একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা রচনা / একটি বর্ষণমুখর রাত রচনা [সঙ্গে PDF]

বর্ষার নিজস্ব এক অনন্য সুন্দর রূপ রয়েছে। তবে বর্ষণমুখর সন্ধ্যার একটা আলাদাই বিশেষত্ব রয়েছে। এরকমই এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা রচনা।

একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা

ভূমিকা:

দুরন্ত গ্রীষ্মের অসহ্য দাবদাহের অবসান ঘটাতে ধরাধামে আগমন ঘটে মোহময়ী বর্ষাকালের। বর্ষাকাল তার অবিরাম অবিশ্রান্ত ধারায় গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে ফুটিফাটা বিশ্বসংসারকে সিক্ত করে। বর্ষার করুণাধারায় ভূমি হয় শীতল, প্রকৃতি নতুন প্রাণ ফিরে পায়। জ্যৈষ্ঠ মাসের অবসানে শ্রাবণ মাসের সূচনালগ্নে আকাশ কালো করে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা যখন ভূমিতে নেমে আসে, তখন দীর্ঘ দুই মাস ব্যাপী শুষ্ক তৃষ্ণার্ত পৃথিবী বুভুক্ষুর মতন পান করে মেঘেদের দেওয়া প্রানসুধা।

এই সময় একদিকে ক্ষুদ্র পদদলিত ঘাস থেকে শুরু করে গহন বৃক্ষরাজির শরীরে যেমন লাগে নতুন রঙের ছোঁয়া, তেমনি পৃথিবীর অন্যান্য জীবকুলের মধ্যেও শুষ্কতার অবসানে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। দীর্ঘকালব্যাপী দুরন্ত গ্রীষ্মের তীব্র দহনে ধ্বংস হবার পর যখন বর্ষাকাল আসে, তখন আমাদের মানুষের মনেও সঞ্চারিত হয় প্রকৃতির পরম পরিতৃপ্তিময় অনুভূতি।

সেজন্যই হয়তো বর্ষাকালের দিনগুলির মাহাত্ম্য আমাদের কাছে সম্পূর্ণরূপে আলাদা এবং অনন্য। বর্ষাকাল দিনের প্রতিটি মুহূর্তকে নিজের সেই অনন্য মোহময়তায় ভরিয়ে রাখে। তাই এই ঋতুতে প্রতিদিন সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা ও রাত্রির অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। আজ আমরা তেমনি এক বর্ষাকালের স্নেহে সিক্ত সন্ধ্যালগ্ন নিয়ে আলোচনা করব।

বর্ষাকালের মোহময়তা:

বর্ষাকাল স্বভাবগতভাবেই পরম মোহময়ী। ধরাধামে তার আগমন দিকভ্রান্ত পথিকের কাছে স্বস্তির শাশ্বত দেবীর ন্যায়। দীর্ঘকালীন গ্রীষ্মের শুষ্ক আবহাওয়ার অবসানে পরিবেশের সবুজ গাছপালার ওপর বৃষ্টির প্রথম ফোঁটায় যখন তারা আবার নতুন প্রাণ ফিরে পায়, তখন নিজেদের সকল রুক্ষতা হারিয়ে হয়ে ওঠে চিরসবুজ এবং নির্মল।

গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যাওয়ার নদীতট বর্ষার জল পেয়ে চিরচেনা ধারায় কুলকুল শব্দ করে বইতে থাকে। বর্ষার স্নেহ স্পর্শে খাল-বিল পুকুর ইত্যাদি নানা জায়গার জলজ উদ্ভিদ ও জীবকুলের সংকটমোচন হয়। বর্ষাকাল হলো প্রেমের ঋতু, কবিতার ঋতু, সংগীতের ঋতু। ভূমির উপর বৃষ্টির ফোটা পড়লে ভিজে মাটির স্যাঁতস্যাঁতে সোঁদা গন্ধ প্রকৃতিকে যে অপরূপ নেশায় আবিষ্ট করে, তাতে হার মানে মহুয়ার রসও।

এজন্য সর্বদাই এই ঋতু শিল্প ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষদের কাছে ভীষণ কাছের এক সময়। বাংলা ভাষায় যত কবিতা এবং সংগীত রচিত হয়েছে, তার অধিকাংশই সম্ভবত রচিত হয়েছে বর্ষাকালে। বর্ষাকাল তার এই অনন্য মোহময়তায় জগতকে মাতিয়ে রাখে প্রায় দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে।

বারিধারায় সিক্ত গোধূলি:

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, বর্ষাকালে দিনের প্রত্যেকটি সময়ের নিজস্ব এক অনন্য মাহাত্ম্য রয়েছে। এই ঋতুতে ভোরের অনুভূতি একরকম, গভীর গহন রাত্রির অনুভূতি আবার আরেক রকম। মেঘলা দুপুর এর অনুভূতি নিজের স্বকীয়তায় অনন্য, আবার বর্ষাকালের দিনান্তে সূর্যদেব অস্ত যাওয়ার মুহূর্তে গোধূলির অনুভূতিও অপরূপ মহিমায় অনবদ্য। গোধূলি তার নিজস্ব স্বকীয়তা কারণেই সাধারণভাবে আমাদের সকলের কাছে প্রিয়।

দিনের শেষে এই সময় সূর্যদেব যখন অস্ত যান, আকাশ যখন রাঙিয়ে যায় গাঢ় লাল আভায়, তখন আমাদের মনে একই সাথে গভীর বিষন্নতা এবং পরম প্রশান্তি দুইই বিস্তার লাভ করে। বর্ষাকালে এই অনুভূতি আরও প্রকট হয়। কারণ এই সময়ে সন্ধ্যাপূর্বের আকাশের সাথে মিশে যায় ঘন মেঘ, সেই মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে দিনান্তের শেষ আলো আর নির্মল পরিবেশের সাথে মিশে থাকে ভেজা মাটির মন মাতানো গন্ধ।

সিক্ত নরম ভূমির উপর পুষ্ট সবুজ ঘাস শেষ বারের জন্য সূর্যদেবকে প্রণাম করে বিদায় জানায়। নির্মল করুণাধারায় এইভাবে ঋদ্ধ হতে হতে প্রকৃতির বুকে মায়াময় সন্ধ্যা নেমে আসে।

সন্ধ্যাবেলার মায়া:

গোধূলির পর সন্ধ্যার সময়টি আমাদের সকলের কাছে এক পরম মায়া জড়ানো। আকাশ থেকে এই সময়ে দিনের আলো একেবারে মুছে যায় না, প্রকৃতির চারিপাশে তখনও চেপে বসে না ঘন অন্ধকার। পশ্চিমাকাশে একটু একটু করে ফুটে উঠতে শুরু করে রাত্রির নিভৃত চন্দ্রমা, আকাশের বুকে মিটমিট করে দেখা দিতে থাকে অগণিত নক্ষত্ররাজি।

পাখিকুল এই সময়ে ফিরে আসতে থাকে নিজেদের বাসার দিকে, মানুষও দিনের সকল কাজের অবসানে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীরে ফিরে আসে বাড়িতে। বাড়ির অন্দরমহলে গৃহবধূর সন্ধ্যে হয় পবিত্র আরাধনার মধ্যে দিয়ে। গৃহস্থের ঘরে ঘরে শোনা যায় মধুর শঙ্খধ্বনি, পরিবেশ ভরে ওঠে নানা ধুপ ধুনোর সুগন্ধে। গোধূলিকালে মনে যে বিষণ্ণতা ও প্রশান্তির দোলাচলে টালমাটাল দেখা দেয়, সন্ধ্যেবেলা এইভাবে পবিত্র পরিবেশের মধ্যে দিয়ে তা পরিণতি পায় সম্পূর্ণতায়।

বর্ষাকালের সন্ধ্যে:

সন্ধ্যাকাল এমনিতেই আমাদের সকলের কাছে ভীষণ কাছের একটি সময়। তার সঙ্গে যদি বর্ষার পবিত্র শান্তির আবেশ মিশে যায়, তাহলে যে পরিবেশের উদ্ভূত হয় তা এককথায় অনন্য এবং অনবদ্য। একদিকে সন্ধ্যার পূর্ণতা আর অন্যদিকে অবিশ্রান্ত বর্ষণের পরম প্রশান্তি, এই দুইয়ে মিলে আমাদের মন এক অবর্ণনীয় গভীর অনুভূতিতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে সাধারণত বর্ষা শুরু হয় বিকেলবেলার শেষ থেকে।

গোধূলি লগ্নে আকাশ জুড়ে মেঘ করে আসে, মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বিদায়ী সূর্যের শেষ ছটা। তারপর সন্ধ্যা নামতে থাকলে টিপটিপ করে শুরু হয় বর্ষণ। বর্ষাকালে সময়ের সাথে সাথে এই বর্ষণের মাত্রা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। একটা সময়ে তা পরিণত হয় ছোট-বড় ফোটার মুষলধারায়।

বর্ষার ঝমঝম আওয়াজের সাথে এই সময় মিশে যায় গৃহস্থের ঘরের পবিত্র শঙ্খ ধ্বনি; আকণ্ঠ আধ্যাত্মিকতায় ভরা ধূপধুনোর সুগন্ধের সাথে মিশে যায় ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ। নিজেদের বাসার পথে ফিরতে থাকা পাখিরা আশ্রয় নেয় বৃক্ষের সবুজ ঘন পাতার তলায়, দিনের কাজ সেরে বাড়ির পথে পা বাড়ানো মানুষের সকল ক্লান্তি ধুয়ে যায় শীতল স্নিগ্ধ বারিধারায়।

স্মরণীয় এক বর্ষণমুখরিত সন্ধ্যা:

সেদিন ছিল শুক্রবার, শ্রাবণ মাসের এক সন্ধ্যা। সেই দিন সকাল থেকেই শ্রাবনের বারিধারা চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠছিল থেকে থেকে। কখনো টিপটিপ, কখনো ঝিরঝির, কখনো বা ঝমঝম অবিরাম বর্ষণে সিক্ত হচ্ছিল প্রকৃতি। দুপুরবেলা খানিকক্ষণের জন্য সূর্যের মুখ দেখা গেলেও, বিকেল হতে না হতেই সূর্যদেবের মুখ ঢেকে চারপাশ অন্ধকার করে ঘনিয়ে এল কালো মেঘ।

বিকেলের শেষ থেকেই সেই কালো মেঘে শুরু হল গুরু গুরু গর্জন, আকাশের বুকে সেইসঙ্গে ঝিলিক দিতে থাকলো বিদ্যুতের নীল শিখা। এরপর গোধূলিলগ্নের শেষ বেলায় আকাশে জমে থাকা কালো মেঘের আগল ভেঙেচুরে নেমে এলো মুষলধারায় বৃষ্টি। মাটির ওপর যেইমাত্র পড়ল বৃষ্টির ফোঁটা, চারপাশ ভরে গেল ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধে। সেই যে বৃষ্টি শুরু হল তার আর থামবার অবকাশ নেই।

খানিকক্ষণের মধ্যে যারা বাড়ির বাইরে ছিলেন, সবাই কাকভেজা হয়ে বাড়িতে ফিরে এলেন। এরই কিছুক্ষণের মধ্যে চারিদিক জুড়ে বিদ্যুতের আলো নিভে হলো লোডশেডিং। সবার সব কাজে সেই দিনের মত ছুটি পড়ে গেল। হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে জানলার ধারে বসে বসে আমরা সবাই বৃষ্টি দেখতে দেখতে ছোটবেলার গল্পে মগ্ন হয়ে রইলাম। মাঝেমধ্যে জানলা দিয়ে বৃষ্টির শীতল ছিটা এসে লাগছিল গায়ে; আর সেইসঙ্গে আমাদের মন এক অপরূপ সুন্দর অনুভূতিতে পূর্ণ হয়ে উঠল।

অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শেষে:

বৃষ্টি যখন থামল, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গিয়েছে। ইলেকট্রিকের আলো তখনও আসেনি। বাড়ির চারপাশে জল থৈ থৈ; জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বুঝতে পারলাম ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর ভিজে মাটির গন্ধ সমগ্র পরিবেশকে মাতাল করে রেখেছে।

হারিকেনের আলো তখন নিভু নিভু, মা নতুন মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে এলেন রাতের খাবার: বর্ষণের উত্সবে বাঙালি সার্বজনীন জাতীয় খাবার: খিচুড়ি আর মাছ ভাজা। খেয়েদেয়ে আমরা সবাই শুয়ে শুয়ে গল্প করতে লাগলাম। সন্ধ্যে থেকে অবিশ্রান্ত বর্ষণে মায়ায় জড়ানো এমন একটি দিন এইভাবে পরম মাধুর্যের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো।

উপসংহার:

এসব কারণেই বর্ষাকাল আমাদের সকলের অত্যন্ত প্রিয় একটি ঋতু। হয়তো পরম ক্লান্তিদায়ক দীর্ঘ গ্রীষ্মের পরই বর্ষার আগমন বলে তার মাহাত্ম্য এতো বেশি। কারণ প্রকৃত দুঃখ যখন অনুভূত হয় কেবলমাত্র তখনই সুখের অনুভূতি পূর্ণতা লাভ করতে পারে। একথা সত্য যে অতিবর্ষণ সমাজের বহু মানুষের কাছে বয়ে নিয়ে আসতে পারে অভিশাপ, তবুও বর্ষণ ছাড়া এ পৃথিবী মরুভূমির মতো শুষ্ক ও কঠোর।

তাই একদিকে অতিবৃষ্টি যেমন কাম্য নয়, তেমনি অনাবৃষ্টিও অভিশাপস্বরূপ। বর্ষাকালই ধরিত্রীকে করে রাখে শস্য-শ্যামলা, দিনের নানান সময়ে লাগায় নতুন নতুন রঙের ছোঁয়া। বর্ষার ছোঁয়াতেই আমাদের প্রিয় সন্ধ্যেবেলাগুলি পরম পূর্ণতায় ভরে যায়। এইভাবে প্রকৃতির বাঁধনে, ঋতুচক্রের নিয়মে আমাদের জীবন অনন্ত শাশ্বত শান্তিতে ভরে উঠুক, এতেই জীবনের সার্থকতা।


একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা / একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা রাত রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন:

একটি শীতের সকাল রচনা
Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন