সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে মানুষের সাথে গাছের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।গাছ তার সবকিছু উজাড় করে দেয় আমাদের উপকারে।মানুষের দ্বারা করা পরিবেশ দূষণ প্রতিকারেও গাছ সর্বাধিক ভূমিকা পালন করে। এমনই এক অকৃত্রিম বন্ধুর প্রতি মানুষের বিবেকহীন আচরণ।
মানুষের লোভের শিকার হচ্ছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু গাছ।অরণ্য উচ্ছেদের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে।মানুষ ভুলে যেতে বসেছে গাছের অবদানের কথা। এ নিয়ে আজকের বিষয় গাছ আমাদের বন্ধু রচনা।

সূচি তালিকা
ভূমিকা:
সৃষ্টিলোকের সেই আদিপ্রাণ বৃক্ষ পৃথিবীকে যুগ যুগ ধরে রক্ষা করেছে ধ্বংসের হাত থেকে। মানুষের ক্ষুধায় জুগিয়েছে ফলমূল, আশ্রয়ে দিয়েছে ছায়া— বিশ্বব্যাপী সুবিস্তৃত বনানী জুড়ে এই আদিপ্রাণ বিকশিত হয়েছে। বায়ু থেকে প্রাণ হরণকারী বিষ আহরণ করে সে বায়ুকে নির্মল করেছে।
ঝরা পাতা দিয়ে ভূমিকে করেছে উর্বর, সবুজপত্র পল্লবের আহবানে বর্ষণ ঘটিয়ে পরিবেশকে করেছে আর্দ্র। বৃক্ষ আমাদের প্রাণ, আমাদের প্রাণের পরম বন্ধু। সে আমাদের দিয়েছে বসবাসের আচ্ছাদন, রোগের ওষধি, অনুশীলনের উপকরণ, আমোদ-প্রমোদে বাদ্যযন্ত্র, রৌদ্রতাপে শ্রান্ত পথিককে দিয়েছে শীতল ছায়া। সে বন্যার রক্ষক, ভূমিক্ষয় নিবারক—তার অজস্র অকৃপণ দানে প্রাণী মাত্রই কৃতার্থ কৃতজ্ঞ।
সভ্যতার ধারক ও বাহক:
পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা সমূহের সূতিকা গৃহ হলো অরণ্য। এই অরণ্য মানব সভ্যতার উন্মেষ দ্বারকে করেছে উন্মুক্ত: এক অপার স্নেহের বন্ধনে আবিষ্ট করেছে আমাদের প্রাণী জগতকে। তাই গাছই হলো আমাদের অকৃত্তিম বন্ধু। জন্মের পর থেকেই এই পরম সখ্যতার আরম্ভ; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এই বন্ধুর সাহায্য নিয়েই আমাদের জীবনের পথ চলা।
গাছপালা ছাড়া জীবন সম্পূর্ণরূপে অচল। পরমবন্ধু গাছ আমাদের দিয়েছে পরনের কাপড়টুকু, অলংকরণ তথা দেবতার অর্ঘ্য রূপে পুষ্পভান্ডার, যজ্ঞের সমূহ উপাদান এমনকি বাসগৃহের উপাদানরূপে কাঠ – লতা -পাতা, আসবাবপত্রের প্রয়োজনীয় কাঠ। এই সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাতেও গাছ অনন্য তথা বিকল্পহীন। তাই গাছ আমাদের বন্ধু এই শীর্ষক সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
গাছের অবদানের প্রাথমিক রূপ:
আমাদের ধরিত্রীর বুকে উদ্ভিদের শিকড় এবং পল্লব দ্বারা প্রথম প্রাণের স্পন্দন অনুভূত হয়েছিলো। সেই স্পন্দন থেকে যুগ যুগ ধরে রসদ সংগ্রহ করে জেগে উঠেছিল আমাদের মানবিক প্রাণ। জন্ম মাত্রই আমরা সবুজ গাছপালা উদ্ভিদের আশ্রয়েই বড় হয়ে উঠি। বৃক্ষ সেই থেকে আদি অনন্ত কাল ধরে আমাদের ধারণ করে এসেছে।
ধাত্রী বসুন্ধরার প্রথম সন্তান বৃক্ষের শ্যামল ছায়ায় মানুষের সামান্য প্রাণ চিরকাল মাতৃস্নেহের স্পর্শে সবুজ হয়ে উঠেছে। গাছ নিয়ে এত ক্ষুদ্র পরিসরে বর্ণনা করা সহজ ব্যাপার নয়। আমাদের প্রত্যেক নিশ্বাসে রয়েছে গাছের অবদান। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনটুকুও আমরা সংগ্রহ করে থাকি আমাদের পরম বন্ধু গাছ থেকে। উদ্ভিদহীন পৃথিবী অক্সিজেনশূন্য, আর অক্সিজেনশূন্য পৃথিবীর রূপ নিস্পন্দ, প্রাণহীন।
অরণ্য: আমাদের পরম আশ্রয়
অকৃত্রিম বন্ধু গাছের সার্বিক সাহায্য ছাড়া আমরা অচল। অরণ্য প্রকৃতি আমাদের মানব সভ্যতার যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় সকল প্রকার উপাদানের প্রধান সরবরাহ ভান্ডার। আমাদের জীবন ধারণ শুরু হয় শস্যদানা থেকে এবং জীবন রক্ষার ঔষধটুকুও এই উদ্ভিদের মাধ্যমেই আমরা পেয়ে থাকি।
দেহধারণের সূচনালগ্নে মধুর স্পর্শ থেকে মরণের যাত্রার লগ্নের কাষ্ঠ স্পর্শ, সবটুকু জুড়ে উদ্ভিদ আমাদের সমগ্র জীবনের যাত্রাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে। বিজ্ঞানের বিকাশে জীবন অনেক বেশি যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে ঠিকই কিন্তু গাছ তথা অরণ্যানী ব্যতীত এই কৃত্রিম যন্ত্র সভ্যতাও অচল। কৃত্তিম এই যন্ত্রসভ্যতার দুনিয়া থেকে সামান্য বিরতি নিতেও আমরা বারবার ফিরে যাই অরণ্যের বুকে।
জীবন যাত্রার মূল চালিকাশক্তি:
গাছ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নানা রকম খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে থাকে। নানা রকম ফলমূল যেমন আম,জাম, আপেল,কলা, লেবু, পেয়ারা,ইত্যাদি আমরা গাছ থেকেই লাভ করি। প্রতিদিনের রান্নার মশলা থেকে শুরু করে শাকসবজি সবকিছুতেই গাছের অবদান অপরসীম। চা, কফি ইত্যাদি পানীয় থেকে খেজুর রস ,ডাবের জল সবকিছুই গাছের অবদান।
গাছ আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে।গাছ থেকে প্রাপ্ত কাঠ হলো আমাদের ভীষণ প্রয়োজনীয় বনজ সম্পদ।গাছ থেকে প্রাপ্ত কাঠ দরজা জানালা আসবাবপত্র থেকে শুরু করে দেশলাই কাঠি তৈরী করতে কাজে লাগে। শাল গাছ থেকে ধুনো,পাট থেকে দড়ি সব কিছুর সাথেই জড়িয়ে রয়েছে আমাদের পরমবন্ধু গাছ।
রোগ নিরাময়ে ভেষজ উদ্ভিদ গুলির অবদান এড়িয়ে যাওয়া যায় না।গাছ থেকে প্রাপ্ত ফুল আমাদের উৎসব গুলোকে রঙিন করে তোলে। এসমস্ত কিছু ছাড়াও গাছ আমাদের পরিবেশ রক্ষায় এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।আমাদের জেনে না জেনে করা পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে গাছ সর্ব্বোচ ভূমিকা পালন করে।
গাছের মৃত্যুদূত সভ্যতার উন্নয়ন:
প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে সম্রাট অশোক তথা মধ্যযুগে শেরশাহ এবং তাদের নানা প্রতিনিধিগণ নানা মানব সেবামূলক কাজের প্রতিপার্শ্বে বৃক্ষরোপনেও ব্রতী হয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ আজ বৃক্ষ সৃজন না ঘটিয়ে বৃক্ষছেদনের যথেচ্ছাচারের মাধ্যমে জনপদ গড়ার নেশায় মত্ত। নানান শিল্পে ব্যবহারের জন্য পশ্চিমী দুনিয়ার জ্বালানী শক্তির প্রয়োজন মেটাতে অরণ্যসম্পদ ধ্বংসের মাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
প্রাচীনকালে স্থলভাগের শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি অংশ ছিল অরণ্য। এখন পৃথিবীর মোট স্থলভাগের মাত্র ২৭ ভাগ অরণ্য বেঁচে রয়েছে। নিষ্ঠুর পরশুরামের হাতে মানুষের নিঃস্বার্থ বন্ধু পরমাত্মীয় অরন্যের সংহার হয়ে চলেছে ক্রমাগত। তারা কেউ বুঝতে পারছে না যে এই ক্রমাগত সংহার এর ফলে মানব সভ্যতাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
অরণ্যধ্বংসের যথেচ্ছাচারের ফলস্বরূপ আমাদের পৃথিবীতে বেড়েই চলেছে পরিবেশ দূষণ। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় না রাখতে পারলে এরপর বন্যা, ভূমিক্ষয় তথা নানারকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানব সভ্যতাকে সংহারের মুখে পড়তে হবে। তাই আমাদের সকলকে একসঙ্গে বন সংহার নয় সংরক্ষণের যজ্ঞে নিয়োজিত হতে হবে।
অরণ্য উন্নয়ন:
যথেচ্ছ পরিমাণ অরণ্য ধ্বংস তথা বিশ্বব্যাপী জনবিস্ফোরণের প্রাক্কালে আজকের প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ভাবে গড়ে ওঠা অরণ্য মানুষের সকল অভাব অনটন মেটাতে পারেনা। তাই মানুষ বন উন্নয়নের কাজে নিযুক্ত হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের দিকে প্রতিটি ক্ষেত্রে অধিক উৎপাদনের তথা সংরক্ষণের ব্যাপারে কৃত্রিম বন আজ স্বাভাবিক বনকে ছাপিয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথ বনসৃজন তথা বন সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে শান্তিনিকেতনে বর্ষাকালে বনমহোৎসবের আয়োজন করেছিলেন। কৃত্রিম বনসৃজন ও স্বাভাবিক বন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারত তথা বাংলাদেশ সরকার সেই স্বাধীনতা শুরু থেকে বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ তথা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে এবং সংরক্ষণ ও বনসৃজন এর তাৎপর্য আমাদের সামনে তুলে ধরছেন।
সবুজ বৃদ্ধির জন্য বনভূমির পরিধি বিস্তার ও বন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দেশজুড়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কমিটি ও কমিশনের প্রবর্তন করা হয়েছে। বন উন্নয়নের প্রচেষ্টার মূল্যায়নের জন্য আছে কেন্দ্রীয় বন কমিশন। সরকারের এই উদ্যোগ সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে দিন দিন।
বন্ধুত্ব পালনে আমাদের দায়িত্ব:
‘একটি গাছ, একটি প্রাণ’_ কিংবা হয়তো তারও বেশি। গাছ থেকে আমরা যেভাবে উপকৃত হই তাতে গাছের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব রক্ষায় আমাদেরও বেশ কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। বর্তমানে মানবসভ্যতার উন্নতির স্বার্থে আমরা গাছের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট করছি। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রচুর গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে।
যে বিশাল ক্ষতি আমরা করেছি তা পূরণের দায়ও আমাদের। তাই আমাদের সকলের গাছ লাগানো এবং গাছের যত্ন নেওয়া উচিত। অপ্রয়োজনীয় ভাবে মাত্রাতিরিক্ত গাছ কেটে ফেলা থেকে যেমন বিরত থাকতে হবে, তেমনই বৃক্ষরোপন ও অরন্য সংরক্ষণে আমাদের সকলকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আর এভাবেই আজীবন গাছের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখার দায়িত্ব শুধুমাত্র সরকার বা কোনো ব্যক্তি বিশেষের নয়, তা আমাদের সকলের।
গাছ ছাড়া সভ্যতার সংকট:
একদিন শুরু হয়ে ছিল প্রকৃতিকে জয় করার সাধনা।মানুষ সেই সংগ্রামে অনেকাংশেই জয়ী। এই জয়যাত্রায় মানুষ নদীকে বাঁধ দিয়ে বেঁধেছে, পাহাড় কেটে পথ প্রশস্ত করেছে, সমুদ্রকে বেঁধেছে সেতু বন্ধনে। আর পাশাপাশি উচ্ছেদ করেছে একের পর এক অরণ্য।
বিস্তৃত হয়েছে কলকারখানা,জনপদ, কৃষিক্ষেত্র। কিন্তু বিজয়ী মানুষ সভ্যতার শীর্ষলগ্নে দাঁড়িয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা শুনতে পেয়েছে। তাদের ভাষায় এক ভয়ংকর বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্যে স্থলভূমির এক তৃতীয়াংশ জুড়ে বনভূমি থাকা দরকার। প্রতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উপড়ে পড়া গাছদের আবার সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।
উপসংহার:
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন পরিবেশ রক্ষার প্রাথমিক শর্ত হল অরণ্যের বিস্তার।নগরজীবনের দূষিত পরিবেশ মানুষকে আজ ভীষণভাবে মনে করিয়ে দেয় আরন্যক সভ্যতার উদার প্রশান্ত জীবনের কথা। কিন্তু নগরের এই যান্ত্রিক জীবন বর্জন করে অরণ্যে ফিরে যাওয়া আজ মানুষের পক্ষে আর সম্ভব নয়।
কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই অরণ্যের পূণ্যচ্ছায়া আবার ফিরে পাওয়া সম্ভব। বাড়ির আঙিনায়, আশপাশের রাস্তার ধারে, পার্কে, শহরের উপকণ্ঠে আমরা যদি বৃক্ষরোপণ করি, তাহলে আমাদের পরম বন্ধু গাছ আমাদের দেবে প্রানদায়ী বায়ু, শোষণ করে নেবে পরিবেশের বিষাক্ত দূষিত বীজাণুকে; বদলে দান করবে পরমা শান্তি তথা সার্বিক সমৃদ্ধি।
শৈশব থেকে একটি শিশু যেমন ক্রমে বড় হয়ে উপার্জনক্ষম হয়, তেমনই একটি গাছ চারা থেকে বৃক্ষ হয়ে প্রকৃতির কাছে ঋণ রূপে প্রাণিজগতের অস্তিত্ব রক্ষার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করে।
গাছ আমাদের বন্ধু প্রবন্ধ রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান। আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান। দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
উল্লেখ: বৃক্ষ – উইকিপিডিয়া