। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। একজন মানুষ যে সমাজে জন্মায় এবং বড় হয়ে ওঠে সেই মানুষটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজের আনন্দ-বিষাদ, আবেগ-উৎকণ্ঠা সকল কিছুই জড়িয়ে যায়। এই সকল কিছুর মাধ্যমে সমাজ যেমন আমাদের ধারণ করে, তেমনি সমাজের প্রতিও সকল মানুষের কোনো-না-কোনো কর্তব্য থেকে যায়। ছাত্রসমাজ হলো সমাজের ভিত্তি ও ভবিষ্যৎ।

বর্তমানের ছাত্ররাই ভবিষ্যতে সমাজকে নেতৃত্ব দেবে, সমাজের মুখোজ্জ্বল করবে। তাই ছাত্রাবস্থা থেকে সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের অভ্যাসে ছাত্রদের অগ্রণী হতে হয়। ছাত্ররা তাদের বিপুল সম্ভাবনাময় শক্তি দ্বারা সমাজের অসংখ্য গুরুতর সমস্যার সমাধান করতে পারে। হয়তো সে কারণেই সমাজ গঠনে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়।

সামাজিক দায়িত্বের প্রকৃত স্বরূপ:

ছাত্রসমাজের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনার সূচনালগ্নেই সামাজিক দায়িত্বের প্রকৃত স্বরূপ আসলে কি তা উদঘাটন করা প্রয়োজন। আমরা আমাদের জীবনে চলার পথে বেঁচে থাকার নির্যাস যেসকল জায়গা থেকে সংগ্রহ করি তার মধ্যে একটি হলো সমাজ। প্রকৃতির পাশাপাশি আমাদের সমাজও ছোটবেলা থেকে আমাদের লালন পালন করে। সমাজের মধ্যে সমাজের অঙ্গ হিসেবেই আমরা বেড়ে উঠি।

শরীরের প্রতিটি অঙ্গের যেমন কোন না কোন ভূমিকা থাকে, তেমনি সামাজিক অঙ্গ হিসেবে ছাত্রদেরও নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে। সেই ভূমিকা পালনে ছাত্ররা ব্যর্থ হলে আদপে সমাজের পঙ্গুদশাই প্রকট হয়।  ছাত্রদের এই সামাজিক দায়িত্ব বা ভূমিকা বলতে বোঝানো হয়  শিক্ষা অর্জনের ফলে অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকাশের মাধ্যমে ভবিষ্যতের পথে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে সকল পদক্ষেপ প্রয়োজন হয় সেগুলির যথাযথ পালন। 

সমাজে ছাত্রদের স্থান:

পৃথিবীর সকল সমাজে ছাত্রদেরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেওয়া হয়েছে। যেকোনো উন্নত চিন্তাশীল সমাজে ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা এবং স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে থাকে। এর কারণ হলো, সুযোগ-সুবিধা এবং পরিমিত স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া ছাত্রজীবনের প্রধান লক্ষ্য অধরাই থেকে যায়। ফলে আদপে সমাজেরই ক্ষতি হয়। তাই ছাত্র হিসেবে আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো ছাত্রজীবনের প্রধান কাজ অধ্যবসায়ে মনোনিবেশ করা। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে বলা হয়েছে ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ। অর্থাৎ অধ্যয়নই হল ছাত্রদের তপস্যা। এই তপস্যা দ্বারা নিজেদের সমাজের যোগ্য করে চলে সকল সামাজিক কর্তব্য পালনে ব্রতী হতে হয়। 

প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য:

আমাদের দেশ ভারতবর্ষে সুপ্রাচীন কাল থেকে ছাত্রদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ কারণেই প্রাচীন ভারতের দিকে চোখ ফেরালে চতুরাশ্রম প্রথার অঙ্গ হিসেবে ছাত্রজীবনে গুরুগৃহে ব্রহ্মচর্য জীবনযাপনের নজির দেখা যায়। এই ব্রহ্মচর্য জীবনে পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্রদের সামাজিক, আধ্যাত্মিক তথা রাজনৈতিক সকল প্রকার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হতো যাতে তারা পরবর্তীকালে বৃহত্তর ক্ষেত্রে নিজ নিজ ভূমিকা পালনে অগ্রণী হতে পারে। গুরুগৃহে বসবাসকালেই ছাত্ররা বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব পালন করত। দুস্থ মানুষকে সাহায্য, গ্রামের মানুষকে কৃষি কাজে সাহায্য, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের সাহায্যের নিদর্শনও ভারতবর্ষে চোখে পড়ে। এই সকলই সামাজিক দায়িত্বেরই বিভিন্ন রূপ।

ছাত্রদের পারিবারিক দায়িত্ব:

ছাত্রদের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে মনে রাখা দরকার সমাজের ক্ষুদ্রতম একক হল পরিবার। প্রতিটি পরিবার থেকে এক বা একাধিক শিক্ষার্থী যেমন একত্রিত হয়ে সমগ্র ছাত্রসমাজ গঠন করে, তেমনি এমন অসংখ্য পরিবার একত্রিত হয়ে একটি সমাজকে সার্বিক রূপ দেয়। তাই সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে ছাত্রদের প্রাথমিক কর্তব্য নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করা।]

ইংরেজিতে বলা হয় ‘charity begins at home’. অর্থাৎ মানুষ নিজের গৃহে যা অভ্যাস করে, সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রেও তাইই প্রতিফলিত হয়।  তাই যে ছাত্র নিজের পরিবারকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে, তার সামাজিক চরিত্রের রূপও তেমনভাবেই গড়ে ওঠে। পরিবারের প্রতি ছাত্রদের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো পরিবারের সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, গুরুজনদের যথাযথ সম্মান করা, এবং ছোটদের স্নেহ করা ও আগলে রাখা।

রাজনৈতিক দায়িত্ব সমূহ:

সমাজ রাজনীতির বাইরে নয়। তাই সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে ছাত্রজীবন থেকে রাজনৈতিক দায়িত্বসমূহও কাঁধে তুলে নিতে হয়। ছাত্রসমাজের যুবক মন সাধারণত সহজ সরল প্রকৃতির হয়। তারা সমাজের ভালোর জন্য আত্মবলিদান দিতেও প্রস্তুত থাকে। সেজন্য উপরতলার নেতৃবৃন্দের সুযোগ-সন্ধানী সংকীর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র সহজেই ছাত্রদের চোখে ধরা পড়ে যায়। এই সুযোগসন্ধানী সংকীর্ণ মানসিকতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠাও ছাত্রদের সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

সমগ্র বিশ্বে এমন অসংখ্য নিদর্শন আছে যেখানে ছাত্ররা রাজনৈতিক দুরাচার কিংবা অপশাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটনে ব্রতী হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ছাত্রজীবনের প্রধান মন্ত্র মাথায় রেখে নিজের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকাও বিশেষভাবে প্রয়োজন। লক্ষ্যচ্যুত হয়ে স্রোতে ভেসে গেলে তা বৃহত্তর ক্ষেত্রে সমাজের জন্য সুফলদায়ক হয় না।

ছাত্রদের জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য:

ছাত্র সমাজ বয়সের কারণেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সাধারণত আবেগপ্রবন হয়। তাদের মনে হয় সহজ সরল এবং উজ্জীবিত। তাই ছাত্র সমাজের মধ্যে লুকায়িত থাকে অপার দেশপ্রেমের বীজ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে ছাত্ররা অনায়াসে যে কোন বিপদ অতিক্রম করে যেতে পারে। এই দেশপ্রেম দ্বারা উদ্ভাবিত হয়ে দেশের মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগও ছাত্রদের সামাজিক দায়িত্ব অঙ্গ স্বরূপ। প্রতিটি দেশ তার ছাত্র দের কাছ থেকে সমাজের দুস্থ আর্তপীড়িত মানুষের প্রতি সেবার প্রত্যাশা করে থাকে। দেশমাতৃকার ভূমিতেই ছাত্রদের জন্য, দেশমাতৃকার লালন পালন করে তার এই সন্তানদের। তাই দেশের প্রতি এই সামান্য দায়িত্ব পালন ছাত্রদের অবশ্য কর্তব্য। 

গণ সচেতনতা প্রসারে ছাত্রসমাজ:

সমাজে ছাত্ররা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে গণসচেতনতার প্রসারে। ছাত্রদের সহজ সরল প্রাণোচ্ছল আবেদন মানুষের মন ছুয়ে যেতে বাধ্য। সে কারণে বিভিন্ন সুঅভ্যাসের প্রচারে, কুসংস্কার দূরীকরণে, বৈজ্ঞানিক মানসিকতা প্রসারে ছাত্রদের গুরুদায়িত্ব পালনে ব্রতী হতে হয়। ছাত্ররা তাদের শিক্ষার্থী জীবনে অর্জিত জ্ঞান দ্বারা সমাজের সবচেয়ে অন্ধকারময় দিকটিতেও আলোর প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়। এই ভূমিকার কারণেই বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে সমাজ সচেতনতামূলক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাত্রদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।

সমাজ সচেতনতার পাশাপাশি তারা পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বনসৃজনকে ছাত্রজীবনের সঙ্গে একাত্ম করে দেখা হয়। তাছাড়া পরিবেশ পরিচ্ছন্নতার প্রসারেও শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নোংরা আবর্জনা দূরীকরণে এবং পরিচ্ছন্নতার প্রসারে ছাত্রদের বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা চোখে পড়েছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণেও ছাত্ররা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘শেখো এবং শেখাও’ নীতিতে নিজেদের প্রাপ্ত শিক্ষা একজন নিরক্ষর ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়াও ছাত্রদের দায়িত্ব। 

উপসংহার:

সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে শুধুমাত্র যে সমাজেরই উপকার হয় এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। প্রতিটি পদে সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে আদপে চরিত্রগত দিক থেকে সমাজের পাশাপাশি লাভবান হয় শিক্ষার্থীরাও। এ সকল দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জীবনের গোড়া থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে ওঠে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, ছাত্র সমাজের মধ্যে ঘটে নীতি শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষার্থীরা সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও সচেতন হয়ে ওঠে।

সমাজের সকল দিক সম্বন্ধে এই প্রকার সচেতনতা শিক্ষার্থীকে নিজের লক্ষ্য পূরণের পথে অনেক ধাপ এগিয়ে দেয়। সর্বোপরি এর ফলে ভবিষ্যতে সমাজ তথা দেশের প্রতি যে গুরুদায়িত্ব পালনে মানুষকে অবতীর্ণ হতে হয়, শিক্ষার্থী জীবন থেকেই তার হাতেখড়ি হয়ে যায়। 


সমাজের প্রতি শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব সম্পর্কে উপরিউক্ত এই উপস্থাপনায় আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত সম্ভাব্য সবকটি দিকের ওপর যথাযথরূপে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। তবে ছাত্রদের সামাজিক দায়িত্ব শীর্ষক এই প্রবন্ধে পরীক্ষার প্রয়োজনে অনিবার্যভাবেই আমাদের শব্দ সীমা বজায় রাখতে হয়েছে। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভাল লেগেছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথাযথভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারবে।

উপরিউক্ত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন