একটি বনভোজনের অভিজ্ঞতা | একটি চড়ুইভাতির অভিজ্ঞতা রচনা [PDF]

শীতের মরশুমে পরিবার বা বন্ধুদের সাথে বনভোজনের যাওয়ার মজাই আলাদা।নিত্য দিনের কাজ পড়াশোনা সব ভুলে বন্ধু বান্ধব , আত্মীয় স্বজনদের সাথে আনন্দে মেতে ওঠার আর এক নাম বনভোজন বা চড়ুইভাতি।আজকের রচনার বিষয় একটি বনভোজনের অভিজ্ঞতা বা একটি চড়ুইভাতির অভিজ্ঞতা।

একটি বনভোজনের অভিজ্ঞতা রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

আমরা সকলে বর্তমানে যে যার জীবনে অত্যন্ত ব্যস্ত। অন্য কারোর জন্য তো দূর কখনও কখনও আমরা নিজেদের জন্যই সময় বার করে উঠতে পারি না। কিন্তু শুধুমাত্র প্রতিদিনের ব্যস্ততা জীবনকে ঘিরে থাকলে মানুষের জীবন নিরস হয়ে উঠতে পারে। আর একটি নিরস জীবনে গতিময়তা থাকলেও প্রাণবন্ততা থাকেনা। সেই প্রাণহীন জীবনে রোজকার ইঁদুর দৌড়ে মানুষ নিজেকে অন্ধকারের অতলে হারিয়ে ফেলে।

সে কারণেই মাঝে মাঝে এই চূড়ান্ত ব্যস্ততা থেকে মুহূর্তের বিরতি নিয়ে প্রয়োজন নিজেকে সময় দেওয়ার এবং বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সকলের সাথে সময় কাটানোর। এর দ্বারা মানুষের মন যেমন শুষ্কতার হাত থেকে রক্ষা পায়, তেমনি সমাজে স্বাভাবিক সামাজিক বন্ধন বজায় থাকে।

কিন্তু আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সময়ের জন্য মানুষের পক্ষে ব্যস্ততা থেকে অবসর নেওয়া সম্ভব হয় না। কবে যে স্বল্প সময়ের অবসর গ্রহণ আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় তারমধ্যে সকলের সঙ্গে একসাথে মিলে আনন্দ করার জন্য বনভোজনের থেকে উপযোগী আর কিইবা হতে পারে। অতিসম্প্রতি আমার এমনই একটি বনভোজনের অভিজ্ঞতা এই প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করব।

বনভোজনের গুরুত্ব:

সাধারণভাবে দেখতে গেলে বনভোজনের অর্থ হলো বনে গিয়ে ভোজন। আসলে আগেকার দিনে রোজকার ব্যস্ত জীবন থেকে একদিন ছুটি নিয়ে বনে গিয়ে সবাই মিলে একসাথে আনন্দ করে রান্না করে খাওয়ার নামই ছিল বনভোজন। বর্তমানে বনে গিয়ে ভোজন করার রীতি বদলালেও বনভোজনের নাম, চরিত্র ও তাৎপর্য একেবারেই বদলায়নি। একথা সত্য যে জীবনের ব্যস্ততা থেকে প্রাণের নির্যাস খুঁজে নেওয়ার সবথেকে উপযোগী উপায় হলো ভ্রমণে যাওয়া।

কিন্তু মাত্র একদিনের জন্য পাওয়া অবসরে কাঙ্খিত ভ্রমণ সম্ভব নয়। সেই কারণে সকলে মিলে একদিন চেনা প্রকৃতির বাইরে কোথাও গিয়ে আনন্দের নির্যাস খুঁজে নিলে তাও ব্যস্ত জীবনের চিরাচরিত একঘেয়েমি কাটানোর জন্য সমানভাবে উপযোগী হতে পারে। সকলের সাথে একদিন একসঙ্গে মিলন এক্ষেত্রে যেমন সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে অন্যদিকে চেনা পৃথিবীর বাইরে একদিনের হাওয়া বদল মনকে তরতাজা করে তোলে। 

বনভোজনের পরিকল্পনা এবং স্থান নির্বাচন:

আমি প্রতি বছর অন্তত দুই থেকে তিন বার বনভোজনে গিয়ে থাকি। তার কোনোটা হয়তো বিদ্যালয় কিংবা কলেজ জীবনের বন্ধুদের সাথে, আবার কোনোটা নিতান্তই পারিবারিক বনভোজন। এই বছরও ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে আমার পরিবারের অনেকে মিলে একসঙ্গে বনভোজনে যাওয়া স্থির হল।

বনভোজনের সম্ভবত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো বনভোজনের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন। সেই উদ্দেশ্যেই একদিন সন্ধ্যেবেলা পরিবারের সকলে মিলে আলোচনায় বসলাম। দীর্ঘ আলোচনার পর স্থির হলো এই বছর আমরা বনভোজনের উদ্দেশ্যে ইছামতি নদীর তীরে টাকি যাব। টাকি হলো ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত এমন একটি জায়গা যেখানে নদী ভারত-বাংলাদেশ এই দুই দেশের সীমানা নির্ধারণ করছে। 

দলবেঁধে গন্তব্যে পৌঁছানো:

নির্দিষ্ট দিনে সকলে মিলে একসাথে বনভোজনে যাওয়ার জন্য একটি ছোট বাস ভাড়া করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট দিনে ভোর সাড়ে ছটার মধ্যে সকলে নির্দিষ্ট স্থানে এসে হাজির। তারপর সেই ভাড়া করা বাসটিতে চেপে আমরা সবাই বনভোজনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ঘন্টাখানেক চলার পর পর থেকেই বাসের জানালার বাইরের দৃশ্য ক্রমশ বদলে যেতে শুরু করল।

আস্তে আস্তে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের বাস ধীরে ধীরে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে সবুজের রাজ্যে প্রবেশ করছে। অবশেষে ঘন্টা দুয়েক চলার পর আমরা আমাদের গন্তব্য টাকিতে এসে পৌঁছলাম। সারাদিনের রান্না বান্না এবং খাওয়া-দাওয়ার সরঞ্জাম আমরা আসার সময় বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম।

বাস থেকে সেইসব নামিয়ে সামান্য হাঁটাপথে আমরা রওনা দিলাম ইছামতি নদীর দিকে। খানিক দূর যাওয়ার পরই দেখতে পেলাম নদীর ধারে কিছু কিছু স্থান বনভোজনের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে। আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে সকল জিনিসপত্র নিয়ে উপস্থিত হলাম।

নদীর ধারে সকালের পরিবেশ:

পৌছানোর পরই নদীর ধারে মাটিতে সবুজ ঘাসের উপর মাদুর পেতে বসে যা অনুভব করলাম তা হলো শীতকালের সকালে নদীর ধারের অপরূপ পরিবেশ। ইছামতি নদীর অপর পাড়ে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর নদীর ওপর কোথাও কোথাও শীতের সকালের আবছা মৃদু কুয়াশা জমে রয়েছে। মাটিতে ঘাসের ওপর পড়ে রয়েছে ভোরের শিশির। এদিকে কিছু দূরে গ্রাম দেখা যাচ্ছে।

কয়েকজন স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে শুনলাম এখানকার নদীতে মাঝে মধ্যে দুই দেশের সীমানা রক্ষীবাহিনী এসে টহলদারি করে যায়। এপাশে ভারতবর্ষের শেষ গ্রামটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম সেই গ্রামের ওপর জমে রয়েছে কুয়াশা। গ্রামটি ঘিরে রয়েছে ছোট ছোট কুড়ে ঘর অসংখ্য গাছপালা। এখানে অনতিদূরে কিছু ছোট ছোট ছেলে মেয়ে খেলা করছে। শীতকালের সকাল হওয়ার কারণে গায়ে বেশ ঠান্ডাও অনুভব হচ্ছিল।

বোটিং করার অভিজ্ঞতা:

বনভোজনের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে সকালের খাবার খেয়ে আমরা কয়েকজন বেরিয়ে পড়লাম চারিদিকে ঘুরে দেখতে। খানিক দূর যাওয়ার পরে দেখলাম নদী থেকে একটি ছোট লেক তৈরি করা হয়েছে। সেই দেখে বনভোজনে আসা মানুষদের জন্য করা হয়েছে বোটিংয়ের ব্যবস্থা। আমাদের মন আনন্দে নেচে উঠলো। দুটো বোট ভাড়া করে আমরা নেমে পড়লাম বোটিংয়ের উদ্দেশ্যে।

নেমে বুঝতে পারলাম নদী থেকে খাল কেটে জল আনার কারণে নদীর বিভিন্ন মাছ এই লেকে আনাগোনা করে। তাছাড়া লেকের জলে চরে বেড়াচ্ছে কিছু রাজহাঁস যারা এখানকার পরিবেশকে আরো মনোরম করে তুলেছিল। প্রায় আধঘন্টা ধরে বোটিং সেরে একরকম রণ-ক্লান্ত বিজয়ী সৈনিকের মতন আমরা ফিরে এলাম আমাদের বনভোজনের নির্দিষ্ট স্থানে। 

একসাথে রান্নাবান্না ও খাওয়া-দাওয়া:

যখন আমরা ফিরলাম তখন দেখতে পেলাম ইতিমধ্যে দুপুরের রান্নাবান্না শুরু হয়ে গেছে। আমরা কয়েকজন পারিবারিক বন্ধু মিলে সাহায্যের জন্য হাত লাগালাম। বনভোজনে গিয়ে সকলে মিলে একসাথে হাত লাগিয়ে রান্নাবান্না করে খাওয়া দাওয়ার আনন্দই আলাদা। দুপুরে খাওয়ার জন্য রান্না হল স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে কিনে আনা বন মোরগের মাংসের গরম গরম ঝোল, ডাল তরকারি এবং ভাত।

ডাল, তরকারি ও চাল আমরা বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছিলাম। এরপর মিষ্টিমুখ করার জন্য হাতে পড়লো বাঙালির পরম প্রিয়’ রসগোল্লা। এইভাবে পাত পেড়ে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা যখন ঘাসের উপর পেতে রাখা মাদুরে বিশ্রাম নিতে বসলাম তখন আকাশে সূর্য বিকেলের আগমন ঘোষণা করছে।

বিকেলের আড্ডা ও খেলাধুলা:

খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিতে বসলাম বটে কিন্তু বনভোজনে আসলে বিশ্রাম বলে কিছুই হয়না। মাদুরের উপর বসে শুরু হলো গান-বাজনার আসর। আমাদেরই পরিবারের মধ্যে এক বন্ধু তার গিটার নিয়ে এসেছিল। সে গিটার বাজিয়ে বিভিন্ন গান গেয়ে আমাদের শোনালো। তারপর আমার এক কাকিমা গেয়ে শোনালেন অপূর্ব সুন্দর রবীন্দ্র সংগীত। এরপর আমরা কয়েকজন মিলে উঠে গেলাম কিছুক্ষণ খেলাধুলা করবার জন্য।

সাথে আনা ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট এবং শাটলকক দিয়ে একটু খেলাধুলা না করলে বনভোজন যেন সম্পূর্ণ হয়েও হয় না। খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণের রুদ্ধশ্বাস খেলাধুলা আমাদের সকলকেই পরিশ্রান্ত করে দিল। অবশেষে খেলাধুলা ছেড়ে আমরা আবার এসে যোগ দিলাম চলতে থাকা সেই সাংস্কৃতিক আসরে। তখন সেখানে আবৃত্তি হচ্ছে রবি ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ।

নদীতীরে সন্ধ্যার অনুভূতি:

ইতিমধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম সূর্যদেব পশ্চিম গগনে হেলে পড়েছেন। চারিদিক জুড়ে নেমে আসছে সন্ধ্যার আমেজ। আমাদের আশেপাশে যারা বনভোজনে এসেছিলেন তারা একে একে জিনিসপত্র গুটিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিচ্ছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তখনো বিরতি নেই। মা তখন গাইছেন “তোমায় নতুন করে পাব বলে”।

অনতিদূরে গ্রামটাকে সন্ধ্যার অন্ধকার আর কুয়াশা যেন আরও আবছা করে ফেলেছে। নদীর ওপারে প্রতিবেশী দেশকে তখন আর পরিষ্কার দেখা যায় না। কিছুক্ষণের মধ্যে কানে এল ঝিঝি পোকার আওয়াজ। এসব অঞ্চলে সন্ধ্যার শুরু থেকেই ঝিঁঝিঁপোকা ডাকতে শুরু করে। গ্রামের কোন এক ঘর থেকে শঙ্খধ্বনি কানে এলো। নদীতীরের মধুর পরিবেশে বিভোর হয়ে গান শুনতে থাকা আমরা সম্বিত ফিরে পেয়ে জিনিসপত্র গুটিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। 

উপসংহার:

সেইদিন বনভোজন সেরে বাসে করে বাড়ি ফেরার সময় আমাদের সকলের মন এক অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি পূর্ণ হয়ে ছিল। যাবার সময়কার আমাদের হই-হুল্লোড়ের আনন্দ অনুভূতিকে ছাপিয়ে গেল ফেরার সময়কার নিস্তব্ধ পূর্ণতা।

সেই দিন সারাদিনের যে অনুভূতি নিয়ে বাড়ী ফিরে এসেছিলাম তা পরবর্তী বহুদিন মনের অন্তঃস্থলে অনেকখানি জায়গা অধিকার করে ছিল। সেইবার বাড়ি ফিরে সকলে স্থির করলাম এবার থেকে প্রত্যেক বছর ডিসেম্বর মাসে আমরা পরিবারের সকলে মিলে একত্রিত হয় এমনই বিভিন্ন জায়গায় বনভোজনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো।


একটি বনভোজনের অভিজ্ঞতা বা একটি চড়ুইভাতির অভিজ্ঞতা প্রবন্ধ রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো কমেন্ট করে জানাবেন।আপনার একটি কমেন্ট আমাদের অনেক উৎসাহিত করে আরও ভালো ভালো লেখা আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ায় জন্য।বানান ভুল থাকলে কমেন্ট করে জানিয়ে ঠিক করে দেওয়ার সুযোগ করে দিন।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন